লাইসেন্স ছাড়া ডে-কেয়ার পরিচালনায় জেল-জরিমানার আইন আসছে

লাইসেন্স ছাড়া শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র (ডে-কেয়ার সেন্টার) পরিচালনায় জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন, ২০১৮’এর খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। একই সঙ্গে এ খসড়ায় সব সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার কথাও বলা হয়েছে।

মহিলা ও শিশু বিষয় মন্ত্রণালয় এখন খসড়াটির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে। এরপরই এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘খসড়া আইনের বিষয়ে আমরা মতামত নিচ্ছি। গ্রহণযোগ্য মতামত বিবেচনায় নিয়ে আমরা এটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাব। তারা এটি যাচাই করে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করবে।’

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সচিব বলেন, ‘আমরা বলি নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন তো শিশুকে বাদ দিয়ে নয়। কর্মজীবী নারী যদি তার বাচ্চাকে নিরাপদ জায়গায় না রাখতে পারে তবে সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। আমরা তিন ক্যাটাগরির শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রাখব। একেবারে দরিদ্র মা, কিছুটা স্বচ্ছল মা ও উচ্চবিত্ত মা সবার আওতার মধ্যেই এ দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো থাকবে। প্রস্তাবিত আইনে সেটা বলা আছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন বড় বড় ভবন হচ্ছে, এসব ভবনের নিচে একটা ডে কেয়ারের প্রভিশন রাখতে হবে। সেটি আইনে বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেও এটা রাখতে হবে।’

নাছিমা বেগম বলেন, ‘আইনটি হলে বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। কারণ এ আইন হলে দিবাযত্ন কেন্দ্র চালাতে আমাদের লাইসেন্স নিতে হবে।’

বর্তমানে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের প্রকল্পের অধীনে ঢাকা শহরে ৭টি নিম্নবিত্তদের জন্য এবং ৪টি মধ্যবিত্তদের জন্য মোট ১১টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আওতায় ঢাকায় ৭টি ও ঢাকার বাইরে পুরাতন ৫টি বিভাগীয় শহরে ৫টিসহ মোট ১২টি ডে-কেয়ার সেন্টার নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। সমাজ সেবা অধিদফতরের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা একটি।

এছাড়া ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য ৬টি ডে-কেয়ার সেন্টার মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে শ্রমজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য ১৪টি জেলা শহরে ১৪টি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু রয়েছে বলে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর থেকে জানা গেছে। তবে বেসরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের কোনো তালিকা নেই সরকারের কাছে।

যে অপরাধের যে শাস্তি
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, শিশুর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ লাইসেন্সধারী দিবাযত্ন কেন্দ্রের বাতিল করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে এ আইন বা দেশে প্রচলিত প্রযোজ্য অন্য যেকোনো আইনের আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রবেশপথ ও ভেতরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা এ ধরনের ডিভাইস স্থাপন করতে হবে। কেন্দ্রে শিশুর অবস্থানকালীন ওই ক্যামেরা বা ডিভাইস কার্যকর রাখতে হবে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে এবং তিনি সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা বেবি সিটিং কার্যক্রম পরিচালনা করলে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা এবং এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কেন্দ্রে শিশুকে সেবা প্রদানকারীর যোগ্যতা এ আইনের অধীনে প্রণীত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরের (এসওপি) মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কেউ এ বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং লাইসেন্স প্রদর্শন না করা পর্যন্ত পরবর্তী প্রতিদিনের জন্য দৈনিক এক হাজার টাকা হারে জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবেন।

এ আইনের অধীনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তাকে কোনো দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় রেকর্ডপত্র দেখাতে অস্বীকৃতি জানালে বা পরিদর্শনকালে বাধা দিলে তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন এবং এ অপরাধের জন্য বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে উল্লেখিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আইনের অধীনে দেয়া কোনো নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থ লাইসেন্সধারী সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

লাইসেন্সের কোনো শর্তের ব্যত্যয় ঘটালে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে। কোনো লাইসেন্স রহিত স্থগিত বা বাতিলের ক্ষেত্রে অবশ্যই লাইসেন্সধারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দিবাযত্ন কেন্দ্রের ধরন
এ আইনের অধীনে তিন ধরনের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকবে। তা হলো- সরকারের বিনামূল্যে পরিচালিত, সরকারের সাবসিডাইজড এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সব সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধন ও লাইসেন্সসহ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করতে হবে।

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্য, লাইসেন্স ফি, শিশুর বয়স ও ভর্তির যোগ্যতা, শিশু ভর্তি ফি, মাসিক সেবামূল্য, শিশুকে প্রদেয় সেবা, শিশুর বিকাশ ও নিরাপত্তা সেবা প্রদানকারীর যোগ্যতা এবং আবেদনকারী সম্পর্কে পুলিশ প্রত্যয়নসহ যাবতীয় বিষয়াদি বিধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে।

সব দিবাযত্ন কেন্দ্রে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার এবং বিশেষ শিশুদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের বিদ্যালয়ে শুরুর আগে এক ঘণ্টা এবং বিদ্যালয়ের ছুটির পরে এক ঘণ্টা রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে প্রস্তাবিত আইনে উল্লেথ করা হয়েছে।

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের লাইসেন্স ভর্তি ফি এবং সার্ভিস চার্জ দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে।

দিবাযত্ন কেন্দ্রের নিবন্ধন ও লাইসেন্স
এ আইনের অধীনে নিবন্ধন এবং লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা বেবি সিটিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।

তবে সরকারি কোনো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র এবং সরকারের বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত কোনো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। তবে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে নিবন্ধিত হতে হবে।

নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বলতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্ধারিত বা অনুমোদিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝাবে।

নিবন্ধক ও লাইসেন্স প্রদানকারী একই ব্যক্তি হবেন। নিবন্ধকের যোগ্যতা নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী সরকার নির্ধারণ করবে। নিবন্ধকের দায়িত্ব কর্তব্য ক্ষমতা ও কার্যপরিধি সরকার নির্ধারণ করতে পারবে।

লাইসেন্সের শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে প্রাথমিকভাবে দুই বছর বা কম সময়ের জন্য কোনো দিবাযত্ন কেন্দ্রকে লাইসেন্স দেয়া যাবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সন্তোষজনক কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে তা দুই বছর অন্তর নবায়ন করা যাবে। কোনো আবেদনকারীকে লাইসেন্স ইস্যু করা না হলে কারণ উল্লেখ করে তা লিখিতভাবে বা অনলাইনে জানাতে হবে।

লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত হারে লাইসেন্স ফি ও নবায়ন ফি দিতে হবে। সূত্র: জাগো নিউজ