এস এম শরিয়ত উল্লাহ্‌: সিনিয়র সহকারী জজ; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পাবনা
এস এম শরিয়ত উল্লাহ্‌: সিনিয়র সহকারী জজ; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পাবনা

এসপি’র স্পর্ধা!

এস এম শরিয়ত উল্লাহ্‌: কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভার নির্বাচনের দায়িত্ব পালনরত বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাত। বিষয়টি সর্বত্র ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং সমালোচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আদালত অবমাননার রুল জারি করে এসপি তানভীর আরাফাতকে তলব করেছেন। কতটা বেপরোয়া হলে পুলিশ বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এমন ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন?

প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্বপালন রত বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: মহসিন হোসেন গত ১৬ জানুয়ারি দায়িত্বপালন অবস্থায় সকাল ১০টায় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অবস্থানকালে জনৈক ভোটারের অভিযোগের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন। সেখানে কতিপয় ব্যক্তিকে ভোটকেন্দ্রের বুথের ভেতর লম্বা বেঞ্চে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে বসে আছেন দেখে তিনি তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বলেন। তারা পরিচয়পত্র না দেখিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষরিত এ-ফোর সাইজের কাগজ দেখান। তখন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসারকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বুথের বাইরে ডাকেন। কথা বলা শুরু করতেই ওই ভোটকেন্দ্রে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত ৪০-৫০ জন ফোর্সসহ প্রবেশ করেন। তিনি প্রবেশ করেই প্রিসাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিসাইডিং অফিসারকে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন। নিজের পরিচয় দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে কথা শেষ হলে উনাকে নিয়ে যেতে বলেন। এরপরও এএসপি মোস্তাফিজুর রহমান ধমক দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে তার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে অগ্রসর হন এবং জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কে? কী করেন এখানে?” পরিচয় শুনে তিনি আরও ক্ষিপ্তস্বরে বলেন, “আপনি এখানে কী করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান এখান থেকে।”

পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমণাত্মক চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখী আচরণে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর এসপিসহ তার সঙ্গী ফোর্সরা চলে যাওয়ার সময় তাকে উদ্দেশ্য করে একাধিকবার বলেন, “এসব লোককে পাঠায় কে? বেয়াদব ছেলে। এখানে কাজ কী আপনার? বের হয়ে যান এখান থেকে।”

পুলিশ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্য বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট এবং আদালতকে সর্বাবস্থায় সম্মান জানাবেন। এটা কোন শিষ্টাচার নয়, আইনগত বাধ্যবাধকতা। কুষ্টিয়ার এসপি সর্ব প্রথমেই এই আইনগত বাধ্যবাধকতার ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। এরপর তিনি দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কথা বলা অবস্থায় প্রিসাইডিং অফিসারকে চিৎকার করে ডাকাডাকি করেছেন, তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন যা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে বাধা প্রদানের সামিল এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি তিনি চলে যাওয়ার সময় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে সবার সামনে “বেয়াদব” বলে উল্লেখ করেছেন, যেটা সুস্পষ্টভাবে আদালত অবমাননা। এগুলো ছিল পুলিশ আইন ও প্রবিধান, আদালত অবমাননা আইন এবং দণ্ডবিধির অধীনে পুলিশ সুপারের কিছু অপরাধ।

শুধু এসব আইন নয়, এসপি এস এম তানভীর আরাফাত নির্বাচনী আইনও ভঙ্গ করেছেন। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কেন্দ্রের আশেপাশে যেকোন প্রকার অস্ত্র বহন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, তিনি ৩০-৪০ জন সশস্ত্র পুলিশসহ নির্বাচন কেন্দ্রে প্রবেশ করেছেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ এর সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ভোটার ছাড়া শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনরত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশ করার অধিকার রাখেন। কোন পুলিশ সদস্যের সেখানে যাওয়ার কোন প্রকার সুযোগ নেই। এটা তাদের কাজও না। সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার কি প্রয়োজনে এবং কোন এখতিয়ার বলে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন? তিনি ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট কে জিজ্ঞেস করছেন “আপনি এখানে কি করছেন”!

কুষ্টিয়ার ঘটনার দায় নিশ্চয়ই পুরো পুলিশ বাহিনী নয় বরং সংশ্লিষ্ট পুলিশ তথা এসপির। তিনি ইতিপূর্বে আরো বিতর্কিত কাজ করেছেন। বর্তমান পুলিশ প্রশাসন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনসেবা নিশ্চিতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে যা সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু, এর মাঝেও কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতের মত সদস্যের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা আশা করব পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেই তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে।

এস এম শরিয়ত উল্লাহ্‌: সিনিয়র সহকারী জজ; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পাবনা