এজলাস (প্রতীকী ছবি)
এজলাস (প্রতীকী ছবি)

অভিযুক্তের ডিফেন্স বা ঘটনার ‘Hidden story’ আদালতের নজরে আনা প্রসঙ্গে কিছু কথা

রাজীব কুমার দেব :

যুক্তিতর্ক পর্ব চলছে… আমার মক্কেল ঘটনার সাথে জড়িত নয় কারণ সে ঘটনার সময় বিদেশে অবস্থান করছিল এই যে দেখা হোক তার পাসপোর্ট ভিসা কিংবা ঘটনাস্থলের মালিকানা ও দখল তার নামে-এই যে দেখা হোক তার মালিকানা কাগজ কিংবা ঘটনার আগেই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে – এই যে দেখা হোক তালাকনামা কিংবা প্রতারণার প্রশ্নে দাখিলীয় দলিলের দস্তখত তার নয় – এই যে দেখা হোক তার ব্যাংকের দস্তখত – যুক্তিতর্ক পর্যায়ে এইসব “Hidden story” বা ডিফেন্স তুলে ধরা আমাদের দেশে Criminal Justice অনুশীলনে একটি কমন চিত্র হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই “Hidden story” বা ডিফেন্সগুলো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সাক্ষ্যের উপর সন্দেহ তৈরি করার যথেষ্ট বাস্তব ও ফলপ্রসূ উপকরণ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য হতে পারত এবং যার বেনিফিট অভিযুক্ত ভোগ করতে পারত। আর যখন যুক্তিতর্ক পর্যায়ে এই “Hidden story” বা ডিফেন্সগুলো তুলে ধরা হয় তখন কিন্তু কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনে বর্ণিত অভিযুক্তের ডিফেন্স – প্রমাণ পদ্ধতি – অভিযুক্ত পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধানের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনি স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যুক্তিতর্ক পর্যায়ে এই “Hidden story” বা ডিফেন্সগুলোর প্রমাণ পদ্ধতির স্বরূপ কি হবে??? আর তাতে অভিযুক্তই বা কি বেনিফিট পাবে??? প্রশ্নগুলো কিন্তু অবান্তর মনে হচ্ছে না।

আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন এবং দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালত ফৌজদারী বিচার নিষ্পত্তিতে অভিযোগকারীর চেয়ে একজন অভিযুক্তের অবস্থান ও মর্যাদা বিষয়ে অধিকতর সতর্ক। একটি ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার, আটক, রিমান্ড, বিচার, শাস্তি বিষয়ে সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ এবং কার্যবিধির ৫৪, ১৬৭, ৩৫১ ধারা ও সিভিল আপীল নং ৫৩/২০০৪ এর সিদ্ধান্ত এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩, কার্যবিধির ২৪১ ধারার শর্ত মোতাবেক তার উপস্থিতি, দন্ড ব্যতিত অভিযুক্তকে “আসামী” হিসেবে ঘোষণা না করা ইত্যাদি অভিযুক্তের অবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত করে আইনি Protection এর ব্যবস্থা করেছে। আর Criminal Jurisprudence এর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যর শর্ত অনুসারে প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণে বিন্দু মাত্র সন্দেহ থাকলে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না – একজন অভিযুক্ত এই Benifit of Doubt principle এর হকদার। কার্যবিধি ৪২৬(ক)(খ) ধারা একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে আপীলের শর্তে জামিনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আবার দন্ডবিধি বাধ্যতামূলকভাবে অভিযুক্তের জন্য “General Exception” এর ব্যবস্থা করেছে। তাছাড়া কিছু বিশেষ আইন অভিযুক্তের উপরই “Burden of proof” আরোপ করে থাকে, যেমন – Foreigners Act, 1946, Narcotics Control Act, 2018। তদুপরি সংবিধান এবং সংশ্লিষ্ট আইন সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় দলিলের লিখিত সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি অভিযুক্তের আরো অনেক “Factual Defence” বা ঘটনার “Hidden story” আছে যেগুলো প্রমাণ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজ্ঞ বিচারিক আদালতের দৃষ্টিগোচরে এনে বিবেচনাযোগ্য করে তুলতে পারে। অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন ও সর্ব্বোচ্চ আদালত একজন অভিযুক্তের অবস্থান ও মর্যাদা বিষয়ে যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে ততটুকু দিয়েছে অভিযুক্তের “Factual Defence” বা ঘটনার “Hidden story” দিকে।

সাধারণত প্রসিকিউশন কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণাদি পর্যালোচনায় যদি প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনার পিছনে একটি “Hidden story” আছে অথবা ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট এমন কিছু দলিল বা কাগজাদি আছে যা প্রমাণিত হলে প্রসিকিউশন কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্যের উপর সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। আর ডিফেন্স এর দায়িত্ব হচ্ছে বিচারিক পর্যায়ে সেসব ডিফেন্স তুলে ধরা এবং আদালতের বিবেচনায় নেওয়ার জন্য সাক্ষ্য আইনে বর্ণিত প্রমাণ পদ্ধতি অনুসরণ করা। উল্লেখ্য মহামান্য উচ্চাদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত মতে factual defence যা প্রমাণ সাপেক্ষ সে সকল ডিফেন্স চার্জ প্রেমিং পর্যায়ে বিবেচনা না করে বিচারিক পর্যায়ে বিবেচনা করার নির্দেশনা রয়েছে।

এখন দেখা যাক কিভাবে বা কোন পর্যায়ে অভিযুক্ত তার Factual Defence” বা ঘটনার “Hidden story” কে আদালতের নজরে আনতে পারে। অভিযুক্ত পক্ষ দুই পর্যায়ে তার ডিফেন্সগুলোকে তুলে ধরতে পারে – (ক) প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীকে জেরার মাধ্যমে এবং (খ) অভিযুক্ত পরীক্ষা পর্বে।

ক) প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীকে জেরার মাধ্যমে- সাক্ষ্য আইনের ১৩৭ ধারার ক্ষমতা বলে ১৩৫ ধারার বিধি বিধান অনুসরণ করে এবং ১৩৮, ১৪০, ১৪১, ১৪৪, ১৪৬ ধারার সুবিধা সমূহ ব্যবহার করে ডিফেন্স পক্ষ প্রসিকিউশনের সাক্ষীকে জেরার মাধ্যমে তার “Factual Defence” বা ঘটনার “Hidden story” তুলে ধরতে পারে। যেমন –

আপনি কি জানেন একই ঘটনা নিয়ে বিজ্ঞ নারী ও শিশু মামলা আছে – আপনি কি জানেন উভয় পক্ষের মধ্যে অন্য ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা চলমান আছে – আপনি তো আরো কয়েকটি মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন অর্থাৎ সাক্ষী হওয়া আপনার পেশা অথবা আপনি তো কয়েকটি ফৌজদারি মামলার অভিযুক্ত অর্থাৎ আপনি “Habitual offender” – আপনি কি জানেন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ঘটনাস্থল নিয়ে দলিল আছে অথবা আপনি অন্য একটি মামলায় জবানবন্দিতে অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত সম্পর্কে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন – আপনি কি জানেন ঘটনার সময় অভিযুক্ত বিদেশে অবস্থান করছিল – আপনি তো ঘটনার সময় অন্য একটি মামলায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য বিজ্ঞ আদালতে হাজির ছিলেন??? এ প্রশ্নগুলোর উদ্দ্যেশ্য হ্যা সূচক জবাব পাওয়া নয় একটি ডিফেন্স বের করে আনা যা সে অভিযুক্ত পর্বে সাফাই সাক্ষী বা দলিল দাখিলের মাধ্যমে তার স্বপক্ষে প্রমাণ করতে পারে।

খ) অভিযুক্ত পরীক্ষা পর্বে – আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় একজন অভিযুক্ত কে সর্বপ্রথম তার “মুখ খোলার” বা “কথা বলার” সুযোগ দেয়া হয় অভিযুক্ত পরীক্ষা পর্বে যার আইনি অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় কার্যবিধির ৩৪২ ধারায়। এই পর্ব একজন অভিযুক্তকে তার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সাক্ষ্যের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ডিফেন্স আনার সুযোগ করে দেয় না ডিফেন্সের সমর্থণে সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন বা কাগজাদি দাখিল করে “Innocence of justice” প্রমাণের মাধ্যমে Doubt সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেয়। যেমন – প্রসিকিউশন পক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনায় যদি “Factual Defence” বা ঘটনার “Hidden story” এর আভাস/ অস্তিত্ব পাওয়া যায় তাহলে ডিফেন্স পক্ষ সাক্ষ্য আইনে বর্ণিত প্রমাণ পদ্ধতি অনুসরণ করে সাফাই সাক্ষী বা উক্ত দলিল দাখিলের মাধ্যমে তার “Factual Defence” বা ঘটনার “Hidden story” তুলে ধরে বিজ্ঞ আদালতের নজরে আনতে পারে। উল্লেখ্য সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এ প্রমাণ পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া আছে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের ফৌজদারি বিচার অনুশীলনে জেরা ও অভিযুক্ত পরীক্ষা পর্বে ডিফেন্সের সমর্থণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। উপরন্তু প্রায় সময় জেরায় এমন কিছু প্রশ্ন করা হয় যা দিয়ে সাক্ষী Gap fulfill করার সুযোগ পেয়ে যায়। আবার সাক্ষ্য আইনের ১৩৮, ১৪০, ১৪১, ১৪৪, ১৪৬ ধারায় যে সুবিধাগুলো দেওয়া আছে সেগুলো ব্যবহার করার চর্চাও নগণ্য। অভিযুক্ত পরীক্ষা পর্বে অভিযোগকারীকে কোন সাফাই সাক্ষী বা কোন দলিল উপস্থাপন করবে কিনা এই প্রশ্নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিবে না মর্মে জানায়। আরো পরিতাপের বিষয় হয় তখন যখন রায় ঘোষণার সময় প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণাদি পর্যালোচনায় দেখা যায় ডিফেন্স পক্ষের এমন কিছু “Factual Defence” বা “Hidden story” আছে যা সে অভিযুক্ত পরীক্ষার সময় প্রমাণ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজ্ঞ আদালতের গোচরীভূত করে নাই। এ অবস্থায় ঘটনার সমর্থণে “Factual Defence” বা “Hidden story” দৃশ্যত হলেও প্রমাণিত না হওয়ায় বিজ্ঞ আদালতের বিবেচনা করার সুযোগ থাকে না।

পরিশেষে রাষ্ট্রীয় আইন ও সর্ব্বোচ্চ আদালত যেখানে একজন অভিযুক্তের মর্যাদা ও অবস্থান নির্ধারণ পূর্বক সহনশীল আচরণ প্রকাশ করার নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে অভিযুক্তের “Factual Defence” বা “Hidden story” বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সঠিক সময়ে ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতের নজরে এনে Criminal Justice Administration এ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা যায়।

লেখক : জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, কক্সবাজার।