বিচার বিভাগীয় তদন্ত: মজলুমের বিরুদ্ধে একতরফা অস্ত্র
অ্যাডভোকেট এম. মাফতুন আহমেদ

অধস্তন আদালতে ‘দুর্নীতি’, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ও প্রধান বিচারপতিদের হুঁশিয়ারি

এম. মাফতুন আহমেদ: নানা মুনির নানা মত। তবে ঘুরেফিরে অভিন্ন মত। কেউ বলেন, ‘দুর্নীতি’ বটবৃক্ষের মতো রূপ নিয়েছে। কেউ বলেন, মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বলেন, ভয়াবহ ক্যান্সারের মতো আকার ধারণ করেছে। এসব পিলে চমকানো কথা শুনে অনেকের গাত্রদাহ হতে পারে। আবার খুশিতে অনেকে আটখানা হয়ে উঠে।

তবে কথাগুলো অপ্রিয় হলেও চলমান অবস্থায় ধ্রুব সত্য। মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। শাসক মহাল দেয়ালের লিখন দেখেও দেখেন না। পড়লেও না বোঝার ভাব দেখান। ফলে সমাজে অত্যাচার, অবিচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝংকার বেঁজে উঠছে। গোটা সমাজ ব্যবস্থা আগ্নীয়গিরির মতো উত্তাপ্ত হয়ে উঠছে। ঘুষ,নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে জাতি দিনকে দিন সোচ্চার হয়ে ঊঠছে। ‘ঘুষ’ নামক বটবৃক্ষ সব সরকারের অর্জনকে ম্লান করে তুলছে।

একটি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ। বিচার বিভাগ,শাসন বিভাগ,আইন বিভাগ। তিনটি অঙ্গই রাষ্ট্রের প্রাণ। এক অপরের পরিপূরক। একটি ভেঙ্গে পড়লে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়। গোটা চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে যায়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এই তিনটি অঙ্গের গুরুত্বকে খাঁটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে বিচার বিভাগ জনগনের শেষ ও চূড়ান্ত ভরসাস্থল।

তারমধ্যে অধস্তন আদালতে সিংহভাগ জনগণকে সর্বপ্রথম বিচারের জন্য দ্বারস্থ হতে হয়। সেখানে যদি বার-বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব থাকে, অধস্তন আদালত বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্টদের দাস সুলভ আচারণ করে সেখানে কাঙ্খিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়া সূদূর পরাহত।

পেশাগত জীবনে এ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে অনেককে দেখেছি। দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে উচ্চকিত কণ্ঠে অভিন্ন সাহসী ধ্বনি উচ্চারিত হতে শুনেছি। অভিন্ন ভাষায় বলতে শুনেছি “বিচার বিভাগে কোন ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না।” এক কথায় জিরো টলারেন্সে আনার আহ্বান জানান তাঁরা।

সর্বশেষ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সুপ্রিম কোর্টে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, “দুর্নীতি বাংলাদেশে ক্যান্সারের মতো কাজ করছে। এটা শুধু বিচার বিভাগে নয়, সব জায়গাতেই আছে। সবাই উদ্যোগী হলে দুর্নীতি অপসারণ করা কোনো কঠিন কাজ হবে না। চেষ্টা করব সহকর্মীদের নিয়ে দুর্নীতি কিভাবে কমানো যায়।”

একটু না বললে নয়, জনাব ওবায়দুল হাসান শুধু একজন বিজ্ঞ আইনজ্ঞ নন, বিদগ্ধ কলাম লেখকও বটে। প্রসঙ্গটি লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল বছর কয়েক আগের কথা। তখন তিনি আপীল বিভাগে মান্যবার বিচারপতি। আজকে তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি। যোগ্য ব্যক্তি, যোগ্য আসনে আসীন হয়েছেন। ধন্য মনে করছে প্রিয় দেশবাসী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে দু’কিস্তিতে একটি কলাম লিখেছিলেন। অত্যন্ত সাবলীল এবং তথ্য সমৃদ্ধ ভাষায়। আমি অসংখ্য রিফারেন্স সাপেক্ষে তাঁর দু’কিস্তির কলাম’টির জবাব দিয়েছিলাম, ঢাকার আর একটি জাতীয় দৈনিকে আমার কাঁচা হাতের লেখা দিয়ে। আসলে কে সেই ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন? নামটি প্রিয় পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। আলোচ্য কলামে প্রসঙ্গত নয় বিধায় নামটি নাই বা বললাম।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান গণমাধ্যমকে দেয়া বক্তব্য এটাই জাতিকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, “দুর্নীতি বাংলাদেশে ক্যান্সারের মতো কাজ করছে। এটা শুধু বিচার বিভাগে নয়, সব জায়গাতেই।” তিনি স্পষ্ট করে না বললেও বিচার বিভাগ যে দুর্নীতি মুক্ত নয় সেটা তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন। তবে সব প্রধান বিচারপতিদের বক্তব্য অভিন্ন। অতীত রেকর্ড অনুযায়ী বিচারঙ্গনে একটি মহল রায় কেনাবেচা করছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তেল-পানি এক হলে শৃঙ্খলা থাকে না

কেন অধস্তন আদালতে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং স্বেচ্চাচারিতা? একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক ,দুর্নীতি এবং অনিয়মের উপসর্গটা কোথায়? উত্তর একটাই এসব অনিয়ম বন্ধে বিচার বিভাগে একক শাসন প্রয়োজন? এটাই প্রতিরোধের মোক্ষম উপায়?

১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের দায়িত্ব ছিল সুপ্রিম কোর্টের ওপর। অথচ ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া হয়, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৭৮ সালে ওই সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হলেও ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা বহাল থাকে।

১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেয়া আছে। ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানে ১১৬ অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে শব্দগুলো যোগ করা হলেও ওই ফরমান সর্বোচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হয়। এরপরও পঞ্চদশ সংশোধনীতে ওই ফরমানসহ চতুর্থ সংশোধনীর রাষ্ট্রপতির সেই ক্ষমতা রেখে দেয়া হয়েছে। এটি সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ওই অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এ ব্যাপারে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতিসংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদসহ কয়েকটি অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৩ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে রিটটি করা হয়। সংবিধানের সাথে সংঘর্ষিক নানা অনুচ্ছেদ বিধায় রিটের ওপর মূলতবী আদেশ দেয়া হয়।

বহু চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে ২০১৭ নামে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রকাশ করা হয়। এই গেজেটে বলা হয়, শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া, দ্বৈত শাসনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বের আশঙ্কা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে একক শাসন প্রয়োজন, বিতর্ক এড়াতে বিচারকদের জন্য আলাদা সচিবালয় দরকার,রাষ্ট্রপতির স্থানে আইন মন্ত্রণালয় প্রতিস্থাপিত হতে পারে না।

অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি প্রকাশের পর আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে একক শাসনের প্রয়োজন। ১৯৭২ সালের সংবিধানেই শুধু সুপ্রিম কোর্টের হাতে ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। একক শাসন না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে।”

তাঁরা বলেন, শৃঙ্খলাবিধিতে একক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। বিধিমালায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মৃত্যু ঘটেছে। তবে এ বিধিমালা সংবিধান অনুযায়ী করা হয়েছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।

তবে এ বিধি প্রকাশের পর আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন,এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মামলার বাদী মাসদার হোসেন। তিনি বলেছেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। একক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে বাহাত্তরের বিধান আর ফেরেনি।

জারি করা বিধিমালায় বলা হয়েছে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ‘নিয়োগকারী’ কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি এবং আইন মন্ত্রণালয়কে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসাবেও নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিধিমালায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকল না বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করা হলে এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক থাকবে না।

এই গেজেট মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী উল্লেখ করে তিনি বলেন, রায়ে বলা ছিল তেল এবং পানি একসঙ্গে মিলবে না। কিন্তু এই বিধিতে তেল এবং পানিকে একসঙ্গে মেলানো হয়েছে। সরকারও দেখবে আবার সুপ্রিম কোর্টও দেখবে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এর ফলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তিনি বলেন, ‘সংবিধান যে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করেছে সেই জায়গায় রাষ্ট্রপতির স্থানে আইন মন্ত্রণালয় প্রতিস্থাপিত হতে পারে না। রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আইন মন্ত্রণালয় পালন করতে পারে না। এই বিধিমালা করতে গিয়ে আইন মন্ত্রণালয় অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ করে ফেলেছেন।’

আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে এবং সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা,স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিচারিক আদালতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু এ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সে জায়গা থেকে সরে গেছে সরকার। এর মাধ্যমে বিচারিক আদালতের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে গেছে।’

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, “অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা আরও বেড়েছে। কিন্তু ‘না বুঝে’ অনেকেই এ বিধিমালার সমালোচনা করছেন।”

তিনি বলেন, “উচ্চ আদালতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আমার মনে হয়, এতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কোথাও ক্ষুণ্ণ করা হয়নি।” সূত্রঃ (দৈনিক যুগান্তর, মিজান মালিক ও আলমগীর হোসেন, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭)

উপেক্ষিত নীতিমালা অতঃপর স্বেচ্ছাচারিতা

বিখ্যাত দার্শনিক হবস ১৬৬১ সালে তাঁর প্রকাশিত Leviathan গ্রন্থে লিখেছেন (Thomas Hobbes 1588-1679) তাঁর মতে মানুষ যখন জঙ্গলে বসবাস করত তখন তার জীবনে No arts; no letters; no society; and whice is Worst off all, continual fear and danger of violent death; and the life of man.solitary,poor,nasty,brutish,and short. সমাজপূর্ব জীবনে মানুষের কোন আচারণবিধি বা মানদণ্ড ছিল না। আচারণবিধি মূলত একটি সভ্য সমাজের নির্দেশক।

Criminal Rules And 0rders (practice and procedure of subordinate courts) 2009 volume-(High court division) অধস্তন আদালতের বিচারকদের ১৭টি নীতিমালা অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ উঠছে অধিকাংশ অধস্তন আদালতের বিচারকগণ নীতিমালা অনুসরণ করেন না। জড়িয়ে যায় নানা অনিয়মে।

ফলে বার-বেঞ্চের সাথে একটা সংঘাত প্রায় লেগে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিচারপ্রার্থীরা। আইনজীবী ও বিচারক একে অন্যের পরিপূরক। এদের একের অন্যের প্রতি খারাপ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশমূলক ক্ষিপ্ত আচারণ এই দু’অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

State vs Mannan and others 44 DLR AD 173 (বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ও বিচারপতি লতিফুর রহমান)
প্রসঙ্গত অভিযোগ উঠেছে খুলনা সিনিঃ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ বিচারক তাকিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে । তিনি Code of conduct মানেন না। আইনজীবীদের সাথে সব সময় রূঢ় আচরণ করে থাকেন। মোটেই তিনি বিচারক সুলভ নন, এ অভিযোগ উঠেছে আইনপেশার সাথে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। তিনি ড্রেসকোডের ধার ধারেন না। রঙ্গের ড্রেস পরে প্রতিনিয়ত কোর্টে উঠেন।

হাইকোর্টের নির্ধারিত সময় মেনে চলেন না। সব আদালত সঠিক সময় উঠলে তিনি কোর্টে উঠেন ১১-৪৫ মি. কখনো ১১-৩০ মি.। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশনুযায়ী অধস্তন আদালতের সময়সূচি সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। দুপুর ১টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলেন তিনি এতই অনভিজ্ঞ যে, বেঞ্চ ক্লার্ক এর কথামতো সবকিছু করেন। অথচ বেঞ্চ ক্লার্ক একজন পরীক্ষিত ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। সূত্র: (আজাদবার্তা ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)

এ ধরনের অধস্তন আদালতে একজন অনভিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট-এর কারণে গোটা বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে পারে না। জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সর্বসাধারনের বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা দিনকে দিন ক্ষুন্ন হবে অনেকে শংকা করেন।

গোড়ায় গলদ দুর্নীতি রোধের উপায় কী?

“২০১১ সালে জেলা জজের ৫১টি পদ শূন্য হয়। এ জন্য পদোন্নতির প্যানেল তৈরি করতে ৬১ জন অতিরিক্ত জেলা জজের ডোসিয়ার (এসিআরের সংক্ষিপ্তসার) সুপ্রীম কোর্ট থেকে আনা হয়েছে। এদের সর্বশেষ ১০ বছরের ডোসিয়ার ‘পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের কাছে যেটা খটকা, সেটা হলো অনেক অতিরিক্ত জেলা জজের ডোসিয়ারে দুর্নীতি এবং অদক্ষতা সংক্রান্ত তথ্য ও মন্তব্য রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কেউ পদোন্নতি পেয়েছেন, কেউ পদোন্নতি পাননি।

এক বিচারকের পদোন্নতির গল্প বেশ রসাল। এই বিচারকের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের বর্ণনায় ‘অদক্ষতা, অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে’ বিভাগীয় মোকদ্দমা রুজু করতে সরকার ৪ জুলাই ২০১১ প্রস্তাব পাঠায়। সেই প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির সম্মতির কথা ১২৫১২-এ নম্বর স্মারকে ১১ জুলাই ২০১১ আইন মন্ত্রনালয়ে যায়। কিন্তু এরপর কী ঘটলো, তা আর ডোসিয়ারে নেই।

এখন আমাদের প্রশ্ন হলো ‘বিরূপ মন্তব্যের’ মানে কী। এর সজ্ঞা কী। এর রূপ কী। একে কী ধরা ছোঁয়া যায়? পদোন্নতির ‘সকল যোগ্যতা’র একটি তালিকা খুঁজেছি। কিন্তু পায়নি। এসিআর কীভাবে লেখা হচ্ছে, তার তদারকি ব্যবস্থা বেহাল।

বিধিতে বলা আছে, অধীনস্থদের সম্পর্কে অনুবেদনকালে এসিআর লেখক চারটি বিষয়ে যত্নবান হবেন। তিনি যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ট হবেন,যথাসম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করবেন,সুপষ্ট সরাসরি মন্তব্য করবেন, দ্ব্যর্থবোধক বা এড়িয়ে যাওয়া মন্তব্য করবেন না এবং অতিরঞ্জন ও অবমূল্যায়ন পরিহার করবেন।

একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্যে
(১) আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (Due process of Law),
(২) আইনের শাসন (Rule of Law),
(৩) আইনের বিধি বহির্ভূত কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা (Save in accordance with law),
(৪) শুনানির সুযোগ দান ব্যতীত দণ্ড দান না করা (Audi Alteram Partem),
(৫) কেউ নিজের বিচারক নিজে হতে পারে না (No person can be a judge of his own caus),
(৬) সার্বভৌম কোনো অন্যায় করতে পারে না (King Can do no wrong),
(৭) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আদালতের সহজাত এখতিয়ার (Inherent Jurisdiction),
(৮) ন্যায়পরতা ও বিচক্ষণতা (equity and expediency)
(৯) পুনরায় বিবেচনা (Review),
(১০) দায় অব্যাহতি বিধি (Immunity) অনুসরণ করা হয়।

দুই চোখে স্বপ্ন মেখে অধস্তন আদালতে বহু মেধাবী তরুণ ঢুকেছেন। তাঁরা হতোদ্যম হতে পারেন। তাঁদের কাছে এটা প্রতীয়মান হওয়া সমীচীন নয় যে দুর্নীতি বা অদক্ষতার অভিযোগে সরকারের কাছে আজ যাঁরা অভিযুক্ত হন, যাঁরা আজ অভিযুক্ত হন, সরকারের কাছে কাল তাঁরা রেহাই পান।….এসিআরে দুর্নীতি ও অদক্ষতার নানাবিধ অভিযোগ সত্ত্বেও বিচারকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া আগের মতোই চলমান রয়েছে”। (সূত্রঃ মিজানুর রহমান খান, ‘আইন আদালত সংবিধান’ পৃ. ১০০, প্রথমা প্রকাশন)

যে পেশায় হোক না কেন কোন জাতি দুর্নীতিবাজদের নিয়ে কাঙ্খিত স্বাধীনতার সুফলতা ভোগ করতে পারেন না। কাজেই বিচারকের রায়, বিচারকের আচরণ, আদালতের কার্যবিধি, আদালত পরিচালনাসহ বিচার পরিচালনায় সকল বিষয়েরই সমালোচনা করার অধিকার জনগণের আছে।

এখানে একটু না বললে নয়, যে বিচারক অনৈতিক কাজে লিপ্ত বা যে বিচারক প্রায়শঃই সঠিকভাবে তার দায়িত্বপালন করেন না তাঁর বিরুদ্ধে পূর্বে প্রনীত শৃঙ্খলা বিধির আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আদালতের প্রতি জনগনের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ন্যায় ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত হবে।

বিচারক হলো নববধূ

বিচারক হলো নববধূর মতো। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের কোন বন্ধু হয় না, তেমনি একজন বিচারকের কোন বন্ধু থাকে না। যতদিন নববধূ ঘোমটা ধরে রাখতে পারবে ততদিন তার সম্মান থাকবে। ঘোমটা খুলে গেলে মান মর্যাদা সবকিছু হারাবে। সবকিছু নির্ভর করে একজন ব্যক্তির আত্মমর্যাদার ওপর।

মনে পড়ে গেল রফিকুল ইসলাম পাটওয়ারীর কথা। বিভিন্ন জেলায় দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন তিনি খুলনা জেলা দায়রা জজ। কাঁচা হাতের একজন সাংবাদিক হিসেবে তাঁকে দেখেছি কাছে থেকে। মূলত তিনি ছিলেন কবি এবং বিচারক। “বিচারকের দায়িত্ব”এক কবিতায় তিনি লিখেছেন-

“….. শেষ বিচারকের সামনে যখন দাঁড়াতে হবে
প্রশ্ন করবে; কি বিচার করেছো দুনিয়াতে
হাতজোড় করে বলতে হবে; হে প্রভু
বিবেকের বাইরে বিচার করিনি;শান্তনা আমার।”

এই কথাটি সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই পবিত্র আঙ্গিনার সাথে যারা জড়িত আছেন তাদের সবাইকে। সবাইকে একদিন না একদিন কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে। এই ধরণীর বুকে। কাজেই হাম বড় মিয়া না সেজে স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতার মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর একটি ফুলের বাগিচা গড়ে উঠুক আমাদের বিচার আঙ্গিনায়;এই হোক প্রত্যাশা।

লেখক: আইনজীবী এবং সম্পাদক, আজাদ বার্তা।