উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে সুস্পষ্ট আইন করার জন্য সাংবিধানিক নির্দেশনা থাকলেও গত ৪০ বছরেও তা করা হয়নি। ১৯৭৮ সালে প্রথম আইন করার বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের পাশাপাশি সংসদ ও আইন কমিশন থেকে এ বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হয়। এরই জেরে ২০১৪ সালে প্রথম আইন তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে চার বছরেও আইনটির খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় আইন ছাড়াই ফের উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
সাবেক বিচারপতি ও আইনজ্ঞরা বলছেন, যোগ্যতর ব্যক্তিকে বাছাই করার স্বার্থে বিচারক নিয়োগে আইন করা জরুরি হলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই তা উপেক্ষা করেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও তাকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
অবশ্য এ নিয়ে এখনও কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, এ বছরের শেষ নাগাদ আইন পাওয়া যাবে। পরিস্থিতির কারণেই এখন উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ করা হচ্ছে। শিগগিরই এ নিয়োগ সম্পন্ন হবে।
সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে ১০ জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। তখন উচ্চ আদালতে বিচারপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৫ জনে। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ৮ জন এবং হাইকোর্টে ছিলেন ৯৭ জন বিচারপতি। এরপর গত তিন বছরে কোনো নিয়োগ না হওয়ায় বর্তমানে বিচারপতির সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৮৪ জনে- আপিল বিভাগে ৪ জন এবং হাইকোর্টে ৮০ জন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের পর উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়। আপিল বিভাগে ৪ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ১২ থেকে ১৫ জন বিচারপতি নিয়োগের একটি তালিকা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে। প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য যোগ্যতর ব্যক্তি বাছাইয়ের জন্য প্রধান বিচারপতির পরামর্শ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য দীর্ঘদিন থেকে আইনজ্ঞ ও সুশীল সমাজসহ নানা মহল থেকে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হচ্ছে। ২০১২ সালের ৩ জুলাই সংসদ ও ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট আইন কমিশন থেকেও বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের একাধিক রায়েও বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের জন্য কয়েক দফা নির্দেশনা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার।
সংবিধান যা বলছে
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগ বিষয়ে বলা আছে। ৯৫(১) অনুচ্ছেদ বলছে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কতৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন। ৯৫(২) অনুসারে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিম কোর্টে অনূন্য ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট না হয়ে থাকলে; বা বাংলাদেশের (খ) রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে; অথবা (গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে; তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
আইন কমিশনের সুপারিশ
আইন কমিশন ২০১২ সালের ৫ অগাস্ট ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদে নিয়োগের সাংবিধানিক শর্তাবলী ও আইনের দ্বারা নির্ধারিত শর্তাবলী বিষয়ে আইন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ প্রস্তুত করে। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়, সংবিধানে বিচারক নিয়োগে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্তাবলির উল্লেখ ছাড়াও আইনের দ্বারা শর্তাবলি নির্ধারণের (৯৫/২/গ) ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিগত ৪০ বছরে এই উপ-অনুচ্ছেদের অধীনে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আইন কমিশনের এই প্রতিবেদনে এ বিষয়ে ছয় দফা সুপারিশও তুলে ধরা হয়।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, ‘সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ (২) (খ)-এর অধীনে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য অধঃস্তন আদালতে চাকরির অভিজ্ঞতা ১০ বছর বিশেষভাবে বুঝতে ও গণনা করতে হবে। এই ১০ বছর পুরোটাই বিচারকাজে নিয়োজিত অবস্থায় থাকতে হবে। কোনো বিচার বিভাগীয় প্রশাসন যেমন, আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থায় কর্মের সময় গণনায় আনা যাবে না। ১০ বছরের মধ্যে অবশ্যই ন্যূনতম তিন বছর জেলা জজ বা সমপর্যায়ের বিচারক হিসেবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে’।
সংবিধানের ৯৫ (২) (ক) উল্লেখ করে দ্বিতীয় সুপারিশে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মকালের ১০ বছরও বিশেষভাবে বুঝতে ও পড়তে হবে। আদালতে ১০ বছরের জন্য নিছক অন্তর্ভুক্তি (এনরোলমেন্ট) যথেষ্ট বিবেচিত হবে না। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা সফলভাবে পরিচালনাসহ তাকে নিয়মিত সক্রিয়ভাবে আইন পেশা (প্র্যাকটিস) করতে হবে, যা প্রধান বিচারপতি ও তার সহবিচারপতিরা নির্ধারণ করবেন। এ ছাড়া অন্তত দুই বছর আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে’।
তৃতীয় সুপারিশে সংবিধানের ৯৫ (২) (ক) ও ৯৫ (২) (খ) উল্লেখ করে বলা হয়, ‘এর অধীন আইনজীবী ও বিচারক ছাড়াও ৯৫ (২) (গ) এর অধীন কোনো আইনজ্ঞ (যেমন আইনের অধ্যাপক বা আইনের গবেষক), যার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় রয়েছে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচিত হতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তার বয়সের নিম্ন সীমা হবে ৪৫ বছর’।
চতুর্থ সুপারিশে কমিশন বলেছে, ‘সুপ্রিম কোর্টে অধঃস্তন আদালত থেকে বিচারক নিয়োগের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন’।
সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে পঞ্চম সুপারিশে বলা হয়, ‘এর অধীন হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ী মেয়াদে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অস্থায়ী মেয়াদে কোনো বিচারকের আপিল বিভাগে আসন গ্রহণের বিধান বোধগম্য কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বিধায় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তা বিলুপ্ত করা প্রয়োজন’।
ষষ্ঠ সুপারিশে বলা হয়, ‘বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ‘পরামর্শ’ নিছক আভিধানিক অর্থে নয়, বরং তা সাংবিধানিক ও বিচার বিভাগীয় ধ্যান-ধারণায় বিশেষ অর্থে পড়তে ও বুঝতে হবে। যার ফলে ‘পরামর্শ’ হয়ে উঠতে পারে অর্থবহ ও কার্যকর। এ জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতির পরামর্শ চাওয়া এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শ প্রদান প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও লিখিতভাবে’।
বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন
স্বাধীনতার পর ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো বিচারপতি নিয়োগে গাইডলাইন দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অস্থায়ী দশ বিচারপতিকে বাদ দেওয়া সংক্রান্ত এক মামলায় ২০১০ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিচারপতি এমএম রুহুল আমীন, বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম (পরে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম (পরে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন ও বিচারপতি এম এ মতিন সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এক রায়ে বিচারপতি নিয়োগে একটি গাইডলাইন (নীতিমালা) দেন।
এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নেবেন এবং তারা পরস্পর চিঠিপত্রের মাধ্যমে বা টেবিলে বসে পরামর্শ করতে পারেন। তবে এই শলা-পরামর্শের প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে তাদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার রেকর্ড রাখতে হবে, যাতে বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিলে কোনো দ্ব্যর্থকতা ছাড়াই তা নিরসন করা যায়।’ এর পর আরও কয়েকটি রায়ে এ বিষয়ে নিদের্শনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সবশেষ গত বছরের ১৩ এপ্রিল বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত একটি রিটে সাত দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।
উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের ২০ আগস্ট জিয়াউর রহমান একটি সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধানে ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বিচারক নিয়োগে নীতিমালার বিধান আনেন। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।’ এরপর ৪০ বছর আইন প্রণয়নের এ বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। তবে ২০১২ সালের ৩ জুলাই জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু ‘সুপিরিয়র জুডিসিয়াল কমিশন বিল-২০১২’ নামের একটি বেসরকারি বিল সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখায় জমা দেন। এতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের পদসংখ্যা নির্ধারণ ও রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করতে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে সেটি সংসদে পাস হয়নি।