কাগজেই সীমাবদ্ধ ‘থুথু আইন’

‘থুথু অনেক রোগের কারণ/যেথা সেথা ফেলা বারণ’ রেলস্টেশন বা সরকারি দফতরে সচেতনতামূলক এমন বার্তা দেখা যায় প্রায়ই। কিন্তু যেখানে সেখানে থুথু ফেলে রাস্তা ও দেয়াল নোংরা করার দৃশ্য চোখে পড়ে অহরহ। চিকিৎসকদের মতে, মানুষের থুথুতে অনেক রোগ-জীবাণু থাকে, তাই এটা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। যত্রতত্র থুথু ফেললে আইন করে শাস্তির বিধান করা হলেও সেটা কাগজে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এ আইনের প্রয়োগ নেই। কিন্তু নিজেদের সুস্থতার স্বার্থে যত্রতত্র থুথু ফেলা বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন,‘যত্রতত্র থুথু ফেলার কারণে পরিবেশ নোংরা হয় এবং রোগজীবাণু ছড়ায়। থুথুর ওপর মশা বা মাছি বসে। পরে ওই মশা বা মাছি খাবারের ওপর বসলে জীবাণু ছড়ায়। থুথুর মাধ্যমে যক্ষ্মারোগের জীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। থুথু শুকিয়ে বাতাসের মাধ্যমে জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে মানুষ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগসহ যেমন ব্রংকাইটিস,অ্যাজমা ইত্যাদিসহ ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার রাস্তায় যদি অধিকাংশ মানুষ থুথু ফেলে তাহলে রাস্তায় চলা যাবে না। থুথু ফেলার জন্য ডাস্টবিন দেওয়া হলেও পরিষ্কার করা হয় না। এটা মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর। আবার অনেকে বদ্ধঘরের দেয়ালে থুথু ফেলেন, যা আরও ডেঞ্জারাস (ভয়ঙ্কর)। রাস্তায় ফেলা থুথু শুকিয়ে যায়, কিন্তু বদ্ধঘরের দেয়ালের থুথু শুকায় না। তবে রাস্তায়ও থুথু ফেলা ঠিক না, এটা অন্যায়। আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।এ বিষয়ে শিশুদেরও শিক্ষা দেওয়া দরকার। পাঠ্যবইয়েও বিষয়টি রাখা উচিত।’

এ বিষয়ে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী মঞ্জু ধর বলেন, ‘থুথু ফেলার বিষয়ে আমরা এখনও সচেতন হতে পারিনি। সুনাগরিকের অনেক দায়িত্ব থাকে, আমরা সেক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। যত্রতত্র থুথু ফেলা অন্যায়। আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে গড়ে উঠতে পারিনি। আমরা সভা-সমাবেশ করি কিন্তু সেই জায়গাটাও থুথু ফেলে নোংরা করে রাখি। তবে সবাই সচেতন হলে, সবার মধ্যে দেশপ্রেম থাকলে দেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব।’

বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর ৬০(১) ধারায় ‘‘আবর্জনা বাক্স ও পিকদানী’ শিরোনামে উল্লেখ আছে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত সংখ্যক আবর্জনা ফেলার বাক্স ও পিকদানী থাকতে হবে এবং সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।’’

৬০(২) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘কোনও প্রতিষ্ঠানের আঙিনার মধ্যে কেউ বাক্স ও পিকদানী ছাড়া ময়লা বা থুথু ফেলতে পারবেন না।

৬০(৩) ধারায় উল্লেখ আছে, এই বিধান লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

এছাড়া রাজশাহী মহানগরী পুলিশ আইন-১৯৯২ এর ৮৬ ধারায় উল্লেখ আছে, কোনও ব্যক্তি সরকারি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নোটিশ অমান্য করে ধূমপান করলে বা থুথু ফেললে তাকে একশ’ টাকা জরিমানা করা যাবে। তবে সিলেট মহানগরী পুলিশ আইন-২০০৯ ও বরিশাল মহানগরী পুলিশ আইন-২০০৯ অনুযায়ী তিনশ’ টাকা জরিমানা করা যায়। তবে দ্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স, দ্য চিটাগং মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স এবং দ্য খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্সে একশ’ টাকা জরিমানা করার বিধান আছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক আইনই প্রয়োগ করতে পারি না। যখন সবাই অমান্য করেন তখন আইন প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে ওঠে। কারণ,আইন করাই হয় যাতে অধিকাংশ মানুষ সেটা মেনে চলে না। আর ঢাকায় এরচেয়েও বড় সমস্যা রয়েছে। যেমন যানজটের সমস্যা। কিন্তু এটা পুলিশ দিয়ে সমাধান করা যাবে না। যদি সবাই ট্রাফিক আইন না মানেন তবে সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন। তবে এটা সচেতনতার বিষয়। মানুষ যদি মনে করেন তারা রাস্তায় থুথু ফেলবে না বা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ডাস্টবিন ছাড়া ফেলবে না তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব নর্মস একদিনে গড়ে ওঠে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো পুলিশের কাজ নয়। আমাদের কাজ মূলত আইন প্রয়োগ করা। তারপরও ঢাকার স্কুল-কলেজে ট্রাফিক ও ইভটিজিং বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে আমরা প্রোগ্রাম করি।’

জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশে না, অনেক দেশেই যত্রতত্র থুথু ফেললে শাস্তির বিধান রয়েছে। যেমন সৌদিআরবে রাস্তায় থুথু ফেললে ১০০ থেকে ১৫০ রিয়াল জরিমানা করা হয়। গঙ্গায় বর্জ্য বা থুথু ফেললে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১০ হাজার রুপি জরিমানার বিধান রেখে ভারতে ২০১১ সালে আইন করা হয়। আর ২০১৫ সালে মুম্বাইয়ের রাস্তায় থুথু বা পানের পিক ফেলার দায়ে পাঁচ হাজার রুপি জরিমানা ও ১ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত সরকারি দফতর ও রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কারের বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের আইন এত কঠোরও নয় তবে আইন প্রয়োগে উদাসীনতা থাকায় এ বিষয়ে জনসচেতনতা তেমন একটা বাড়ছে না। বাংলা ট্রিবিউন