বঙ্গবন্ধুর দর্শন: সংবিধানের প্রস্তাবনা, সামরিক ফরমান ও সুপ্রিম কোর্ট

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম :
৭ মার্চ ১৯৭১। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান, সময়ের পরিক্রমায় আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। লাখ লাখ জনতার উপস্থিতিতে জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও দিকনির্দেশনার জন্য অধীর আগ্রহ ও প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় উত্তাল এই জনসমুদ্র। লাখ লাখ জনতার সামনে এলেন বঙ্গবন্ধু, বজ্রকণ্ঠে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, ‘…এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের দর্শনই ছিল শত শত বছর ধরে পূর্ব বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত মানুষকে সব ধরনের শাসন ও শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্ত করা। এ মুক্তি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো ভৌগোলিক স্বাধীনতা। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তি আর সে লক্ষ্যেই ভৌগোলিক স্বাধীনতা।

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরীহ-নিরস্ত্র-নিরপরাধ ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু করে। লাখ লাখ মানুষের জীবনদান, মা-বোনদের সম্ভ্রম বিসর্জন, কোটি কোটি মানুষের গৃহহারা ও বাস্তুচ্যুতি, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হলো আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতাসংগ্রামের বিজয়—‘বাংলাদেশ’।
দ্রুততম সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, যা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, চিন্তা ও লক্ষ্য, যা ৭ মার্চের ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় তারই প্রতিফলন ঘটে।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিবৃত হলো:

‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।

‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন এবং সংবিধানের প্রস্তাবনা আমরা যদি একত্রে পর্যালোচনা করি, তাহলে অতি সহজেই প্রতীয়মান হবে যে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের সব স্বপ্ন, দর্শন ও অঙ্গীকার জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং এর আলোকে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহে। প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে স্বীকৃত হয়েছে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’।

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও আত্মনিয়োগকারী বীর শহীদদের স্মরণ করে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগুলো।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ঘাতক চক্র এবং তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক-কুশীলবেরা দেশের মানুষকে এ রকম একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, দেশকে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আসল কারণ কি তা-ই ছিল? যদি তা-ই হবে, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুহূর্ত থেকেই কেন একে একে সামরিক ফরমান জারি করে লাখ লাখ শহীদের রক্তের আখরে লেখা সংবিধানকে কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন পড়ল? আর হত্যার সঙ্গে তথাকথিত সংশোধনের সম্পর্ক-যোগসূত্র বা মূল উদ্দেশ্য তাহলে কী ছিল?

সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ শব্দগুলো বদলে প্রতিস্থাপন করা হয় ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের’। একইভাবে প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বিবৃত মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া হয়।
সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বাংলাদেশের নাগরিকেরা ‘বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন’ স্থলে ‘বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’ করা হয়। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ ছিল, তা পাল্টে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া হয়।

সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি’—এই বাক্যগুলো বিলুপ্ত করা হয়।

প্রাসঙ্গিক হবে যে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির আলোকে প্রণীত সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক সমিতি বা সংঘ গঠন করা বা তার সদস্য হওয়া বা অন্য কোনো তৎপরতায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধের বিধানটি বিলুপ্ত করা হয়।
‘জাতীয় মুক্তির’ স্থলে ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ এবং ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ স্থলে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’—কিন্তু কেন? গূঢ় রহস্যটাই-বা কী ছিল?

আরও নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করলেই সহজে প্রতীয়মান হয় যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মাত্র গুটিকয় বাক্য ও শব্দ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘাতক চক্র ও তাদের কুশীলবরা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সুপরিকল্পিতভাবেই আমাদের সংবিধান তথা রাষ্ট্রের চরিত্রকেই পাল্টে আবারও পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল।
৭ মার্চ বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামের। সামরিক ফরমান দিয়ে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙালির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্য-আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করে দিগ্‌ভ্রষ্ট করার চেষ্টা করা হলো। ঘাতকেরা কি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এটিই চেয়েছিল যে বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রয়োজন নেই। তারা আবারও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কিংবা অন্য কোনো পরাশক্তির দাসত্ব করবে—শৃঙ্খলিত হবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে।

বাঙালি দুই শ বছর ব্রিটিশবিরোধী, ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছিল। ঐতিহাসিক দীর্ঘ সেই ‘সংগ্রাম’কে শুধু ‘৯ মাসের যুদ্ধে’ সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) ভাষাশহীদদের মহান বীরোচিত আত্মত্যাগ, বাঙালির চেতনা জাগরণে-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিচর্চা ও বিকাশের আন্দোলন, ধর্মান্ধতার জাল ছিন্ন করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ও লালন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-শেখ মুজিবের বিজয়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা-স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান-ছাত্র-জনতার প্রাণ বিসর্জন, ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয়, একাত্তরের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন, একাত্তরে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, সর্বোপরি সাড়ে সাত কোটি মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাঙালির আত্মপরিচয়ে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টি—সবকিছুই আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের অংশ।

৪ নভেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশ গণপরিষদে ‘সংবিধান বিলের’ ওপর আলোচনা করতে গিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রাম সম্পর্কে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম কেবল ৯ মাসই হয় নাই—স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের পর থেকে। এরপর ধাপে ধাপে সে সংগ্রাম এগিয়ে গেছে। সে সংগ্রামের একটি ইতিহাস আছে। তাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হয়। একদিনে সে সংগ্রাম চরম পর্যায়ে পৌঁছে নাই।’

কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক সেই দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষাকে অস্বীকার করে অপচেষ্টা হয় শুধু ৯ মাসের একটি যুদ্ধে আবদ্ধ করার। শুধু ৯ মাসের যুদ্ধেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি—এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করার হীন চেষ্টা চলে! মূলত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রামেরই একটি অধ্যায় মাত্র।

অথচ প্রথমে সামরিক ফরমান জারি করে সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনা ও লক্ষ্যগুলো ক্ষতবিক্ষত করা হয়। পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে সংবিধানের তথাকথিত পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ওই সামরিক ফরমানগুলোর সাংবিধানিক ও আইনি পোশাক দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কী অদ্ভুত প্রতারণা সংবিধান, রাষ্ট্র ও দেশের মালিক জনগণের সঙ্গে!

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং বিচারপতিরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ওই সামরিক শাসন ও সামরিক ফরমানের ‘প্রভাব’ ও ‘ঘোর’ থেকে বের হতে পারেননি। উপরন্তু দেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম নিজ শপথের কথা ভুলে গিয়ে তথাকথিত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ও বিচারকদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ ও ভূলুণ্ঠিত করেছিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে।

দীর্ঘদিন পর হলেও ২০০৫ সালে ২৯ আগস্ট বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগ ‘বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লি. বনাম বাংলাদেশ সরকার’ মামলায় সংবিধানের তথাকথিত পঞ্চম সংশোধনী, অর্থাৎ সব সামরিক ঘোষণা, রেগুলেশনস এবং আদেশসমূহ (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত) জারি বা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা বেআইনি, অকার্যকর ও অস্তিত্বহীন মর্মে ঘোষণা করেন কিছু বিধান ও কর্মকে মার্জনাপূর্বক।

রায়ের অভিমতে বলা হয়, ‘সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের ‘মূল বৈশিষ্ট্য’ পরিবর্তনের চেষ্টা বেআইনি, অকার্যকর ও আইনের দৃষ্টিতে কখনোই এর অস্তিত্ব ছিল না।…সামরিক ফরমানবলে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে একটি ‘ধর্মীয় রাষ্ট্রে’ রূপান্তর করা হয়েছে, যা শুধু সংবিধানের মূল ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যকেই পরিবর্তন করেনি, বরং স্বাধীনতাসংগ্রামের সর্বোচ্চ একটি অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।’ হাইকোর্টের এই রায় আপিল বিভাগেও বহাল থাকে।

লিখিত সংবিধানের প্রস্তাবনার গুরুত্ব ও মর্ম কী বা কতটুকু, সে সম্পর্কে ‘আনোয়ার হোসেন চৌধুরী গং বনাম বাংলাদেশ’ মামলায় বিশদ আলোচনা, বিশ্লেষণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এটি সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী মামলা হিসেবে পরিচিত।

এ মামলায় ‘সংবিধানের প্রস্তাবনাকে’ সংবিধানের অংশ হিসেবে ও অপরিবর্তনীয় বলে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী অভিমত দেন [৪১ ডিএলআর (এডি), পৃষ্ঠা ১৬৫ ]। রায়ে তিনি অভিমত দিয়েছেন যে জাতীয় সংসদ যেহেতু সংবিধান কর্তৃক সৃষ্ট, সেহেতু জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে গৃহীত সংবিধানের প্রস্তাবনাকে সংশোধনের কোনো এখতিয়ার সংসদের নেই। এ রায়ে সংবিধানের প্রস্তাবনাকে সংবিধানের ‘ধ্রুবতারা’ হিসেবে উল্লেখ করে বিচারপতি এম এইচ রহমান বলেছেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা শুধু সংবিধানের অংশই নয়, বরং এটা একটি ‘সুরক্ষিত বিধান’ এবং এটা সংশোধনের ক্ষমতা এককভাবে সংসদের নেই। সংবিধানের যেকোনো সংশোধন সংবিধানের প্রস্তাবনার আলোকে বিশ্লেষণ বা পরীক্ষা করতে হবে বলে ওই রায়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।‘আবদুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ’ মামলায় আপিল বিভাগ সংবিধানের প্রস্তাবনা সম্পর্কে অভিমত দিয়েছেন যে বিশ্বের অন্যান্য সংবিধানের প্রস্তাবনা হতে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা ব্যতিক্রমধর্মী। কেননা, ওই প্রস্তাবনায় সমগ্র সংবিধানের দর্শন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রতিফলন এবং বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণিত হয়েছে।

পঞ্চম সংশোধনীসংক্রান্ত মামলার রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অভিমত দিয়েছেন যে, ‘এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে খন্দকার মোশতাক আহমদ, যিনি একজন মন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সায়েম এবং সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুযায়ী তাঁরা যে রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্য নন—তা তাঁরা জ্ঞাত ছিলেন না। তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ “রাষ্ট্রপতির পদ” দখল করেছিলেন। এ ধরনের পদ দখল “রাষ্ট্রদ্রোহ”, যা ফৌজদারি অপরাধ।’দেশের সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনীসংক্রান্ত মামলায় ঐতিহাসিক ওই রায় দিয়ে শুধু বিচার বিভাগকে কলঙ্কমুক্ত করেননি, অধিকন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করার চেষ্টা করেছেন।

ওই রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ অনুচ্ছেদ ৩৮ ছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান মূল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ফিরে এসেছে ‘জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম’। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি সুরক্ষিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা; যদিওবা ৩৮ অনুচ্ছেদ বাহাত্তরের মূল সংবিধানের অনুরূপ ফিরে না এলেও ফিরেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। ফিরে পেয়েছি আমাদের জাতীয়তার পরিচয় ‘বাঙালী’।

জনগণের অভিপ্রায়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের প্রতিফলন—‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ রক্ষায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন, বিলম্বে হলেও উজ্জ্বল ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

লেখক : বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১

সুত্র : প্রথম আলো