অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

তুষার-অদিতির ভালোবাসার বিজয় বনাম হৃদয়হীন বিচারক

সিরাজ প্রামাণিক:

হিন্দু সমাজের হরিজন বর্ণের যুবক তুষার দাস আর ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে সুম্মিতা দেবনাথ অদিতি। উভয়েই একে অপরকে গভীরভাবে ভালবাসে। তাদের ভালবাসাকে বাস্তবে রুপ দিতে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে বাঁধ সাধে ব্রাহ্মণ বর্ণের সুম্মিতা’র পরিবার। মেয়ে নাবালিকা-এই অভিযোগ তুলে সুষ্মিতার মা তুষারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন।

এবার জেনে নেয়া যাক অপহরণ ও ধর্ষণ সম্পর্কে আইনে কি বলা আছে। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অন্যূন ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে।

একই আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষনের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।

প্রেম মানে না কোনো জাত-পাত, মানে না কোনো ধর্ম-বর্ণ কিংবা ধনী-গরিবের পার্থক্য। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না কোনো ভৌগোলিক সীমা কিংবা বয়সের পার্থক্য। তাই তো কোনো কোনো ভালোবাসার গল্প বেঁচে থাকে যুগ-যুগ। আবার ভালোবেসে পরিবার, পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন সমাজচ্যুত বা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছে বিদেশ, এমনকি নির্যাতনের শিকার হওয়ার নজিরও রয়েছে অহরহ।

ভালবেসে বিয়ে করে এরকমই করুণ পরিণতি ঘটেছে হরিজন বর্ণের যুবক তুষার দাসের জীবনে। মিথ্যা অপহরণের দায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছে তুষার দাস। আর স্বামীকে ছাড়িয়ে কাছে নিতে তিন মাসের শিশু কোলে নিয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে স্ত্রী সুম্মিতা দেবনাথ অদিতি’র।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, দুই বছর আগে, তুষার ও সুষ্মিতা ভালোবেসে বিয়ে করেন। তিন মাস আগে তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। কিন্তু তুষার দাস ধর্মীয় বিধানে নিম্ন বর্ণের হওয়ার কারণে শুরুতেই এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি সুষ্মিতার বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা। মেয়ে নাবালিকা- এই অভিযোগ তুলে সুষ্মিতার মা তুষারের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্য়াতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন। সুম্মিতা দেবনাথ স্বেচ্ছায় তুষার দাসকে বিয়ে করার কথা বললেও তার কথা আমলে নেননি ওই আদালত। এদিকে তুষার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে হিন্দু মতে মালা বদল করে অদিতিকে বিয়ে করেন। তুষার বিচার চলাকালে আট মাস জেল হাজতে ছিলো। পরে জামিন পান।

অবশেষে শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে অপহরণের মতো কোন ঘটনা ঘটেনি দিনের আলোর মতো পরিস্কার হলেও অপহরণের দায়ে তুষারকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক।

আদালত ১৪ বছর কারাদণ্ড দিয়ে রায়ে বলেন, ‘সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি তুষার দাস রাজ ভিকটিম সুষ্মিতা ওরফে অদিতিকে অপহরণ করে নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আসামি শিশু সুষ্মিতাকে বিয়ে করবেন এই আশ্বাস দিয়ে এই অপহরণ করেছেন। যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। তবে, আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে ওই দায় থেকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

বিচারক রায়ে আরও বলেন, আসামি তুষার ভিকটিমকে ধর্ষণ করেছে মর্মে চাক্ষুস স্বাক্ষী নাই। ভিকটিমের সাথে আসামির দৈহিক মেলামেশা হয়েছিলো কি-না এই মর্মে ২২ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে কোন বক্তব্য দেননি। তবে তিনি তার জবানবন্দির শেষের দিকে বলেন যে, তিনি (সুস্মিতা) স্বেচ্ছায় আসামিকে বিয়ে করেছেন এবং বিয়ের পর আসামির সাথে ১১ দিন ঘর সংসার করেছেন। উভয় পক্ষের স্বীকৃত মতে গত ৩ মে’২০১৯ সুষ্মিতা একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। এই কন্যা সন্তানের জন্ম তারিখ পর্যালোচনা করে ধরে নেয়া যায় যে, কমপক্ষে এই কন্যা সন্তান জন্মের ১০ মাস ১০ দিন পূর্বে সে তার মায়ের গর্ভে এসেছিলো।

উপরোক্ত আলোচনায় এই কথা পরিস্কার যে আসামি তুষার ভিকটিম সুষ্মিতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো। কিন্তু সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় অপরাধ কিনা রাষ্ট্রপক্ষ উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারায় তাকে ওই ধারায় সাজা দেওয়া যায় না।

রায় ঘোষণার পর অদিতি’র অনুভূতি, ‘আমার একটাই অপরাধ, আমি ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে হয়ে হরিজন বর্ণের ছেলেকে ভালোবেসে বিবাহ করেছি। আইনের মারপ্যাঁচে আমাদের জীবন আজ বিপন্ন।

গত ৩ জুলাই’২০১৯ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তুষার। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করেন। গত ১ আগষ্ট’২০১৯ ইং তারিখে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে তুষারকে জামিন প্রদান করেন। সেসময় স্বামীকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড থেকে মুক্ত করতে হাইকোর্টে ঘুরছিলেন স্ত্রী সুম্মিতা দেবনাথ। সাথে ছিলেন ৮৮ দিন বয়সের শিশু সন্তান। নিম্ন আদালত তুষার-অদিতির ভালবাসার মূল্যায়ন না করলেও উচ্চ আদালত ভুক্তভোগী এ দম্পতি ন্যায়বিচার দিয়েছে। এ রায়ের ফলে তাদের ভালোবাসার বিজয় সৃজিত হয়েছে।

যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, প্রেম-ভালবাসার মূল্যায়ন করতে জানে না, শিশু সন্তানের ভবিষ্যত ভাবে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com