হাজতের পরোয়ানায় 'তলবমতে' : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ,অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।

বন্দীর সাথে সন্তানের সাক্ষাৎ একটি অধিকার

সাইফুল ইসলাম পলাশ: লোহার শিকে ঘেরা কাঠগড়ার সামনে একটু পর পর একটা শিশু ঘোরাঘুরি করছিল। বয়স আড়াই তিন বছর হবে। লক্ষ্য করলাম, বাবুটা একজন বন্দীকে ছুঁয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। বন্দী সুযোগ পেলে বাবুটার হাত ধরছে, হাতে চুমু খাচ্ছে। তার পিছনে মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছে এক বয়স্ক কনস্টেবল।

টানা দু’ঘন্টা এজলাস চলার পর একটা সাময়িক ব্রেকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নামার আগে ডকের বন্দীদের জিজ্ঞেস করলাম, কার কাছে বাচ্চাটা বার বার আসছিল? ভয় পেয়ে বন্দী রফিক উঠে দাঁড়াল। বলল, এটা তার ছেলে। নিরাপত্তা প্রহরী সেই কনস্টেবলকে কাছে ডেকে বললাম, ব্রেকের সময়টুকু বাবা-ছেলে একান্তে সময় কাটাবে।

বন্দী রফিকের নথিটা হাতে নিয়ে দেখি, সে তো আসামী নয়। সে আজকের মামলায় ফরিয়াদি। এক মাস আগে তার নথিটা প্রথম আমার হাতে এসেছিল। সেদিন দেখি, ফরিয়াদি রফিক টানা এক বছর ধরে বিনা তদবিরে গরহাজির। দীর্ঘদিন আদালতে বিচারক না থাকায় টানা স্বাক্ষরে নথির বয়স বেড়েছে। সেদিন আইনানুসারে মামলা খারিজ করার পূর্ব মুহূর্তে আমার নজরে আসলো ফরিয়াদি অন্য একটি মামলায় জেল হাজতে রয়েছে।

জেল সুপারের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা হলো। তিনি জানালেন, বন্দী রফিক প্রায় এক বছর যাবৎ একটি মামলায় হাজতে আছে। কোনো রকম বিলম্ব না তাকে পি. ডব্লিউ মূলে আদালতে হাজির করা হলো। জানতে চাইলাম, তিনি তার মামলা চালাবেন কি না? তিনি জানালেন, একই দিনের ঘটনায় তিনিও মামলা করেছেন। কিন্তু হাজতে থাকার কারণে মামলা চালাতে পারছেন না। তার কোনো আইনজীবী নেই। বললাম, আদালতে যার কেউ নেই, তার জন্য জেলা লিগ্যাল এইড অফিস আছে। তাকে লিগ্যাল এইডে আবেদন করতে বললাম।

আজ বাবুটা যখন বন্দীর হাতটা স্পর্শ করলো তখন মনে হলো আমার সন্তান যেন আমার হাত স্পর্শ করেছে। কিন্তু আমি বন্দী হয়ে আছি, আমার সন্তানকে আদর করতে পারছি না। আমার নির্দেশ শুনে সেই কনস্টেবল পিতা-পুত্রকে এক করে দিলেন। বাবুটা দৌড়ে ছুটে গেল তার বাবার কাছে। বাবা কোলে তুলে নিল তার অবুঝ শিশুকে। গালের সাথে গাল লাগিয়ে স্পর্শ অনুভব করছে। আর বুকে জড়িয়ে নিয়ে এলোপাথারি চুমু দিচ্ছে গালে, মুখে ও মাথায়।

ব্রেকের পর এজলাসে উঠে দেখি বাবা-ছেলে একসাথে পা ছড়িয়ে খেলছে। তাদের খুনসুটি দেখে মনে হলো এর চেয়ে উত্তম দৃশ্য আর নেই। আদালতের যে কাঠগড়াটা সবচেয়ে আতংক, উদ্বেগ আর শংকার; সেটি বাবা-ছেলের কাছে সবচেয়ে আনন্দের জায়গা। রফিক জানালেন, মামলা হাওয়ার পর থেকে অর্থাৎ এক বছর পর এই প্রথম তিনি তার বাবুকে কোলে নিলেন। কারাগারে স্বল্প সময়ে সাক্ষাৎ হলেও কখনো ছেলের সাথে একান্তে সময় কাটানো হয়নি।

বন্দী মানেই ঘৃণার পাত্র নন। তাদেরও কিছু অধিকার রয়েছে। এই অধিকারগুলো আইন ও মানবাধিকার দ্বারা স্বীকৃত। আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারাগারে দাম্পত্য ভিজিটের ব্যবস্থা রয়েছে। সময় এসেছে একটু ভিন্ন ভাবে ভাবার, সময় এসেছে কারাগারে পিতা/মাতার সাথে নাবালক সন্তানদের একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়ার।

বি.দ্র. ঘটনা সত্য। বন্দীর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

লেখক: মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।