ছগির আহমেদ

চুক্তি আইন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

ছগির আহমেদ :

চুক্তি আইনে সম্পর্কে অনেকেই জানতে চায়। চুক্তি কি, কারা কারা চুক্তি করতে পারে, কারা কারা চুক্তি করতে পারে না? চুক্তি ভঙ্গ করলে ক্ষতিপূরণ কি হবে? এসকল বিষয় সম্পর্কে প্রায় সবারই একটা জিজ্ঞাসা থাকে। আজকে চুক্তি আইন নিয়ে আলোচনা করতে চাই। চুক্তি আইনের মূল বিষয়গুলো ছোট ছোট আলোচনার মাধ্যমে ধারণা  দিতে চাই।

ক. চুক্তি কি:

চুক্তি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Contract. ইংরেজি Contract শব্দটি ল্যাটিন শব্দ contractum থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ হল-মিলন বা একত্রিকরণ। আবার চুক্তি শব্দের আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে “আকুদ”-যার আভিধানিক অর্থ হল মিলন বা বন্ধন। চুক্তি দ্বারা আইনগত বন্ধনের সৃষ্টি হয়।চুক্তির মাধ্যমে পক্ষগণকে একত্রিত করা হয়। বাংলাদেশে ১৮৭২ সালের চুক্তি আইন প্রচলিত আছে।এই আইনের ২(জ) ধারায় চুক্তির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ” An agreement enforceable by law is a contract”. তার মানে বলা হয়েছে, আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য সম্মতিকে চুক্তি বলা হয়। সুতরাং যখন একটি সম্মতি আইন দ্বারা বলবৎ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে তখন সেই সম্মতিকে চুক্তি বলা হয়।

খ. চুক্তি আইনের প্রয়োজনীয়তা:

চুক্তি আইন মূলত একটি মৌলিক আইন। অন্যান্য দেওয়ানী আইন চুক্তি আইনের উপর নির্ভর করে প্রণীত হয়েছে। চুক্তি আইন দেওয়ানী অধিকার রক্ষার মাইলফলক। চুক্তি আইনের জন্য চুক্তির পক্ষগণ চুক্তি করার পরে তা ভঙ্গ করতে পারে না।তার মানে পক্ষগণ চুক্তি অনুসারে কাজ করতে বাধ্য হয়। পণ্য, সেবা, সম্পত্তি ইত্যাদি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে চুক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পণ্য ক্রয়, সম্পত্তি হস্তান্তর, আর্থিক লেনদেন, যানবাহনে ভ্রমণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে চুক্তির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। তবে বর্তমানে চুক্তির প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বানিজ্যিক ক্ষেত্রে। কোন ব্যক্তি ব্যবসা শুরু করতে চাইলে প্রথমে তাকে অফিস বা দোকান কিনতে হবে অথবা ভাড়া নিতে হবে। এক্ষেত্রে চুক্তির প্রয়োজন।

গ. চুক্তি আইনের উদ্দেশ্য:

চুক্তি আইনের প্রধান উদ্দেশ্য হল পক্ষগণ যেন তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে অপরপক্ষের অধিকার নিশ্চিত করে। চুক্তির কোন পক্ষ চুক্তির বাধ্যবাধকতা বা কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে চুক্তি আইন তার প্রতিকার করবে। সোজা কথা চুক্তি আইন চুক্তির পক্ষগণের স্বাধীনতার সীমাকে স্থীর করে দিয়েছে। চুক্তি আইনের প্রস্তাবনায় চুক্তি আইনের উদ্দেশ্যর কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, চুক্তি আইনের কিছু বিষয়ের সংজ্ঞা প্রদান করার জন্য চুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন- প্রস্তাব, প্রতিদান, অঙ্গীকার, বাতিল চুক্তি, ঘটনা নির্ভর চুক্তি ইত্যাদি বিষয়ের সংজ্ঞা এই আইনে প্রদান করা হয়েছে।

ঘ. চুক্তি আইনের সীমাবদ্ধতা:

১৮৭২ সালের চুক্তি আইন একটি মৌলিক আইন।তবে এই আইনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন নয়। যদিও অন্যান্য দেওয়ানী আইন মূলত চুক্তি আইনের উপর নির্ভর করে প্রণীত হয়েছে তারপরও চুক্তি আইনের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। চুক্তি আইন দেওয়ানী অধিকার রক্ষার মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। চুক্তি আইনের সীমাবদ্ধতা হলো চুক্তির সকল নিয়ম-কানুন এই আইনে নেই। যেমন-চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন ও চুক্তি রদ বা বাতিল সংক্রান্ত বিষয় ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে বলা আছে। চুক্তি আইনে এসকল বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। আবার পণ্য ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয় ১৯৩০ সালের পণ্য বিক্রয় আইনে আলোচনা করা হয়েছে। চুক্তি আইনে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। স্হাবর সম্পত্তি বিক্রয় চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সংক্রান্ত বিষয়ে ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে এই সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

ঙ. চুক্তি করার অযোগ্য ব্যক্তিগণ:

১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী তিন শ্রেণীর ব্যক্তি চুক্তি করার অযোগ্য। যথা-

(১) নাবালক।

(২) মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি।

(৩) প্রচলিত আইন অনুসারে অযোগ্য ব্যক্তি।

নোটঃকোম্পানি, কর্পোরেশন ও সংঘ এগুলোকে কৃত্রিম ব্যক্তি (legal person) বলা হয়। আমরা জানি কৃত্রিম ব্যক্তি (legal person) চুক্তি করতে পারেন। তবে কৃত্রিম ব্যক্তি আইন অনুসারে গঠিত ও নিবন্ধিত না হলে চুক্তি করতে পারবে না। তার মানে কৃত্রিম ব্যক্তিকে আইন অনুসারে গঠিত ও নিবন্ধিত হতে হবে।

*নাবালক: যে ব্যক্তি সাবালক নয় তাকে নাবালক বলা হয়। ১৮৭৫ সালের সাবালকত্ব আইন (The Majority Act,1875)-এর ধারা ৩ অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সের ব্যক্তিকে নাবালক বলা হয়।তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন।কোন নাবালকের জন্য যদি আদালত কর্তৃক অভিভাবক নিয়োগ করা হয়ে থাকে অথবা নাবালকের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদি তত্ত্বাবধায়ক (Receiver) নিয়োগ করা হয় তাহলে কোন ব্যক্তি ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সাবালকত্ব অর্জন করে।

*মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি:যে ব্যক্তি স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না তাকে মানুসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি বলে।চুক্তি আইনের ১২ ধারার ৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সাধারণত সুস্থ মনের অধিকারী কিন্তু মাঝে মাঝে অসুস্থ থাকেন,সে ব্যক্তি অসুস্থ থাকাবস্হায় চুক্তি করতে পারবেন না।কোন ব্যক্তি চুক্তি করার সময় মানুসিকভাবে অসুস্থ ছিল কিনা তা ঘটনাগত ব্যাপার।তাই মানুসিকভাবে অসুস্থতার বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হবে।চুক্তি আইনে মানসিক অসুস্থতা কাকে প্রমাণ করতে হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই।তবে সাক্ষ্য আইনের ১০২ ধারায় বলা হয়েছে,কোন বিষয় প্রমাণিত না হলে যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাকে তা প্রমাণ করতে হবে।তার মানে কোন ব্যক্তি মানুসিকভাবে অসুস্থ ছিল-এটা প্রমাণিত না হলে যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাকে মানুসিক অসুস্থতা প্রমাণ করতে হবে।

*প্রচলিত আইন অনুসারে চুক্তির অযোগ্য ব্যক্তি:

প্রচলিত আইন অনুসারে অযোগ্য ব্যক্তি চুক্তি করতে পারে না।আইন অনুসারে চুক্তি করতে অযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক চুক্তি বাতিল চুক্তি বলে পরিগণিত হবে।

উদাহরণ-১: ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া আইন(The Bankcruptcy Act,1997) অনুসারে কোন ব্যক্তি দেউলিয়া ঘোষিত হলে ঐ ব্যক্তি তার সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য কোন চুক্তি করতে পারেন না।কোন ব্যক্তির সম্পত্তি অপেক্ষা দেনার পরিমাণ বেশি হলে তিনি দেউলিয়া আইন অনুসারে দেউলিয়া ঘোষিত হতে পারেন।

উদাহরণ-২: কোন ব্যক্তি সাজা ভোগ করার সময় কোন চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন না। সাজা ভোগ করার সময় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি চুক্তি করলে তা বাতিল বলে পরিগণিত হবে।

চ. সাবালক ও নাবালকের যৌথ চুক্তি:

কোন নাবালক চুক্তি করতে পারে না। নাবালক চুক্তি করলে সেটা বাতিল বলে পরিগণিত হবে। কোন নাবালক যেমন এককভাবে চুক্তি করতে পারে না, ঠিক তেমনি যৌথভাবেও চুক্তি করতে পারে না।সাবালক ও নাবালক যৌথভাবে চুক্তি সম্পাদন করলে সাবালক ব্যক্তি এককভাবে চুক্তির বাধ্যবাধকতার জন্য দায়ী হবে। সাবালক ব্যক্তি চুক্তির জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবে, কিন্তু নাবালককে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা যাবে না।[PLD 1967 Kar-158]

ছ. উত্তরকালীন অসম্ভবতা (Supervening impossibility):

অসম্ভব কাজ সম্পাদনের চুক্তি প্রথম থেকেই বাতিল(void ab initio) বলে গণ্য হবে। চুক্তি আইনের ৫৬ ধারার ১ম অংশে বলা হয়েছে, যে কাজ এর প্রকৃতির জন্য করা অসম্ভব সে কাজ করার সম্মতি বাতিল। উদাহরণ-ক খ-এর সাথে যাদু বলে ধন আবিষ্কার করতে সম্মত হন। সম্মতিটি বাতিল।কারণ, যাদু বলে ধন আবিষ্কার সম্ভব নয়।

চুক্তি করার পর কোন ঘটনা দ্বারা চুক্তি পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়লে তাকে উত্তরকালীন অসম্ভবতা (Supervening impossibility) বলে।পরবর্তীকালে কোন ঘটনা দ্বারা চুক্তি পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়লে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে।চুক্তি সৃষ্টির সময় যা করা সম্ভব ছিল পরবর্তীকালে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য তা যদি অসম্ভব হয়ে পড়ে এরূপ ঘটনাকে উত্তরকালীন অসম্ভবতা (Supervening impossibility) বলে।

উদাহরণ-১ঃ রোকেয়া বেগম একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠান করার জন্য সাদমান মুশরিফাতের কাছ থেকে ৫০০০ টাকা দিয়ে এক দিনের জন্য একটি ঘর ভাড়া করলো। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আগের দিন ঘরটি আগুনে পুড়ে গেলো।উত্তরকালীনঅসম্ভবতার কারণে রোকেয়া বেগম এবং সাদমান মুশরিফাতের মধ্যকার চুক্তিটি পরিসমাপ্তি হয়ে গেলো।এই চুক্তির জন্য সাদমান মুশরিফাত দায়ী থাকবে না।

উদাহরণ-২ঃ মীম একজন সঙ্গীত শিল্পী।সে সাজিদের অনুষ্ঠানে এক শনিবারে গান গাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।মীম অনুষ্ঠানের আগের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাই মীমের জন্য গান গাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।মীম ও সাজিদের মধ্যকার চুক্তিটি উত্তরকালনীন অসম্ভবতার জন্য পরিসমাপ্তি ঘটে।

জ. নৈরাশ্য মতবাদ (The doctrine of frustration):

আমরা জানি সকল ধরনের চুক্তি কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। আর এই উদ্দেশ্য সকল সময় পূরণ করা সম্ভব না। চুক্তির উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব না হলে আদালত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে ধরে নিবে।একেই নৈরাশ্য মতবাদ (The doctrine of frustration) বলে।

নোট: চুক্তি করার সময় কোন একটি কাজ করা সম্ভব ছিল।পরবর্তীতে কোন একটি অজানা ঘটনার কারণে কাজটি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।এই ঘটনাকে Supervening impossibility বলে।উত্তরকালীন অসম্ভবতার(Supervening impossibility)ক্ষেত্রে নৈরাশ্য মতবাদের প্রয়োগ করে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে।[47 DLR 430]

ঝ. চুক্তিভঙ্গের প্রতিকার:

চুক্তিভঙ্গের জন্য বিভিন্ন প্রতিকার রয়েছে।চুক্তিভঙ্গের প্রতিকারগুলো নিম্নরূপঃ

(১) ক্ষতিপূরণ(Compensation).

(২) চুক্তি রদ বা বাতিল (Rescission of contract).

(৩) চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন (Specific performance of contract).

(৪) নিষেধাজ্ঞা(Injunction).

( ৫) পূর্বাবস্হায় আনায়ন(Restitution)

(৬) কার্যানুপাতিক মূল্য প্রদান (Quantum Meruit).

চুক্তিভঙ্গের জন্য উপরের ছয়টি প্রতিকারের মধ্যে একমাত্র ক্ষতিপূরণ ছাড়া বাকী অন্য পাচটি প্রতিকার ইকুইটির অবদান। শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ ব্রিটিশ কমন ল’ থেকে উদ্ভব হয়েছে।চুক্তিভঙ্গের প্রতিকার হিসেবে ক্ষতিপূরণ চুক্তি আইন দ্বারা পরিচালিত। বাকী পাচটি প্রতিকার আদালতের সুবিবেচনার উপর নির্ভর করে এবং বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন-১৮৭৭ এর বিধান দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।

*ক্ষতিপূরণ(compensation):

চুক্তিভঙ্গের কারণে যে পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই পক্ষ চুক্তিভঙ্গকারী পক্ষের নিকট থেকে আর্থিকভাবে যে প্রতিকার লাভ করে তাকে ক্ষতিপূরণ বলে।চুক্তিভঙ্গের জন্য যদি আর্থিক প্রতিকার যথেষ্ট হিসাবে বিবেচিত হয় তাহলে চুক্তিভঙ্গের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রথম ও প্রধান প্রতিকার।আবার চুক্তিভঙ্গের ফলে চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন প্রদান সম্ভব না হলে সে সকল ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা যায়।[5 BLD 159]

*চুক্তি রদ বা বাতিল(Recission of contract):

চুক্তির কোন পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে অপরপক্ষ চুক্তিটি রদ বা বাতিল করতে পারে।চুক্তি আইনের ৩৯ ধারা অনুযায়ী, অঙ্গীকারদাতা চুক্তি ভঙ্গ করলে অঙ্গীকারগ্রহীতা কথা বা আচরণ দ্বারা সেটা সমর্থন করলে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে না। চুক্তি রদ বা বাতিল সংক্রান্ত বিধান বিধিবদ্ধ করা হয়েছে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৫ থেকে ৩৮ ধারায়।এই ধারাগুলো অনুযায়ী লিখিত বা মৌখিক যেকোন ধরনের চুক্তি বাতিল করা যায়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে,চুক্তিতে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যেকোন ব্যক্তি চুক্তি বাতিল বা রদ করার জন্য মামলা দায়ের করতে পারে।

*চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন (Specific performance of contract):

যেখানে ক্ষতিপূরণ যথাযথ প্রতিকার নয় সেখানে আদালত চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের আদেশ প্রদান করতে পারেন।চুক্তি ভঙ্গ করা হলে অনেক সময় আর্থিক ক্ষতিপূরণ দ্বারা যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যায়,আবার অনেক সময় আর্থিক ক্ষতিপূরণ দ্বারা যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যায় না।যেক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দ্বারা যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যায় না সেক্ষেত্রে আদালত চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে প্রতিকার মন্জুর করেন।

উদাহরণ- চারুকলার মীম নামে একজন ব্যক্তি চিত্রশিল্পী জয়নাল আবেদীনের “মইটানা” চিত্রকর্মটি রোকেয়া বেগমের নিকট বিক্রয় করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।পরে মীম চিত্রকর্মটি বিক্রী করতে অস্বীকার করে।আদালত এক্ষেত্রে চিত্রকর্মটি বিক্রয় করে চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য মীমকে বাধ্য করতে পারেন।কারণ এই চিত্রকর্মটি বিক্রী না করলে রোকেয়া বেগমের যে ক্ষতি হবে তা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিরুপন করা যাবে না।

*নিষেধাজ্ঞা(Injunction) :

কোন কোন চুক্তি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কার্যকর করা যায়।আসন্ন চুক্তি ভঙ্গের মাধ্যমে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়ানোর জন্য আদালত আশু প্রতিকার হিসেবে নিষেধাজ্ঞা জারী করতে পারেন।নিষেধাজ্ঞা হলো আদালতের আদেশ,যা দ্বারা কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে অন্যায় কাজ করা হতে বিরত থাকতে অথবা তার বা তাদের দ্বারা কৃত অন্যায় কাজকে অপসারণ করতে বলা হয়।

*পূর্বাবস্হায় আনায়ন (Restitution):

কোন কারণে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অপরপক্ষের নিকট তাকে পূর্বাবস্হায় ফিরিয়ে আনার দাবী করতে পারে।১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের ৬৪ ও ৬৫ ধারায় পূর্বাবস্হায় আনায়ন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

উদাহরণ- রোকেয়া বেগম সাদমানকে তার লাল গরুটি বিক্রয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাদমানের নিকট হতে ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করলো।চুক্তি করার পর পরই লাল গরুটি মারা গেলো।উত্তরকালীন অসম্ভবতার জন্য চুক্তিটি বাতিল হলেও রোকেয়া বেগম সাদমানকে ১০ হাজার টাকা ফেরত প্রদান করে তাকে পূর্বাবস্হায় আনয়ন করবে।

*কার্যানুপাতিক মূল্য প্রদান (Quantum meruit):

কার্যানুপাতিক মূল্য প্রদান চুক্তি ভঙ্গের অন্যতম প্রতিকার।কার্যানুপাতিক মূল্য প্রদানের অর্থ হলো,চুক্তি অনুসারে যতটুকু কাজ সম্পন্ন হয়েছে ঠিক ততটুকুর জন্য মূল্য প্রদান করা।

উদাহরণ- ইসরাত জলিল মীম একজন সঙ্গীত শিল্পী। সে সাদমানের থিয়েটারে সপ্তাহে তিনদিন গান গাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।কিন্তু মীম অসুস্থতার জন্য এক সপ্তাহে গান গাওয়া থেকে বিরত থাকে।এই অবস্হায় সাদমান ইচ্ছা করলে চুক্তিটি রদ বা বাতিল করতে পারে।সাদমান চুক্তি বাতিল করলে মীম যে কয় সপ্তাহ গান গেয়েছে সেই কয় সপ্তাহের জন্য কার্যানুপাতিক মূল্য দাবী করতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, চুক্তি আইন মূলত একটি মৌলিক আইন।ইহা দেওয়ানী প্রকৃতির মৌলিক আইন।অন্যান্য দেওয়ানী আইনগুলো মূলত চুক্তি আইনের উপর নির্ভর করে প্রণীত হয়েছে।

লেখক : সহকারী জজ, শরীয়তপুর জজ কোর্ট।