মোকাররামুছ সাকলান: সম্প্রতি আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রচারিত সিভিল আপীল নং ৫৫/২০০৩ এর রায়ে হিন্দু উত্তরাধীকার আইনে স্ত্রীধন সম্পত্তিতে নারী ও পুরুষের সমনাধিকার প্রতিষ্ঠা বিষয়ে আমাদের আপীল বিভাগ আইনি ব্যাখ্যা প্রদান করে প্রায় ১১০ বছর আগের ভুল সিদ্ধান্তকে আর বাধ্যকর নয় মর্মে ঘোষণা প্রদান করেন।
এই ঘটনাটির সূত্রপাত ঘটে ১৯৮১ সালে। খুলনা জেলার কয়রা অঞ্চলের এলোকেশী মন্ডল ৭.৯২ একর সম্পত্তি দাবী করে উক্ত ভূমিতে তার স্বত্ত্ব ঘোষণা চেয়ে দেওয়ানী মামলা নং ১৭১/১৯৮১ দায়ের করেন। এলোকেশী মন্ডলের দাবী ছিলো যে এই সম্পত্তির মূল মালিক ছিল তার মায়ের মাতা রুক্ষিনী দাসী। রুক্ষিনী দাসী তার নিজ স্ত্রীধন তহবিল ১০০ টাকা পন মূল্যে উক্ত সম্পত্তি সহ অন্যান্য সম্পত্তি ক্রয় করেন। রুক্ষিনী দাসী মৃত্যুকালে তার একমাত্র কন্যা হাজারি সুন্দরী দাসীকে ওয়ারিশ রেখে মারা যান। ফলে হিন্দু দায়ভাগা সম্পত্তির নিয়ম অনুযায়ী কন্যা হাজারি সুন্দরী দাসী তার মাতা রুক্ষিনী দাসীর স্ত্রীধন তহবিল হতে কেনা সম্পত্তির Absolute মালিকানা অর্জন করেন। পরে হাজারি সুন্দরী দাসী মারা গেলে তার একমাত্র ওয়ারিশ হিসাবে এলোকেশী মন্ডল ৭.৯২ একর ভূমিতে তার মায়ের ওয়ারিশ মূলে Absolute মালিকানা অর্জন করেন।
বিজ্ঞ সহকারি জজ, ৩ নং অতিরিক্ত আদালত, খুলনা মামলার রায় প্রদান করেন এবং এলোকেশী মন্ডলের ৭.৯২ একর সম্পত্তিতে স্বত্ত্ব ঘোষণা করেন। পরে অতিরিক্ত জেলা জজ, ১ নং আদালত খুলনা উক্ত রায় আপীলে বহাল রাখেন এবং মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগও আপীল ও ট্রায়াল কোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। ট্রায়াল কোর্টের আদেশ দিয়ে বলেন যে, The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929 অনুযায়ী এলোকেশী মন্ডল প্রার্থিত ভূমির মালিক।
কিন্তু ট্রায়ল কোর্টের এই সিদ্ধান্তে ভীষণ বিপত্তি বাধে আপীল বিভাগে।আপীল বিভাগের প্রাথমিক শুনানীতে পূর্ণাঙ্গ আপীলের জন্য লিভ মঞ্জুর করা হয়। লিভ মঞ্জুরের গ্রাউন্ড ছিলো Elokeshi as daughter’s daughter of Rukkhini although did not inherit the suit land as ‘Stridhan’ of Rukkhini Dashi according to Sections 154, 155, 156 and 157 of the Hindu Law but she inherited the suit land as per ‘The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929’ which is wrong as the above amendment is applicable only to Mitakshara school as it appears from said amendment itself. In not taking notice of the above important point of law the impugned judgment and decree is liable to be set-aside.”
পরবর্তীতে এই গ্রাউন্ডের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে এই মামলার শুনানী এগিয়ে চলে। শুনানীতে মামলার বিবাদী-আপীলান্ট পক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট জনাব নুরুল আমিন অংশ নেন। শুনানীতে তিনি প্রথমেই যুক্তি দেন যে, ‘The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929’ মিতাক্ষরা স্কুলের জন্য প্রযোজ্য যা হিন্দু দায়ভাগা স্কুলের জন্য প্রযোজ্য নয়।
তিনি আরো বলেন যে, কোন হিন্দু নারী, পুরুষ বা মহিলা যার কাছ থেকেই সম্পত্তি অর্জন করুক না কেনো তা স্ত্রীধন সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হবেনা ফলে তা Limited Interest হিসাবে জীবনস্বত্ত্বে সেই পূর্বের নারীর নিকটতম স্ত্রীধন ওয়ারিশদের কাছে যাবে।
ফলে তিনি মনে করেন যে, রুক্ষিনী দাসীর মৃত্যুর পর হাজারী দাসী তার মায়ের সম্পত্তি জীবনস্বত্ত্বে অর্জন করেছিলো ফলে হাজারী দাসীর মৃত্যুর পর তা রুক্ষিনী দাসীর স্বামীর দিক হতে নিকট আত্মীয়ের কাছে চলে যবে এবং এই কারণে এলোকেশী মন্ডলের সম্পত্তিতে কোন Absolute উত্তরাধিকার থাকবেনা।
এদিকে শুনানীতে বাদী-রেস্পন্ডেন্ট এর আইনজীবী জনাব অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী অংশ গ্রহণ করেন। তিনি পূর্বের আদালতসমূহের রায়কে সমর্থন করে নিবেদন করেন যে, নালিশী সম্পত্তি রুক্ষিনী দাসির স্ত্রীধন সম্পত্তি বিধায় হিন্দু দায়ভাগ Law of Succession অনুযায়ী বাদিনী (এলোকেশী মন্ডল) উক্ত সম্পত্তি ওয়ারিশ হিসাবে প্রাপ্ত যা নিম্নের কোন আদালতই পরীক্ষা করে দেখেননি।
তিনি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন করেন যে, দায়ভাগা স্কুলে কোন কন্যা তার মায়ের স্ত্রীধন সম্পত্তি মায়ের মৃত্যুর পর অন্যান্য ভাই যদি থাকে তবে তাদের সাথে সমানাংশে বা Equally উত্তরাধিকার হিসাবে Absolutely অর্জন করবে। ফলে রুক্ষিনী দাসীর মৃত্যুর পর হাজারী দাসী তার মায়ের সম্পত্তি জীবনস্বত্তে নয় বরং তার উপর absolute interest এ বর্তাবে এবং সেকারণেই হাজারী দাসের মৃত্যুর পর এলোকেশী মন্ডলও সেই সম্পত্তির Absolute Ownership বা চূড়ান্ত মালিকানা পাবে।
তার এই যুক্তির মূল কর্তৃত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি আদালতকে মধ্যযুগের প্রথম দিকের বৈষ্ণব ধর্মের উপর আইনি ও ধর্মীয় গ্রন্থের লেখক ও একজন ভারতীয় সংস্কৃত পন্ডিত জিমুত বাহনের (আনুমানিক 12 শতক) বিখ্যাত গ্রন্থ “The Dayavaga” থেকে উদ্ধৃত করেন। তিনি নিবেদন করেন যে, Sheo Shankar Lal and another vs. Debi Sahai (1903), reported in 30 I.A.202 as well as the decision in the case of Huri Doyal Singh Sarmana and others vs. Girish Chunder Mukerjee and others [Ind. L.R.17 Cal, 911] along with Sections I and II under chapter IV of ‘The Dayabhaga’ by Jimuta Vahana, learned Advocate submits that the case of Huri Doyal Singh Sarmana and others vs. Girish Chunder Mukerjee and others [Ind. L.R.17 Cal, 911] was a judgment Per Incuriam and does not have a binding effect and for the same reason the decision in the case of Sheo Shankar Lal and another vs. Debi Sahai (1903), reported in 30 I.A. 202 cannot be treated as binding precedent.
1903 সালের Privy Council এর Sheo Shankar Lal and another vs. Debi Sahai এর রায় ও কলকাতার হাইকোর্টের Huri Doyal Singh Sarmana and others vs. Girish Chunder Mukerjee and others এর রায়কে judgment Per Incuriam বলার কারণ হলো এই রায় দুটি জিমুত বাহন এর The Dayabhaga বই এর ভূল অধ্যায় উদ্ধৃত করে অর্থাৎ অধ্যায় নং I ও XI উদ্ধৃত করে স্ত্রীধন সম্পত্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। মূলত জিমুত বাহন এর The Dayabhaga বইয়ের অধ্যায় নং IV যার শিরোনাম ছিলো Succession to Women’s Property। মূলত Privy Council এর Sheo Shankar Lal and another vs. Debi Sahai এর রায় ও কলকাতার হাইকোর্টের Huri Doyal Singh Sarmana and others vs. Girish Chunder Mukerjee and othersমামলা দুইটি স্ত্রীধন সংক্রান্ত হলেও তার বিচারে The Dayabhaga অধ্যায় নং I ও XI উদ্ধৃত করে বিচার করা হয়েছিল ফলে এই রায় দুটিতে আইনের সঠিক নীতি বিবেচনা না হওয়াতে সেই রায় দুটি judgment Per Incuriamবলা হয়।
আমাদের আপীল বিভাগ এলোকেশী মন্ডলের মামলা বিচার করতে গিয়ে হিন্দু আইনের বিভিন্ন কর্তৃত্ব সম্পন্ন লেখকদের লিখিত প্রবন্ধ ও আইনের ব্যাখ্যা আলোচনা করেন। আপীল বিভাগ এই মামলার বিচারে সিনিয়র অ্যাডভোকেট জনাব প্রবীর নিয়োগীকে Amicus Curie হিসাবে তার সুচিন্তিত বক্তব্য শুনেন।
বাদী, বিবাদী ও Amicus Curie এর বক্তব্য শুনে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে এলোকেশী মন্ডল তার প্রার্থিত প্রতিকার পাবে অর্থাৎ রুক্ষিনী দাসীর স্ত্রীধন সম্পত্তিতে এলোকেশী মন্ডল Absolute Owner বা নিরঙ্কুষ মালিক।আপীল বিভাগের রায়ের শেষ অংশটুকু সকলের পাঠের জন্য উদ্ধৃত করলাম।
“the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh is the solemn expression of the will of the people and the supreme law of the land. The principles of ‘equality’ before the law and ‘equal protection’ of the law are also incorporated in the Constitution as Fundamental Rights. It has been stated in Article 27 of the Constitution that:
‘All citizens are equal before law and are entitled to equal protection of law.’
One of the Fundamental Principles of State Policy of the Constitution of Bangladesh as provided in Article 19(2) is that:
‘The State shall adopt effective measures to remove social and economic inequality between man and man and to ensure the equitable distribution of wealth among citizens, and of opportunities in order to attain a uniform level of economic development throughout the Republic.’
Again, Article 19(3) of the Constitution further declare that:
‘The State shall endeavor to ensure equality of opportunity and participation of women in all spheres of national life.’
Formal equality is explicitly enshrined in the Constitution of Bangladesh and various Articles reiterate the principle of non-discrimination based on sex, caste, race and other motives. It has been stipulated in Article 28(1) of the Constitution that:
‘The state shall not discriminate against any citizen on grounds only of religion, race, caste, sex or place of birth.’
Again, Article 28(2) further provided that:
‘Women shall have equal rights with men in all the spheres of the State and of public life.’
Under the facts and circumstances of the case and the discussions made above, we are of the view that the suit property being Stridhana of Rukkhini Dashi will lawfully devolve upon the plaintiff Elokeshi, Rukkhini’s daughter’s daughter according to her faith law ‘The Dayabhaga’. However, the trial court’s view on ‘The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929’, affirmed by the court of appeal and revision is hereby expunged.
Accordingly, the civil appeal is dismissed with the observations made above.”
এই আপীল মামলাটি ২০০৩ সাল হতে আপীল বিভাগে শুনানীর জন্য অপেক্ষমাণ ছিলো। বেশ কয়েকবার শুনানীও হয়েছিলো। কিন্তু শেষবার যখন শুনানী হয় তখন এলোকেশী মন্ডল আর বেঁচে নাই। তবে এলোকেশী মন্ডলের এই রায়ে বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের সম্পত্তি অধিকারে বিশেষ করে স্ত্রীধন সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের পুরুষদের পাশাপাশি সম্পত্তিতে সাম্যতা বা Equality এবং Absolute Ownership প্রতিষ্ঠা পায়। ফলে বাংলাদেশের হাজারো কর্মজীবী হিন্দু নারীর অর্জিত সম্পদ তার সন্তানদের মাঝে সমানাংশে ভাগ হবে।
Disclaimer: I have expressed my comment after reading the full Judgment passed in Civil Appeal No. 55 of 2003. I have tried to express the submissions in short summary. In any contradiction to my expression the original judgment of Civil Appeal No. 55 of 2003 shall prevail. This essay is written without prejudice to any party and the reader may have their own independent opinion which I respect as well.
আমি সিভিল আপীল নং ৫৫/২০০৩ এর সম্পূর্ণ রায় পড়ে আমার মন্তব্য প্রকাশ করেছি। আমি সংক্ষিপ্তভাবে আদালতে প্রদত্ত নিবেদনসমূহ প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আমার অভিব্যক্তির সাথে কোনো দ্বন্দ্ব বা ব্যত্যয় হলে সিভিল আপিল নং ৫৫/২০০৩ এর মূল রায় প্রাধান্য পাবে। এই প্রবন্ধটি কোন পক্ষের পক্ষপাত ছাড়াই লেখা হয়েছে এবং অন্য পাঠকের নিজস্ব স্বাধীন মতামত থাকতে পারে যা আমিও সম্মান করি।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।