চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি আপিল নিষ্পত্তি করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন যে গ্যারান্টররা রিট দায়ের করে নিলাম কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না। ফলে কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে তার গ্যারান্টরের (জামিনদার) সম্পত্তি নিলামে তোলার পথ পরিষ্কার হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই ঐতিহাসিক রায়ের ফলে ঋণ গ্যারান্টারদের জন্য আর সহজে গা বাঁচানোর পথ নেই।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩ অনুযায়ী কোনো গ্যারান্টরের সম্পত্তি নিলামে তুলে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করতে কোনো বাধা নেই।
এখন থেকে ব্যাংক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ ঋণ নিতে চাইলে তার গ্যারান্টর হওয়ার আগে দুবার ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ গ্যারান্টররা আর মূল ঋণগ্রহীতাদের থেকে সম্পর্ক চিন্ন করে গা বাঁচাতে পারবে না। মূল ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে আদালতের স্থগিতাদেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদসহ পুরো ঋণ শোধের দায়ও এড়াতে পারবে না তারা।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বিভিন্ন মেশিনারিজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান একে আলী ট্রেডার্স ২০০৮ সালে অগ্রণী ব্যাংকের গাজীপুরের একটি শাখা থেকে ১১ কোটি টাকা ঋণ নেয়। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আলী রেজা শাওন তার কিছু সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখার পাশাপাশি তার বন্ধু, ব্যবসায়ী দেওয়ান মুরাদ হোসেনকে ঋণের গ্যারান্টর করেন।
কিন্তু ২০১১ সালে এই ঋণটি খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। তখন একে আলী ট্রেডার্সের কাছে সুদ-আসলে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ১৯ কোটি টাকা। ব্যাংক এই খেলাপি ঋণ আদায়ে গাজীপুর অর্থ ঋণ আদলতে মামলা করে। ওই মামলায় আলী রেজা শাওনকে করা হয় মূল বিবাদী। পাশাপাশি গ্যারান্টর দেওয়ান মুরাদ হোসেনকেও বিবাদী করা হয়।
২০১৫ সালে আদালত এক রায়ে বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামে তুলে বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা আদায়ের নির্দেশ দেন। এরপর ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী নিলাম ডাকে। কিন্তু কোনো বিডার না পেয়ে ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তি দখলে নেয় ব্যাংক। সেখান থেকে ব্যাংকের পাওনা টাকার মাত্র অর্ধেক উঠে আসে।
এরপর ব্যাংক বাকি পাওনা আদায়ে নির্দেশনা চেয়ে জুন মাসে আবার আদালতে আবেদন করে। আদালত গ্যারান্টরের সম্পত্তি—একটি অটো রাইস মিল ও একটি রেস্ট হাউস—বিক্রি করে বাকি পাওনা টাকা আদায়ে ডিক্রি জারি করেন।
কিন্তু ওই নিলাম আদেশ স্থগিত করার জন্য গ্যারান্টর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১৬ সালে হাইকোর্ট ওই নিলাম কার্যক্রমের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন।
ওই বছরই ব্যাংক হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে লিভ-টু-আপিল দায়ের করলে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন এবং আপিলটি প্রধান বিচারিপতির নেততৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেন।
সেই আপিল এ বছরের জানুয়ারি মাসে নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন।
আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ
পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেন, অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩ অনুযায়ী কোনো গ্যারান্টরের সম্পত্তি নিলামে তুলে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করতে কোনো বাধা নেই।
রায়ে বলা হয়, অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর ৬(৫) ধারার ক্ষমতাবলে মূল ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওই ঋণের গ্যারান্টরের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে।
এতে বলা হয়, আদালতের দেওয়া রায়, আদেশ বা ডিক্রি সব বিবাদীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে ও পৃথক পৃথকভাবে কার্যকর হবে।
ডিক্রি জারির মাধ্যমে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে আদালত প্রথমে মূল খেলাপির সম্পত্তি এবং তারপর যতটা সম্ভব গ্যারান্টরের সম্পত্তি সংযুক্ত করবেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে গ্যারান্টর যদি বাদীর পক্ষে ডিক্রির দাবি পরিশোধ করে, তবে উল্লিখিত ডিক্রি যথাক্রমে তাদের অনুকূলে স্থানান্তর করা হবে এবং তারা খেলাপির বিরুদ্ধে সেটি প্রয়োগ করতে পারবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।
আপিল বিভাগ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, এরকম বিষয়ে অনেকসময় হাইকোর্টকে ভুল বুঝিয়ে গ্যারান্টর বা ঋণ খেলাপিরা নিজেদের পক্ষে আদেশ নেয়। আর হাইকোর্ট অনেকসময় আইনের ‘মূল স্পিরিট’ বুঝতে ব্যর্থ হন।
এরকম বিষয়ে রিট হলে হাইকোর্টকে সাবধানতার সঙ্গে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
গ্যারান্টররা বিপাকে যে কারণে
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই জামিনদার বা গ্যারান্টর হিসাবে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। ঋণ খেলাপি হলে গ্যারান্টরের ওপরও দায় বর্তায় ঋণ পরিশোধের জন্য। আর সেজন্যই ঋণ না নেওয়া সত্ত্বেও গ্যারান্টররাও ঋণখেলাপি হয়। আর তাই ঋণ খেলাপি হলে ঋণ আদায়ের জন্য কেবল ঋণগ্রহীতা নয়, গ্যারান্টরের বিরুদ্ধেও মামলা করার বিধান রয়েছে বিদ্যমান অর্থ ঋণ আদালত আইনে।
গ্যারান্টরদের যত রিট
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে গ্যারান্টররা তাদের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করার বিরুদ্ধে ১৩ হাজার ৬৪১টি রিট দায়ের করেছে। দায়ের হওয়া রিটগুলোর সঙ্গে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ জড়িত। আর এসব রিটের মধ্যে ৮০ শতাংশ আদেশ গেছে রিটকারীদের পক্ষে।
২০২২ সালে গ্যারান্টররা ৩ হাজার ১৪৪টি রিট পিটিশন দায়ের করে, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে এমন পিটিশনের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮৬২টি, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
আর ২০২০ সালে পিটিশন ছিল ২ হাজার ১১৩টি, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে গ্যারান্টররা ২ হাজার ৯৭৬টি রিট পিটিশন করে, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ২ হাজার ৫৪৬, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
কী হবে এসব রিটের
আপিল বিভাগের রায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, গ্যারান্টরদের নতুন যেকোনো রিট হাইকোর্ট যাতে সাবধানতার সঙ্গে শুনানি করেন এবং আদেশ দেন। আর পুরনো রিটগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চগুলোকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঋণ খেলাপিরা নানা কৌশলে হাইকোর্টে এসে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকা থেকে নাম কাটার জন্য রিট করত। আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক রায়টির ফলে এখন সেটি প্রায় বন্ধ। নিলাম ঠেকাতে গ্যারান্টরদের যেসব রিট এখনও হাইকোর্টে পেন্ডিং আছে, আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী সেগুলো খারিজ হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থ ঋণ আদালতে যত গ্যারান্টর মামলার ফাঁদে
প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়ের করা প্রায় ৭২ হাজার মামলা দেশের বিভিন্ন অর্থ ঋণ আদালতে এখন পর্যন্ত পেন্ডিং রয়েছে।
ঢাকায় চারটি অর্থ ঋণ আদালতে চলমান মামলা প্রায় ২৬ হাজার। এসব মামলায় ‘গ্যারান্টর’ বিবাদী হিসেবে রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার জন। ঢাকার আদালতে এসব মামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।