ঢাকার শ্রম আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় বহুজাতিক গ্যাস কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশের যে সকল শ্রমিক-কর্মচারীকে গত বছরের মার্চ থেকে জুন মাসে (২০২৩) টার্মিনেট করা হয়েছিল বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রীট পিটিশনের প্রেক্ষিতে সেই টার্মিনেশন আদেশকে স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদেরকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিকদের পক্ষে নিযুক্ত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট ড. উত্তম কুমার দাস মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে রীট পিটিশন দায়ের এবং উক্ত টার্মিনেশন আদেশ বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের যে বে-আইনিভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিল মাননীয় আদালতের আদেশে তা প্রামাণিক।
এদিকে উক্ত শ্রমিক-কর্মচারীরা দীর্ঘ সময় ধরে উক্ত শেভরনের অধীনে কাজ করলেও তাদেরকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসাবে না মেনে কথিত ঠিকাদারের শ্রমিক বলে চালানোর অপচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীরা শেভরনের অধীনে দীর্ঘ প্রায় দের থেকে দুই যুগ ধরে কাজ করছেন। তাঁদের অনেকে শেভরনের পূর্বসূরি অক্সিডেন্টাল বাংলাদেশ কিংবা ইউনোকল বাংলাদেশের আমলে চাকুরীতে যোগদান করেন। তাঁরা ড্রাইভার, মেকানিক, ক্লিনার, কুক, স্কেফোল্ডার, বিল্ডার প্রভৃতি পদে ঢাকায় শেভরনের প্রধান কার্যালয় এবং জালালাবাদ, বিবিয়ানা ও মৌলভীবাজার গ্যাস ফিল্ডে কর্মরত।
তাঁরা ইউনিকল কিংবা শেভরনে চাকুরীতে যোগদান করে লাগাতারভাবে চাকুরীতে বহাল থাকলেও এখনও তাঁদেরকে স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে নিয়োগপত্র ও সার্ভিস বুক দেওয়া হয়নি; বরং কথিত ঠিকাদারের শ্রমিক বলে চালানোর অপচেষ্টা চলছে। এদের অনেকের ইউনোকল বা শেভরনে নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র রয়েছে। আর মজার বিষয় হল কোন কোন কথিত ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠা ও রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তি ২০১৭-২০১৮ সনে।
চাকুরী থেকে বে-আইনিভাবে টার্মিনশন হওয়ার প্রেক্ষিতে উক্ত টার্মিনশন আদেশের উপর হাইকোর্ট বিভাগ থেকে স্থগিতাদেশ পাওয়া মোঃ আতিয়ার রহমান বলেন, তিনি ২০১০ সনের ৬ জুন ড্রাইভার পদে শেভরন বাংলাদেশ ব্লক্সস থার্টিন এন্ড ফরটিন লিমিটেডের অধীন সরাসরি চাকুরীতে যোগদান করেন।
শেভরন তাঁকে পরিচয়পত্র এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের জন্য সার্টিফিকেট দেয়। তিনি শেভরনের স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ২০২২ সনের আগস্ট মাসে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন, যা এখনও বিচারাধীন।
উক্ত মামলা চলাবস্থায় গত ২৪ এপ্রিল ২০২৩ এক এসএমএসযোগে তাঁকে চলমান চাকুরী থেকে টার্মিনেশন করার কথা জানানো হয়। তিনি ২০১০ সন থেকে শেভরনের অধীনে যেই চাকুরী করছেন তা কোন বিরতিহীন ও ধারাবাহিক।
কিন্তু উক্ত টার্মিনেশন আদেশটি ইস্যু করে কথিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান- যা হ’ল প্রপার্টি কেয়ার বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড (পিসিএস)। তিনি স্থগিতাদেশ বিষয়ে জানিয়ে শেভরনে পুনর্বহালের জন্য দরখাস্ত পাঠিয়েছেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শেভরন বাংলাদেশ উক্ত পিসিএস’র সঙ্গে ০১ এপ্রিল ২০১৫ একটি চুক্তি করেন; তবে ঐ সময় উক্ত পিসিএস’র শ্রম আইনের ৩ক ধারা মোতাবেক বাধ্যতামূলক যেই রেজিস্ট্রেশন দরকার তা ছিলোনা। তাই উক্ত চুক্তিই অবৈধ।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের মতে, শ্রম আইনের অধীন ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগের যেই বিধান তা আইনে যুক্ত হয়েছে ০৭ জুলাই ২০১৩ তারিখ। আর তার বিধিমালা হওয়ার পর উক্ত বিধান পূর্ণাংগতা পেয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখ। এর আগে যারা চাকুরীতে ঢুকেছে তাঁরা শ্রম আইনের ৪ ধারার বিধানমতে তিন থেকে ছয় মাস পরই স্থায়ী শ্রমিক বলে গণ্য হবেন।
শ্রম আইনের বিধান হ’ল স্থায়ী কোন পদের বিপরীতে অস্থায়ীভাবে কিংবা কোন ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করতে পারবে না কোন প্রতিষ্ঠান। আর কোন পদে কোন বছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) একটানা ১৮০ দিনের বেশী কাজ দরকার হলে তা উক্ত প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী পদ বলে গণ্য হবে।
জানা গেছে, উক্ত শেভরন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ শ্রম আইনের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে যুগ-যুগ ধরে স্থায়ীপদের বিপরীতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করালেও তাঁদেরকে স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি এবং আইনগত সুযোগসুবিধা ও কোম্পানির লভ্যাংশ দিচ্ছেনা। এমন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
এই বিষয়ে শ্রমিকরা বারংবার সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়, জ্বালানী ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা, এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে আবেদন করেও কোন ফল পাননি।
মামলা করার প্রেক্ষিতে চাকুরীচ্যুত মুসফেক-উস-সালেহীন (পাভেল), যিনি ০১ অক্টোবর ২০০৭ ওয়েটার পদে চাকুরীতে যোগ দেন, জানান, চাকুরীতে স্থায়ী হওয়ার আশায় তিনি শ্রম আদালতে শেভরনের বিরুদ্ধে মামলা করে এখন চাকুরীহারা। আইনি প্রতিকার পেতে তিনিও রীট পিটিশন করেছেন।
এমনই আরেকজন হলেন- জুয়েল মাইকেল গোমেজ, যিনি ৮ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখ কুক পদে ইউনোকলে যোগদান করেন; তাঁর নিয়োগপত্র রয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর চাকুরীর শেভরনে ন্যস্ত হয়। তাঁকেও শ্রম আদালতের মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় ২০২৩ সনের ৩০ এপ্রিল বে-আইনিভাবে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। রীট পিটিশন করায় সেই টার্মিনেশন আদেশ এখন স্থগিত করা হয়েছে।
শ্রম আইনের ২২৮(১) ধারার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে, কোন শ্রম আদালতে কোন কার্যধারা (মামলা) চলাকালে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের চাকুরীর বিদ্যমান শর্তাবলীর কোন পরিবর্তন করা যাবেনা। যার মধ্যে টার্মিনেশন থেকে সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত।
এইক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, কোন শ্রমিকের দায়ের করা ব্যক্তিগত বিরোধ সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্র এই সুরক্ষা প্রযোজ্য হবে। এছাড়া উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, কোন বিরোধীয় বিষয় কোন আদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কোন পরিবর্তন আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের সামিল।
সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী শ্রমিকরা বলেন, তাঁরা শেভরনের না কথিত ঠিকাদারের- কার শ্রমিক তা নির্ধারিত হবে শ্রম আদালতের বিচার ও রায়ে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার আগেই চাকুরীচ্যুতি একদিকে বে-আইনি ও অন্যদিকে অমানবিক কাজ বটে। অনেকে ২৫-৩০ বছর চাকুরীর পর এখন বেকার। নতুন চাকুরীতে যাওয়ার বয়স, যোগ্যতা ও সুযোগ নেই তাঁদের। তাঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অমানবিক জীবন-যাপন করছেন।
জানা গেছে, শ্রম আদালতে মামলা চলাবস্থায় ২০২৩ সনের মার্চ থেকে জুন মাসে প্রায় চার শ’ শ্রমিক-কর্মচারীকে শেভরনের অধীন চাকুরী থেকে টার্মিনেশন করা হয়। আরও প্রায় ৮০ জনকে চলমান চাকুরী থেকে বিরত করে হয়। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা এই বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে উক্ত শেভরন কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত (অনুযোগপত্র) দেন। একই সঙ্গে চলমান মামলায় শ্রম আদালতে পৃথক-পৃথকভাবে দরখাস্ত দাখিল করেন। দীর্ঘ সময়েও তাতে কোন সুরাহা না হওয়ায় এখন রীট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত প্রায় ১২০ জন শ্রমিক রীট পিটিশন দায়ের করেছেন। এর মধ্যে ৩০ টির মতো রীটে রুল ও টার্মিনেশন আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ হয়েছে। আরও ৭৫ মতো রীটে রুল এবং সরকার, শেভরন কর্তৃপক্ষ ও কথিত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্য রীট এখন শুনানির অপেক্ষায়।