অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ
অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ

ডেপুটি কমিশনার বনাম জেলা প্রশাসক

ফারুক আহমেদ: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ অন্যদিকে সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার সহিত সংযুক্ত কর্মচারিরা হলেন ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি’ (Public Servant)।

সুতরাং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি বা Public Servant প্রজাতন্ত্রের জনগণের সেবক এবং তারা কখনো প্রজাতন্ত্রের জনগণ তথা ‘মালিকের’ প্রশাসক বা ‘Administrator’ হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।

বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইউনিটে ‘জেলা’ বা ‘District’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট এবং একটি জেলার প্রশাসনিক সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকা পদ-পদবি হচ্ছে ‘ডেপুটি কমিশনার (Deputy Commissioner)’। এই ডেপুটি কমিশনার পদের নাম বহুদিন যাবৎ ধরে বাংলায় ‘জেলা প্রশাসক’ লিখিত ও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আমি জানি না কে ডেপুটি কমিশনারের পদের নাম বাংলায় কিভাবে জেলা প্রশাসক হিসেবে প্রচলন করেছিলেন? The general clauses Act, 1897 এর ৩(১৩) ধারামতে “Commissioner ‘shall’ mean the chief officer-in-charge of the Revenue administration of a division” ইংরেজি টু বাংলা অভিধান মতে ‘Deputy Commissioner’ এর অর্থ হল- ‘ডেপুটি কমিশনার’ উপ-কমিশনার, উপ মহাধ্যক্ষ, উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন সরকারি প্রতিনিধি, কোন কার্য-সম্পাদনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

অপরদিকে ‘প্রশাসকের’ ইংরেজি শব্দ হল ‘Administrator’। ফলে Deputy Commissioner বা ডেপুটি কমিশনার পদটি “জেলা প্রশাসক” হিসেবে লিখিতক্রমে ব্যবহৃত হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। বরং বাংলায় এই পদ “জেলা উপ-কমিশনার (District Deputy Commissioner)” হিসেবে লিখিত ও ব্যবহৃত হওয়া উচিত।

যেমন- দেশের একটি বৃহৎ প্রশাসনিক ইউনিট বিভাগের প্রধান পদবির পদ “Divisional Commissioner” যা বাংলায়ও বিভাগীয় কমিশনার লিখা হচ্ছে। অনুরূপভাবে ‘Assistant Commissioner’ বাংলায় ‘সহকারি কমিশনার’ হিসেবে লিখা হচ্ছে।

আমার জানামতে দেশের অন্যান্য বিভাগে কর্মরত ‘Commissioner’ পদধারী পদগুলি ও ইংরেজিতে ‘Commissioner’ এবং বাংলায় ‘কমিশনার’ হিসেবেই লিখিত এবং ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

যেমন- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন ‘Commissioner, Asstt. Commissioner, Joint Commissioner, Deputy Commissioner, Asstt. Commissioner (Custom, Excise and Vat)’| Chief Election Commissioner, Election Commissioner বাংলায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ ও ‘নির্বাচন কমিশনার’ Income Tax Commissioner বাংলায় ‘কর কমিশনার’, মেট্রোপলিটন সিটিতে Asstt. Police Commissioner, Police Commissioner বাংলায় ‘সহকারি পুলিশ কমিশনার’ এবং পুলিশ কমিশনার ইত্যাদি লেখা হয়ে আসছে।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি বা সেবক (Public Servant of the Republic) কোনভাবেই প্রজাতন্ত্রের মূল মালিক তথা জনগণের ‘প্রশাসক’ বা ‘Administration’ হওয়া কাম্য নয়। অপরদিকে কোন পদ-পদবির জন্য ব্যবহৃত বা শব্দগুচ্ছের অর্থ ব্যঞ্জন-অভিব্যক্তি ঐ সরকারি পদ-পদবি ব্যক্তির আচার-আচরণ, ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাবের উপর দারুণভাবে প্রভাব পড়ে।

ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐ ‘প্রশাসক’ বা ‘Administration’ সরকারি পদধারী ব্যক্তি “জনসেবকের” ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে ‘প্রশাসকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং অনুরূপ মনোভাব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়াই স্বীয় সরকারি দায়-দায়িত্ব কর্তব্য নিষ্পন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন।

এমতাবস্থায়, রাষ্ট্রের বা সরকারের প্রাত্যহিক কার্য সম্পন্নের ক্ষেত্রে (to perform the official duty) ঐ সরকারি পদধারী ব্যক্তিগণ কর্তৃক কোন কোন ক্ষেত্রে abuse of power or colorable exercise of official or act without jurisdiction মূলক ইত্যাদি কার্য সংঘটিত হয় এবং উক্ত কার্যের ফলে জনগণ বিভিন্নভাবে হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন হন। আমাদের দেশে বাস্তবে এমন চিত্র অহরহ দেখা যাচ্ছে।

আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র বা Bureaucracy ব্রিটিশ হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ব্রিটিশরা এই দেশে জনগণের সেবা করার জন্য আসে নাই, বরং এই দেশের জনগণকে শাসন বা শোষণ করার জন্যই এসেছিল এবং বাস্তবে তারা এই দেশের জনগণকে বিভিন্নভাবে অপশাসন এবং শোষণ করিয়াছিল এবং এই অর্থেই তাহারা এই দেশের আমলাতন্ত্র বা Bureaucracy গঠন করেছিল।

আর আমরা আজ পর্যন্ত এই ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট এই দেশীয় আমলাতন্ত্রকে জনসেবামূলক করতে পারি নাই। আর এই কারণেই আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের একজন নবীন সদস্য (A Novice/Apprentice) চাকুরি জীবনে প্রথম প্রবেশ করেই মনে করেন “I am the lord and all are my subjects.”

এই যে, আমলাতন্ত্রের প্রাথমিক সদস্যের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি তা তার দৈনন্দিন অফিসিয়াল কার্যে দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঐ সরকারি কর্মকর্তা জনগণের একজন সেবক তা তিনি বেমালুমভাবে ভুলে যান এবং কোন কোন সময় এখতিয়ার বর্হিভূতভাবে misuse of power বা colorable exercise of official power এর মত কার্যে জড়িয়ে পড়েন।

এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে যে, কিছুদিন পূর্বে রংপুরের একজন ডেপুটি কমিশনারের দুর্নীতির খবর পত্রিকায় প্রচার করায় উক্ত ডেপুটি কমিশনার ও তার অন্যান্য অধীনস্থ সরকারি কর্মকর্তারা উক্ত সাংবাদিককে শারীরিকভাবে হেনস্থা করতঃ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাকে সাজা প্রদান করে জেলে প্রেরণ।

একজন সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক লকডাউন অমান্যের কারণে এক কৃষককে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠ-বস করার মত বেআইনি সাজা প্রদান, টিবিসি’র খাদ্য সামগ্রী বিক্রয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে একজন বিজ্ঞ আইনজীবী প্রতিবাদ করায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মোড়কে ঐ আইনজীবিকে সাজা প্রদান করে জেলে প্রেরণ।

কোন জেলা জজ আদালতের দুই কর্মচারি আদালতের সকল কর্মচারিদের বেতন ভাতা নিয়া রিক্সাযোগে নিজ আদালতে যাওয়ার অর্থাৎ সরকারি দায়িত্ব (Public Duty) পালনকালে অপর একজন সরকারি দায়িত্বপালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট, মোবাইল কোর্টের ক্ষমতাবলে উক্ত দুই কর্মচারিকে বেআইনিভাবে অর্থদন্ড প্রদান করা।

এছাড়াও জনৈক সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিজ কার্যালয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে একজন বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী অর্থদন্ড প্রদান করা ইত্যাদি।

এই misuse of power কেবলমাত্র সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এমনটা নয়। আমরা অহরহ রাষ্ট্রের অন্যান্য কেডারের সদস্যদের মধ্যে কম বেশ দেখিতে পাই। কোন কোন সময় আমলাতন্ত্রের এক বিভাগ কর্তৃক অন্য বিভাগের প্রতিও misuse of official power এর ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি।

সরকারি আমলারা জনগণের সেবা (to serve the public) এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়াই তাহাদের দৈনন্দিন সরকারি কার্য (Public Duty) সম্পাদন করলে দেশে Rule of Law প্রতিষ্ঠিত হবে এবং রাষ্ট্রে বা সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্চিত কোন উদ্ভট ঘটনার সৃষ্টি হবে না।

ফলে ডেপুটি কমিশনার (Deputy Commissioner) বা সরকারি অন্য কোন পদের শেষে “Commissioner” যুক্ত পদের কমিশনার বা ‘Commissioner’ শব্দের বাংলায় ‘প্রশাসক’ ‘Administrator’ লেখার বা ব্যবহৃত হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এই ব্যাপারে সদাশয় সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কাম্য।

ফারুক আহমেদ: সিনিয়র এডভোকেট; জজ কোর্ট, হবিগঞ্জ