ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সব মামলাতেই আসামীকে দোষী প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা ও গাইবান্ধার সাবেক সংসদ সদস্য আবু সালেহ আব্দুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয়জনকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড রায়সহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে আসামীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর অভিযোগ হলো, বুদ্ধিজীবী হত্যার পরে ওই এলাকাকে (গাইবান্ধা জেলায়) পুরো নেতৃত্ব শূন্য করতে সেখানকার ১৩ জন সাবেক ও তৎকালীন চেয়ারম্যান, মেম্বারকে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনাল এসব অভিযোগ গ্রহণ করে তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন। এ রায়ে প্রসিকিউশন সন্তুষ্ট। একইসঙ্গে বলতে চাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত যতগুলো মামলা হয়েছে প্রত্যেকটিতে আসামীকে আমরা দোষী প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। মামলায় কনভিকশন আনার শতভাগ সাফল্য ধরে রেখেছি। আমরা খুশি।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। এই মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অপরাধীর বয়স আদালতের নজরে এনে সাজার বিষয়টি বিবেচনা করার যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু আদালত স্পষ্টভাবে বলেছেন এক্ষেত্রে বয়স বিবেচ্য নয়। কারণ অপরাধ সংগঠিত হয়েছে ১৯৭১ সালে ফলে একাত্তরের বাস্তবতায় অপরাধীর বিচার হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুই হয়েছে স্বাধীনতার চার দশক পর, এক্ষত্রে বয়স বিবেচনায় নিলে বিচার বন্ধ করে দিতে হবে কারণ সব আসামীই বৃদ্ধ হয়ে গেছে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমিও বয়সের ব্যাপারটি বিবেচনায় নিতে নারাজ। অপরাধী বৃদ্ধ হয়ে গেছে বলে তার অপরাধের বিচার হবে না কিংবা সাজা কম হবে এটা অযৌক্তিক।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে এই মামলায় জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (জেসিই)  -এর যে তিনটি ধরণ হয় অর্থাৎ টাইপ- ১, টাইপ- ২ এবং টাইপ – ৩, এখানে আদালত টাইপ-১ অনুসরণ করেছেন। যদি কোন কমন ইন্টেনশন বা পরিকল্পনা নিয়ে একটি সঙ্গবদ্ধ দল কাজ করে তবে সে দলের যে যতটুকুই অপরাধ করুণ না কেন সাজা একই হবে। অর্থাৎ প্রধান আসামি যে পরিমাণ অপরাধ করেছেন তার জন্য যে সাজা হবে তা সব আসামীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ টাইপ- ১ বিবেচনায় নিয়ে এই ছয় আসামির বিরুদ্ধে আনিত তিন অভিযোগ ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করে তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন।

মানবতাবিরোধী আপরাধ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন আসামি পলাতক, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সদ্য রায় হওয়া এই মামলার ছয় আসামীর পাঁচজনই পলাতক, সেক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করেন কি?

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : আসলে পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে আমরা যে মামলাগুলো লড়েছি রায়ে তারা দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আমাদের এক ধরণের মানসিক সন্তুষ্টি এসেছে ঠিক কিন্তু সত্যিকারার্থে আমরা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। কারণ যতক্ষণ আমরা রায় অনুযায়ী এ অপরাধীদের দণ্ড কার্যকর করতে না পারছি ততক্ষণ এসব অপরাধের ন্যায় বিচার দৃশ্যমান নয়। আসামি পলাতক থাকায় সাজা কার্যকর না হওয়া সত্যিই হতাশাজনক। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই মামলাতেও আদালত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পলাতক আসামীদের গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।

অভিযোগ আছে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ধীর গতিতে চলছে

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার খুব স্পর্শকাতর ব্যাপার। এই বিচার নিয়ে জাতিগতবে আমরা উদ্বিগ্ন থাকি, উৎসুক থাকি। এখানে যদি ভাবা হয় প্রতিদিনই মামলা ফিড ইন হচ্ছে সেটা কিন্তু ভুল ধারণা। সে হিসেবে এটাকে আমি অভিযোগ হিসেবে দেখছি না, প্রথমত বলা হচ্ছে দুইটা ট্রাইব্যুনাল থেকে একটা কেন বানানো হল? দেখুন, এখানে সমস্যা হচ্ছে আপনি শুধু ট্রাইব্যুনাল বাড়ালে তো চলবে না। ট্রাইব্যুনাল বাড়ানোর সাথে সাথে প্রসিকিউশনের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং তদন্ত সংস্থার লোকবল বাড়াতে হবে। কারণ যদি তদন্ত সংস্থায় লোক না বাড়ে তাহলে মামলা ফিড ইন করাবেন কিভাবে? ট্রাইব্যুনাল বাড়িয়ে দশটা করলাম কিন্তু তদন্ত সংস্থায় পর্যাপ্ত লোক না থাকলে লাভ নেই। প্রথম থেকে সেই একই মানুষগুলোকেই তদন্ত করতে হচ্ছে। দিনরাত কষ্ট করতে হচ্ছে। কেননা এতো বছর পর তদন্ত করে সঠিক তথ্য বের করা সহজ কাজ নয়। এজন্য একই জায়গায় দশবার যেতে হচ্ছে। ফলে তদন্তকর্মকর্তার তদন্তে সময়ও বেশি লেগে যাচ্ছে। জনবল সংকটেই মূলত দুই ট্রাইব্যুনাল থেকে একটি করা হয়েছে।