অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান

ফৌজদারি মামলা তদন্তের আদ্যোপান্ত

মোহাম্মদ মশিউর রহমান:

আমাদের দেশে তদন্ত নিয়ে নানা ধরনের গল্পের পাশাপাশি দুঃখজনক ঘটনাও রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক তুচ্ছ ঘটনায় যেমন তদন্তের মহড়া দেয়া হয়েছে একই সঙ্গে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তদন্ত নিয়েও টালবাহানার পাশাপাশি এর ফলাফলকে অন্ধকারে রাখা হয়। ফলে তদন্ত নিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তদন্ত নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ হল এর রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক সব তদন্ত প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ এক গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার। কিন্তু এটা কখনোই তেমনভাবে স্বীকার করা হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত নিয়েও স্বচ্ছতার প্রশ্ন এড়ানো সম্ভব হয়নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। পাশাপাশি রয়েছে অপরাধ সংক্রান্ত ফৌজদারি তদন্ত। সব মিলিয়ে তদন্ত নিয়ে জনগণের মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত, সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত এবং ফৌজদারি মামলার তদন্তের অনেক মিল থাকলেও এগুলোর প্রকৃতি শ্রেণী এবং দায়েরের পদ্ধতি একরকম নয়। আমাদের আজকের আলোচনা ফৌজদারি মামলার তদন্ত নিয়ে।

তদন্ত কি
যখন কোন অপরাধ ঘটে যায় বা ঘটার লক্ষণ দেখা দেয় তখন এই ঘটনার শিকার বা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা যিনি ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন এমন এক বা একাধিক ব্যক্তি থানায় খবর দিবেন। অপরাধ আমলযোগ্য হলে থানা কর্তৃপক্ষ এটা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করেন আর আমলযোগ্য না হলে একে এজাহার হিসেবে গ্রহণ না করে শুধু সাধারন ডায়েরী হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। এছাড়া আমলযোগ্য অপরাধের এজাহার আদালতেও দাখিল করা যায়। এই এজাহার বা সাধারন ডায়েরী করার পর ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বা পুলিশ উল্লিখিত অপরাধের সত্যতা খুঁজে দেখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে যে প্রতিবেদন দাখিল করে তাই তদন্ত প্রতিবেদন। আর এ লক্ষ্যে সংঘটিত কাজকর্মকেই বলা হয় তদন্ত।

থানায় অভিযোগের তদন্ত
থানায় অভিযোগ গ্রহণের পরই তদন্তের প্রশ্ন দেখা দেয়। থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কোন আমল অযোগ্য অপরাধের সংবাদ পেলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৫ ধারা অনুযায়ী প্রথমে তা থানার বইতে লিখবেন। তারপর যে ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধটি বিচার করার ক্ষমতা আছে কেবলমাত্র তিনি পুলিশকে বিষয়টি তদন্তের আদেশ দিতে পারেন। আমল অযোগ্য অপরাধের তদন্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ করতে পারে না। এখানে উল্লেখ্য, থানায় দায়েরকৃত অভিযোগকে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আমলযোগ্য ও আমল অযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৬ ধারা অনুযায়ী আমলযোগ্য অপরাধের তদন্ত পুলিশ ম্যজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই করতে পারেন। এমনকি গুরুতর অপরাধ অনুষ্ঠিত হলে পুলিশকে এজাহারের জন্যও অপেক্ষা করতে হয় না। যে কোনভাবে অপরাধের কথা জানতে পারলেই পুলিশ তদন্ত করতে পারেন।

তদন্তের পদ্ধতি
থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার তদন্ত করার অধিকার রাখেন। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিম্নপদের অন্য যে কোন অফিসার থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার দ্বারা নির্দেশিত হয়েও তদন্ত করতে পারেন। উর্ধ্বতন যেকোন অফিসারও তদন্ত করতে পারেন। তদন্তকালে পুলিশ যেকোন ব্যক্তিকে তার সামনে হাজির হওয়ার জন্য তলব করতে পারেন। এ তলব বাধ্যকর করতে হলে লিখিত আদেশ দেয়া আবশ্যক। পুলিশের কনস্টেবল যদি কোন লোককে মৌখিভাবে ডাকে এবং ওই লোক যদি তা অবহেলা করে তাহলে ওই ব্যক্তির কোন অপরাধ হবে না।

তদন্তকালে পুলিশ অফিসার ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে কোন ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে পারেন এবং সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন। তাই বলে সাক্ষ্য নেয়ার জন্য কোন ব্যক্তিকে আটক রাখতে পারেন না। সাক্ষীর বক্তব্য তদন্তকারী অফিসার লিপিবদ্ধ করবেন। সাক্ষীর এ সাক্ষ্য দেখে আসামি তার বিরুদ্ধে আনীত মামলার প্রকৃতি বুঝতে পারেন। তদন্তকারী অফিসার তদন্তকালে প্রতিদিন একটি ডায়রীতে তার তদন্তের অগ্রগতি লিপিবদ্ধ করবেন এবং কখন তিনি খবর পেলেন, কখন তদন্ত আরম্ভ ও শেষ করলেন, কোন কোন স্থান তিনি পরিদর্শন করলেন এবং তদন্তের ফলাফল কি হল- এ সব বিবরণ তাতে লিপিবদ্ধ করবেন। এ ডায়েরিকে পুলিশ ডায়েরি বলা হয়। তদন্তে বিলম্ব করা উচিত নয়। তাতে ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা সৃষ্টির অবকাশ থাকে। তদন্তকালে প্রাপ্ত মালামাল বা তল্লাশিমূলে প্রাপ্ত মালামাল যদি জব্দ করার প্রয়োজন হয় তবে কমপক্ষে ২ সাক্ষীর উপস্থিতিতে পুলিশ তা জব্দ করতে পারে।

আদালতে অভিযোগের তদন্ত
আদালতে অভিযোগ দায়েরের পর বাদীর হলফ ও জবানবন্দি গ্রহণ এবং উপস্থিত সাক্ষী যদি থাকে, তবে তাদের জবানবন্দি গ্রহণের পরও যদি আদালত নালিশের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারেন, তবে তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নালিশের বিষয়টি তদন্তে পাঠাতে পারেন। এটি ৩ ভাবে হতে পারে। ক) নিজে তদন্ত করতে পারেন, খ) তিনি অধীনস্থ কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন ও গ) কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কোন ব্যক্তিকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।

দায়রা আদালতে বিচার্য অপরাধের নালিশের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের পর বিবাদীদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি না করে এ বিষয়ে নিজে বা অন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে জুডিশিয়াল ইনকোয়ারির জন্য নির্দেশ দিবেন। জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে এবং কোর্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। পুলিশ হেফাজতে কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করবেন। এছাড়া কোন লাশ কবরস্থ হয়ে থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন সেটা কবর থেকে উঠিয়ে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাহলে তিনি এরুপ করতে পারবেন।

আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনার মৃত্যুর তদন্ত
কোন ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে বা কোন ব্যক্তি কর্তৃক বা প্রাণী কর্তৃক বা কোন যন্ত্র বা দুর্ঘটনার নিহত হলে বা সন্দেহ করার মতো কোন পরিস্থিতিতে মারা গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার তদন্ত করবেন। দুই বা ততোধিক পার্শ্ববর্তী গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে তিনি তদন্ত করবেন এবং রিপোর্ট প্রণয়ন করবেন যাতে মৃত্যুর কারণ ও অন্যান্য বিবরণ যতটা সম্ভব বর্ণিত হবে। এ রিপোর্টে তিনিসহ অন্যান্য উপস্থিত ব্যক্তিগণ যারা একমত পোষণ করেন তারা স্বাক্ষর করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকলে পুলিশ অফিসার লাশটিকে পরীক্ষার জন্য নিকটবর্তী সিভিল সার্জনের কাছে পাঠাতে পারেন। একে ময়নাতদন্ত বলে।

তদন্ত প্রতিবেদন
তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারার বিধান অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদন দ্ইু প্রকারের হতে পারে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও অভিযোগপত্র। তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন, আসামিদের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না বা ঘটনা মিথ্যা বা অপরাধ আমলের অযোগ্য, তাহলে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করবেন।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট তা গ্রহণ ও সে মতে আদেশ দিতে পারেন অথবা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট না হলে আরও তদন্তের আদেশ দিতে পারেন। আবার মামলা তদন্তে যদি আসামিদের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় এবং যদি তদন্তে ঘটনাটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র বা চার্জশীট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করবেন।

প্রকাশ থাকে যে, অভিযোগপত্র দাখিলের পরবর্তী পর্যায়ে যদি আরও কোন তথ্য পাওয়া যায়, তবে পুলিশ ওই তথ্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত বা সাপ্লিমেন্টারি অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেন। বলা প্রয়োজন, কোন মামলায় পুলিশ চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদান করলে সে ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট পুনঃ তদন্তের আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু কোন মামলায় পুলিশ একবার অভিযোগপত্র দাখিলের পর সে মামলা পুলিশ পুনঃতদন্ত করতেন পারেন না। তবে এ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট আরও তদন্তের আদেশ দিতে পারে। মনে রাখতে হবে পুনঃতদন্ত এবং আরও তদন্ত এক বিষয় নয়। এভাবে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার পরই মামলার বিচার কার্যক্রম আরম্ভের ভিত্তি প্রস্তুত হয়।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট