হাজতের পরোয়ানায় 'তলবমতে' : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ,অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।

বন্দির লিগ্যাল এইড প্রাপ্তি দয়া নয়, অধিকার

১.

আদালত চলাকালে একটু পর পর খুক-খুক কাশির আওয়াজ। আওয়াজ আসছিল আসামীর ডক থেকে। দেখলাম, হ্যাংলা-পাতলা গড়নের একজন হাজতি ডকের এক কোণে বসে অনবরত কাশছেন ।

হাজতি আসামীর নাম স্বপন। তিনি পেশায় একজন জেলে। তার বাড়ী উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে। উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের প্রতি বছরই থাকতে হয় ভাঙন আতঙ্কে।

গত দু’মাস আগেও সেখানে ৫০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী ভাঙনে তারা প্রায় প্রতি বছরই দিশেহারা থাকে নিজেদের গোছাতে। স্বপনেরও বাড়ি ভেঙ্গেছে দু’মাস আগে। মালামাল সরানোর সুযোগ পান নি। সরাবেন কীভাবে, তখন তো তিনি জেলে!

চল্লিশ বছর বয়স্ক স্বপনকে ১০ মাস আগে পুলিশ ০৬ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতারের পর থেকে এই ১০ মাস তাকে কেউ দেখতে আসেননি কারাগারে। এই সময়ে তার পক্ষে কখনোই কোনো তদবির নেওয়া হয়নি। কোনো একটি জামিনের দরখাস্ত নথিবদ্ধ হয়নি। এই দীর্ঘ সময়টা তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে বিনা তদবিরে, কোনো আইনজীবী ছাড়া।

২.

নির্দেশক্রমে আদালতের পেশকার স্বপনের নথিটা উপস্থাপণ করলেন। সেদিনই প্রথম নথিটা আমার কাছে এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম-
আপনার বাড়ির লোক আসেন না কেন?
– স্যার, হাঁমার বাড়ি-ঘর নাই। এ্যাই কিছুদিন আগে নদী খাইয়া ফ্যালাইশে। সংসারেও কেহু নাই।
সংসারেও কেউ নেই মানে?
-স্যার, হাঁমি বাপের একটাই ব্যাটা। ছোট থাকতেই বাপ মইরা গেশে। হাঁমাকে পুলিশ ধরার কয়দিন পর মা টাও মইরা গেশে।
আপনার মা মারা যাওয়ার কথা কারাগারের কাউকে জানান নি?
– হাঁমার মাও কবে মইরা গেশে তা বুলতে পারবো নাখো। হাঁমার কাকাতো ভাই ম্যালা দিন পর জেলখানায় জানালছিল।
আপনার স্ত্রী-সন্তান নেই?
– স্যার, হাঁমার বয়স দুই কুড়ি হয়াশে। হাঁপানির ল্যাগি হাঁমাকে কেহু শাদি করেনিখো। জানালেন, কারাগারে দীর্ঘদিন থাকায় তার এই রোগ আরও বেড়েছে।
আপনি কী করতেন? আপনার উকিল সাহেব নেই কেন?
-স্যার, হাঁমি নদীতে মাছ ধরি। হাঁমার উকিল ধরার খরচা নাই।
জেলে আপনার অসামর্থ্যের কথা বলেননি?
– জেলখানায় জানালছিনু স্যার। সাহেবরা বুলেছে ছয় মাস জেল না খাটলে সরকারী উকিল পামো নাখো।

আরও পড়ুনমাদকসেবীদের কারাগার নয়, নিরাময় কেন্দ্র প্রয়োজন

কী সাংঘাতিক কথা! কেউ হাজতি হলে ছয় মাসের আগে লিগ্যাল এইড পাবে না- এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪ অনুসারে বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল তিনি আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। এছাড়া উক্ত নীতিমালা অনুসারে আর্থিকভাবে সহায়-সম্বলহীন বলে বিবেচিত ব্যক্তিকে জেল কর্তৃপক্ষ আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য সুপারিশ করতে পারেন। এমন উদ্ভট যুক্তি একজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি উক্ত নীতিমালার চূড়ান্ত লঙ্ঘন।

স্বপনের কথার সাথে নিজের একটি সাবেক কর্মস্থলের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখলাম। সেখানে জেলা কমিটির মাসিক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, মাদক মামলায় কোনো আসামীর হাজতবাস কমপক্ষে ০৬ মাস না হলে লিগ্যাল এইড দেওয়া যাবে না। ফলে খুব অল্প পরিমান মাদকের মামলা যাদের ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী নেওয়ার সামর্থ্য থাকতো না তাদেরও বিনা বিচারে কারাগারে থাকতে হতো কমপক্ষে ০৬ মাস!

বিচারের আগে পূর্ব নির্ধারিত বিচারের এই অদ্ভুত নিয়মগুলো সুবিচার প্রাপ্তিতে বড় প্রতিবন্ধক। স্বপনের মামলায় লিগ্যাল এইড দেওয়ার জন্য জেলা কমিটির এমন কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। তবুও তাকে এতদিন বঞ্চিত রাখা হয়েছে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার মৌলিক অধিকার থেকে।

আরও পড়ুন: আদালতগামী বন্দির খাবার প্রাপ্তি দয়া নয়, অধিকার

তবে শুধু কারা কর্তৃপক্ষ নয়, এক্ষেত্রে আদালতের দায়ও এড়ানো যায় না। কেননা, ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস, ২০০৯ এর ৬৪৪ বিধিতে এমন ব্যক্তিদের আইনগত সহায়তাসহ অন্যান্য আইনানুগ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত না করার ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। ৬৪৩ বিধির পরিধি আরও ব্যাপক। উক্ত বিধিতে মৃত্যুদণ্ডের কোনো মামলায় পলাতক আসামীর পক্ষেও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। State V Robiul Hossain @ Rab 52 DLR page 370, 371 মামলায় রাষ্ট্রীয় খরচে একজন স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার নিয়োগ করা আদালতের DUTY মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই মামলায় বিবরণে জানা যায়, আসামী রবিউল @ রবসহ ১২ জনের বিরেুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৯৬/৩৪ ধারায় মামলা করা হয়েছিল। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে উক্ত মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ মোট ২০ জন সাক্ষীকে পরীক্ষা করেন। বিচারে উক্ত আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে উক্ত ধারায় দোষী সাব্যস্তপূর্বক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বিচারের সময় আসামীকে প্রতি তারিখে তারিখে কারাগার থেকে আদালতে উপস্থাপন করা হতো। কিন্তু তার কোনো আইনজীবী ছিল না। মামলাটিতে মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্ন জড়িত থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপক্ষ হতে তার জন্য আইনজীবী নিয়োগের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে মাননীয় হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, ‘‘The condemned prisoner was in custody and he was produced before the Court from time to time but he was not represented by any lawyer of his choice. So it was the duty of the Court to appoint a lawyer at the cost of the state to defend the condemned prisoner as the offence was the offence was punishable with death.”

এখানে রাষ্ট্রীয় খরচে একজন স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার নিয়োগ না করায় মাননীয় হাইকোর্ট death reference টি প্রত্যাখান করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশটি রদ-রহিত করেন এবং মামলাটিতে প্রসিকিউশন পক্ষের সকল সাক্ষীদেরকে পুনঃতলব (recall) করে আসামীপক্ষের আইনজীবীকে জেরা করার সুযোগ দিয়ে ০৬ (ছয়) মাসের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তির জন্য বিচারিক আদালতকে নির্দেশনা দেন।

আরও পড়ুনবন্দীর সাথে সন্তানের সাক্ষাৎ একটি অধিকার

আমরা দেখেছি, ২০১৭ সালে নারায়নগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলাতে পলাতক ০৬ মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের পক্ষেও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ। এ কারণে অনেকেই মনে করেন আসামী পলাতক হলেই এ ধরণের স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার দেওয়া যাবে। বস্তুত এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আসামী পলাতক থাকুক বা না থাকুক লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মামলায় মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্ন জড়িত আছে কিনা এবং ঐ মামলায় আসামী undefended রয়েছে কিনা (Mobarak Ali @ Mobarak Ali Mondal V State, 50 DLR 10)।

সরকারী আইন সহায়তা কিংবা স্টেট ডিফেন্স যেখান থেকেই আইনগত সহায়তা প্রদান করা হোক না কেন এই সহায়তা দিতে হবে বিচার শুরু হওয়ার আগেই এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে যেন নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী প্রস্তুতি নিতে পারেন {Abdur Rashid V State, 27 DLR (AD) 1}।

এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে, সম্প্রতি এতদসংক্রান্তে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচার শাখা থেকে একটি যুগান্তকারী সার্কুলার ইস্যু করা হয়েছে। উক্ত সার্কুলার মোতাবেক, আদালতে উপস্থিত কোনো আসামীদের যেন আইনগত সহায়তা হতে বঞ্চিত না করা হয় সেজন্য তাদের আইনজীবী নিযুক্ত না থাকলে লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবীদের মধ্য থেকে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উক্ত সার্কুলারের আলোকে অনুরূপভাবে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা থেকেও একটি সার্কুলার ইস্যু করা হয়েছে।
সার্কুলার দু’টোর সুফল পেতে হলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কারাগার পরিদর্শনের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর সংশোধন করতে হবে। কারাভ্যন্তরে বিভিন্ন আইনি সচেতনতামূলক কর্মসূচিও গ্রহণ করতে হবে।

৩.

আইনগত সহায়তা প্রদান রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তির দান বা বদান্যতা নয়, বরং এটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তাই আর্থিক অসচ্ছতার কারণে কোনো নাগরিক যদি তার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তবে আইনের শাসন, সমতা, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের বিধান অর্থহীন হয়ে পড়বে। এই সুবিধা যেকোনো আসামী এমনকি যে আসামীর কোনো মামলায় একদিনেরও কারাদণ্ডের ঝুঁকি আছে, এমন ব্যক্তিও ভোগের অধিকারী।

পুনশ্চ, সেদিন আদালতে উপস্থিত লিগ্যাল এইডের আইনজীবীগণের মধ্যে একজনকে স্বপনের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বিচারের মুখোমুখি হয়ে তিনি একাধারে হারিয়েছেন ঘর, পরিবার ও স্বাস্থ্য। জীবনের এই একটির পর একটি দুর্বিষহ ছন্দ পতনের কথা কারো মাধ্যমে বলার সুযোগটাও পাননি। আজ মুক্তির পর তিনি কোথায় যাবেন, কী করবেন সে প্রশ্নের উত্তরও তার জানা নেই।

লেখক: মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।