চন্দন কান্তি নাথ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা

দেওয়ানি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে ২০১২ সনের আইন সংশোধন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা 

চন্দন কান্তি নাথ:

বাংলাদেশে দেওয়ানি আদালতে লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে। সাধারণত সম্পত্তির উপর মালিকানা ও দখল এবং অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, মন্দির বা মসজিদের প্রার্থনা নামাজ পড়া, ভোটের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে দেওয়ানি মামলার উদ্ভব হয়। সেক্ষেত্রে অধিকার এর জন্যে চুক্তি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন, দলিল সংশোধন, চুক্তি রদ, দলিল বিলোপন, ঘোষণামূলক ডিক্রি, চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এর  জন্যে আদালতে দেওয়ানি সংক্রান্ত মামলা হয়। কিন্তু দেওয়ানি মামলা যুগ যুগ ধরে চলে। মানুষ দেওয়ানি মামলাতে বিলম্বের কারণে আইন আদালতের তেমন কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না।

অথচ আমাদের সংবিধানে সু বিচার নিশ্চিত করার কথা আছে। সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদেও  আছে- (১) আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।

আবার সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আছে – আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

অথচ দেওয়ানি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়াতে নাগরিকরা সম্পত্তি ধারণ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আইনের আশ্রয় লাভের কথা থাকলেও বিলম্ব হওয়াতে মানুষ অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। সে কারণে বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মাননীয় আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক দেওয়ানি আইনে কিছু সংশোধন এনেছেন এবং আইনে ইতিমধ্যেই দ্রুত নিষ্পত্তি এর জন্যে কিছু বিধান ছিল। দেওয়ানি আইনে ইতিমধ্যেই ছিল মামলায় যারা যারা পক্ষ কিংবা বিপক্ষে তাদের সবাই কে অবশ্যই মামলায় বাদী কিংবা বিবাদী করতে হবে এবং যে সকল বিষয় মামলাতে আছে তাও একসঙ্গে রাখতে হবে আইনে আছে। মামলা সঠিকভাবে দায়ের করা হলে, বিবাদীকে হাজির হয়ে দাবীর জবাব দেয়ার জন্য সমন দেয়া হয়।

আগের প্রক্রিয়ায় দেরী হত বিধায় উপরে উল্লেখিত মতে ২০১২ সনে সংশোধন এনে আদেশ ৫ এ বলা হয় সমন ৫ দিনের মধ্যে জারি করতে হবে, না হলে এটা জারি কর্মকর্তার misconduct হবে। courier service, fax massage কিংবা electronic mail, পত্রিকার মাধ্যমেও সমন পাঠানো যাবে বলে নতুন আইনে আছে। পরে আদালত সন্তুষ্ট হলে সমন জারি হয়েছে গন্য করা যাবে। অর্ডার ৯ রুল ৬ আছে, “Where the plaintiff appears and the defendant does not appear when the suit is called on for hearing, then−  if it is proved that the summons was duly served, the Court may proceed ex parte”

বিবাদী আদালতে হাজির হলে সংশোধন মতে ৩০ দিনে, বিশেষ কারণে সর্বোচ্চ ৬০ দিনে জবাব দাখিল করবেন | অর্ডার ৮ এ আছে, ‘… Provided further that if the defendant fails to file the written statement within the said period of sixty working days, the Court shall dispose of the suit ex parte.’

আবার লিখিত জবাব এর  পরে সংশোধন অনুসারে অবশ্যই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি এর ব্যবস্থা করতে হবে বলা হয়েছে। আগের ‘May’ এর পরিবর্তে ‘shall’ স্থাপন করা হয়েছে। তাতে আছে লিখিত বক্তব্য দাখিলের পরে, যদি প্রতিযোগী সমস্ত পক্ষ ব্যক্তিগতভাবে বা স্ব স্ব  পক্ষে আদালতে উপস্থিত থাকে, আদালত অবশ্যই শুনানি স্থগিত করে, মামলাটিতে বিরোধ বা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতা করবেন। অথবা মামলা-মোকদ্দমাতে বিরোধ বা বিরোধগুলি পক্ষদের নিযুক্ত প্রার্থীদের অথবা নিযুক্ত আইনজীবীদের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যে মামলা দিবেন। অথবা  মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণের জেলা জজ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্যানেল থেকে Mediator কে মামলা টি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে দিবেন।

আপিল ও একই রূপে dispute নিষ্পত্তি করা যাবে। সালিশ আইন ২০০১ অনুসারেও পক্ষরা dispute নিষ্পত্তি করতে পারেন। এমনকি ইতিমধ্যে যে মামলা ২০১২ এর আগে আপিল এ pending আছে তাও উপরোক্ত বিধান মোতাবেক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধান মতে নিষ্পত্তি করা যাবে। ব্যর্থ হলে পুনরায় আগের পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি করা যাবে। আবার মামলায় লিখিত জবাব দাখিল কিংবা আর্জি দাখিল হলে বিচার্য বিষয় (isuue) ঘটন করতে হয়। কোন ঘটনার বা আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি (material Proposition) একপক্ষ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে এবং অপরপক্ষে অস্বীকার করে, তখনই বিচার্য বিষয়ের উদ্ভব হয়। বিচার্য বিষয় দুই প্রকারের- ক) তথ্যগত বিচার্য বিষয়, খ) আইনগত বিচার্য বিষয় এবং এটি অবশ্যই জবাব দাখিল এর পর (যেটি পরে) অথবা first hearing এর পর ১৫ দিনের দিনের মধ্যে ঘটন করতে হবে। (Provided that in any case the issues shall be framed and recorded, subject to the provisions of rules 4 and 5, within fifteen days from the date of first hearing of the suit or the date of filing of the written statement, whichever is later.)

বিচার্য বিষয় প্রণয়নের তারিখ হতে দশ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে প্রশ্নমালা প্রদান করতে পারবেন এবং শপথনামার (by affidavit) দ্বারা ১০ দিনের ভিতর প্রশ্নমালার উত্তর দাখিল করতে হবে। আর অর্ডার ১৪ রুল ৮ মোতাবেক ১২০ দিনের final hearing এর জন্যে আদালত তারিখ দিবেন। আবার আদালত অর্ডার ১৮ রুল ১৯ মোতাবেক ১২০ দিনের মধ্যে মামলার শুনানি শেষ করবেন।

আবার বিচার শুরু হলে সংশোধন দরখাস্ত দিয়ে অনেক সময়ই নষ্ট হয় তাই নতুন সংশোধনে বলা হয়, ‘no application for amendment shall be allowed after the trial has commenced, unless the Court is of opinion that in spite of due diligence, the party could not have raised the matter before the commencement of trial:

Provided further that if an application for amendment is made after the trial has commenced and the Court is of opinion that the application is made to delay the proceedings, the Court shall make an order for the payment to the objector such cost by way of compensation as if thinks fit.’

এটা ছাড়াও অর্ডার ১৭ তে বলা হয়, পক্ষরা মূলতবি চাইলে কস্ট দেওয়া যাবে। শুনানি শুরু হলে further hearing  লাগাতার হবে বলা আছে যতক্ষণ সাক্ষী শেষ না হয় (the hearing of the suit shall be continued from day to day until all the witnesses in attendance have been examined) এবং peremptory hearing এর পূর্বে পক্ষদেরকে উপযুক্ত কারণ না দেখালে ৬ (ছয়) বারের অধিক সময় দেয়া যাবে না (the Court shall not grant more than six adjournments in a suit before peremptory hearing at the instance of either party to the suit) এবং একটি পক্ষ কে কস্ট দিলেও ৩ (তিন) বারের অধিক সময় দেয়া হবে না (Provided that the Court shall not grant more than three  adjournments to a party even with cost under this rule)। আবার peremptory hearing এর সময় ও একটি পক্ষ কে  কস্ট দিলেও ৩ (তিন) বারের অধিক সময় দেয়া হবে না আছে। উভয় পক্ষ দরখাস্ত দিলে কস্ট রাষ্ট্র পাবে (the Court shall direct each party to pay such cost as revenue to the state.)। যেখানে কস্ট এর কথা আছে সেখানে কস্ট না দিলে কিংবা অন্য ক্ষেত্রে expartee decree অথবা মামলা খারিজ করার বিধান আছে। এমনকি আদালত নিজেও কারণ ছাড়া মামলা মুলতুবি করতে পারবেন না (The Court shall not, of its own, order any adjournment under this rule without recording reasons therefor.)

আবার মামলা দ্রুত করার জন্যে আদালত যথেষ্ট যুক্তি থাকলে কোনো সাক্ষী বা কাগজ পত্র এর তথ্য বা তথ্য সমূহ শপথনামা (affidavit) দ্বারা প্রমাণ করার সুযোগ দিতে পারবেন বলে অর্ডার ১৯ এ লেখা আছে। তবে কোনও পক্ষ সরল বিশ্বাসে (bonafide) কামনা করলে আদালত সাক্ষী কে হাজির করে জেরা করার অনুমতি অবশ্যই দিবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আদালতের নিকট এর প্রয়োজন প্রতীয়মান হতে হবে। উক্ত আইনে আছে –

“Provided that where it appears to the Court that either party bona fide desires the production of a witness for crossexamination, and that such witness can be produced, and order shall not be made authorizing the evidence of such witness to be given by affidavit.”  উপরোক্ত লাইন এ

‘where it appears to the Court’ অংশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের নিকট প্রয়োজনীয় মনে না হলে সাক্ষী আদালতে হাজির করবেন না। আমরা জানি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিভিল মামলায় কাগজ পত্র খুবই প্রাসঙ্গিক। কাগজপত্রের সাথে সাক্ষীর affidavit জবানবন্দি দিয়ে অধিকাংশ দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। আদালত দরকার হলে উক্ত affidavit এর সাক্ষী কে জেরার জন্যে ডাকতে পারেন। এতে ও আদালতের অনেক সময় কমে যাবে।

আবার আদালত সাক্ষী কে আদালতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে অব্যাহতি দিতে পারেন।|উক্ত আদেশে আছে, “Such attendance shall be in Court, unless the deponent is exempted from personal appearance in Court, or the Court otherwise directs.” উক্ত রুল এ ‘or the Court otherwise directs’ শব্দ গুলো বর্তমানে ডিজিটাল যুগে গুরুত্বপূর্ণ কেনো না সাক্ষী কে আদালত ডিজিটাল মাধ্যমেও হাজির করা যাবে।|

আবার আমরা জানি মামলাতে পক্ষরা হাজির হলে ইস্যু ঘটন এর পর বা যেকোনো সময় আদালত নিষ্পত্তির স্বার্থে কোনো কাগজ আদালতে জমা দিতে, কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে, কোনো কাগজ বা তথ্য স্বীকার করতে (the admission of documents and facts), প্রয়োজনে কোনো সাক্ষী কে হাজির করতে, অথবা কোনো তথ্য affidavit দিয়ে প্রমাণ করতে যেকোন পক্ষ কে নির্দেশ দিতে পারেন।

সে প্রসঙ্গে ৩০ ধারায় আছে, “Subject to such conditions and limitations as may be prescribed, the Court may, at any time, either of its own motion or on the application of any party,-

  • make such orders as may be necessary or reasonable in all matters relating to the delivery and answering of interrogatories, the admission of documents and facts, and the discovery, inspection, production, impounding and return of documents or other material objects producible as evidence;
  • issue summonses to persons whose attendance is required either to give evidence or to produce documents or such other objects as aforesaid;
  • order any fact to be proved by affidavit”

আবার যার প্রতি ৩০ ধারা অনুসারে সমন দেয়া হয়েছে, আদালত তাকে হাজির হতে বাধ্য করতে পারেন এবং এই উদ্দেশ্যে-

ক) গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করতে পারেন;

খ) তার সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রয় করতে পারেন;

গ) তাকে অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানা করতে পারেন;

ঘ) তার হাজিরার জন্য তাকে জামানত দেয়ার আদেশ দিতে পারেন; এবং জামানত না দিলে তাকে দেওয়ানী কারাগারে প্রেরণ করতে পারেন।

ধারা ৩৩ ও আদেশ ২০ মোতাবেক মামলার শুনানি হওয়ার পর আদালত রায় ঘোষণা করবে এবং এরূপ রায়ের ভিত্তিতে ডিক্রি প্রণীত হবে। আবার অর্ডার ২০ রুল ৫ অ (5 A) মোতাবেক Judgment ঘোষণার ৭ (সাত) দিনের মধ্যেই decree প্রস্তুত করতে হবে। আবার কেউ অনর্থক মামলা আনলে বা contest করলে এবং তা দীর্ঘদিন চলার পর কেউ খরচ এর সম্মুখীন হলে  আদালত ৩৫ ধারা অনুসারে কোনো পক্ষ কে খরচ প্রধানের আদেশ প্রদান করতে পারে এবং মামলার খরচের উপর অনধিক শতকরা বার্ষিক ছয় টাকা হারে সুদ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন এবং ইহা খরচের ন্যায় আদায়যোগ্য হবে। কাকে বা কোন সম্পত্তি হতে কি পরিমাণ খরচ প্রদান করতে হবে, তা নির্ধারণ করার এবং উপরে বর্ণিত মতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করার পূর্ণ ক্ষমতা আদালতের থাকবে।

উপরের কার্যক্রম  ছাড়া ও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, স্থানীয় পরিদর্শন, স্থানীয় তদন্ত, receiver নিয়োগ, রায়ের পূর্বে গ্রেফতার এবং ক্রুক  এর আদেশ আদালত দেয় বা দিতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রেও উক্ত দরখাস্ত গুলো ও দ্রুত নিষ্পত্তি করার বিভিন্ন বিধান আইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।

আইন অনুসারে mediation, arbitration হলে, দ্রুত সমন জারি ও জবাব দাখিল হলে, Amendment petition সংশোধন হলে, ইস্যু ঘটন দ্রুত হলে, affidavit সংক্রান্ত বিধান ও ৩০, ৩৫ ধারার বিধান প্রয়োগ হলে, শুনানি সংক্রান্ত অর্ডার ১৭ এর বিধান এর সঠিক প্রয়োগ হলে, ৮৯ ধারার বিধান মোতাবেক mediator প্যানেল হলে এবং তারা সঠিক ভাবে কাজ করলে, বিচারক, আইনজীবী আদালতের কর্মচারীরা তাদের দায়িত্ব পালন করলে এবং সর্বোপরি বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ কিংবা তিন গুন করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত আলাদা হলে সংশোধন অনুসারে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। মানুষ দেওয়ানি মামলায় বিচার পাবে।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।