ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিশ্বে অনন্য

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক দলিল। ৪৩ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন অস্থায়ী বিধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অসংশোধনযোগ্য বিধানে পরিণত হয়েছে।

একজন ব্যক্তিমানুষ যেমন জন্মগতভাবে স্বাধীন, একটি জাতিগোষ্ঠীও তেমন স্বাধীনতার দাবিদার। এই মূলমন্ত্রটির বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই জারি করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদলে অনুপ্রাণিত। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মূলত একটি অনুকরণীয় মডেল, যা নাকি বিশ্বে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক বিশাল প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার ১৩ বছর পরেই ১৭৮৯ সালে ফরাসি স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে যদিও আমরা একই রকম স্বাধীনতাকামী চেতনার উন্মেষ দেখতে পাই, তবে ভাষাগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ফরাসি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বেশ পার্থক্য রয়েছে।

তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি হওয়ার আগে বিশ্বের অন্য অনেক নতুন রাষ্ট্রই তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মডেল সরাসরিভাবে অনুকরণ করেছে। এর মধ্যে উল্লখেযোগ্য হলো- ১৭৯০ সালের প্রভিন্স অব ফ্যান্ডার্স-এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৮১১ সালের ভেনিজুয়েলার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৮৪৭ সালের লাইবেরিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৯৪৫ সালের ভিয়েতনামের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে মোট ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। প্রথম ভাগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক কারণসমূহ বিধৃত। দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তৃতীয়ভাগে নতুন রাষ্ট্রের সরকারের রূপরেখার বিবরণ দেওয়া। চতুর্থভাগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপট উল্লেখিত হয়েছে। পঞ্চমভাগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির কার্যকর হওয়ার তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

প্রথম ভাগে উল্লখে করা হয়েছে কেন, কি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। এই ভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারটির সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম ভাগটিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগনামা হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও কিন্তু একইরকমভাবে রাজা তৃতীয় জর্জের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অবতারণা করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগনামার অবতারণা করা স্বাধীনতাকামী নতুন রাষ্ট্রের জন্য আসলে খুব জরুরি। কেন জরুরি? কেননা যদি নতুন রাষ্ট্রটি তার স্বাধীনতা দাবির স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন না করতে পারে, তবে তাদের পদক্ষেপকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপপ্রয়াস বলে বিবেচনা করা হয়।

ঔপনিবেশিক প্রভুর কর্তৃত্ব থেকে যখন কোনো রাষ্ট্র তার স্বাধীনতা দাবি করে তখন ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক বিষয় বলেই ধরে নেওয়া হয়। কেননা ঔপনিবেশিক সম্পর্ক মূলত দু’টি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঘিরেই গড়ে ওঠে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠিত/স্বীকৃত রাষ্ট্রের কোনো অভ্যন্তরীণ জনগোষ্ঠী যখন ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন ব্যাপারটি মূলত ওই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ফলে ওই জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার দাবিকে আন্তর্জাতিক মহল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে ধরে নেয় এবং দাবি করা নতুন রাষ্ট্রকে কখনই স্বীকৃতি দিতে চায় না। যেমন, কাতাঙ্গা যখন ১৯৬০ সালে কঙ্গোর বিরুদ্ধে অথবা বায়াফ্রা যখন ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন তাদের স্বাধীনতা ঘোষণাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপপ্রয়াস রূপে চিহ্নিত করা হয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব তাদের রাষ্ট্র রূপে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।

১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্ন্তগত বাঙালি জনগোষ্ঠী ঠিক একইরকমভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তখন তারা সফল হয় এই স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে। ফলে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় আন্তর্জাতিক বিশ্ব। এদিক থেকে দেখতে গেলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথমভাগে স্বাধীনতা ঘোষণার যে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে তার নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

আমি অভিভূত হই যখন দেখি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার স্বপক্ষে যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে তা অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে, সহজ ভাষায়, অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ধারায় এবং ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শব্দের ব্যবহারে উপস্থাপন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতার দাবিকে দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন টমাস জফারসন।

তার দার্শনিক রূপরেখা বিশ্ববাসীকে চমকিত করেছে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। অপরদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতাকে মূর্ত করা হয়েছে একটি বাস্তবিক প্রয়োজন হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাই আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি যুগান্তসৃষ্টিকারী অবদান রেখেছে। আজকের উন্নয়নশীল বিশ্বে স্বাধীনতাকে দর্শনের বেড়াজালে আর আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা আজ পৃথিবীর যে কোনো জাতিগোষ্ঠীর একটি জীবন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রথমবারের মতো বিশ্বে এই ধ্রুব সত্যটি সার্থকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।

দার্শনিক রুশো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে একজন ব্যক্তি মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রতিষ্ঠা করেছে একটি জাতিগোষ্ঠী তার জাতিসত্তার উন্মেষ থেকেই স্বাধীন। স্বাধীনতার এই যে ব্যক্তি থেকে জাতিগোষ্ঠীর পরিমণ্ডলে উত্তরণ তাকে আমি দার্শনিক জয়যাত্রা হিসেবে দেখি না। আমি মনে করি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়াতে স্বাধীনতা চেতনার একটি নতুন দিক উন্মোচন হয়ছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাধীনতাকে দর্শনের প্রাসাদ থেকে মুক্ত করে, তার জীবন্ত ও প্রায়োগিক ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ জনপদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন হিসেবে স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এই কারণেই বিশ্বে অনন্য।

লেখক: প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অধ্যাপক , আইন বিভাগ , ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি