কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মো. মজিবুর রহমান আইনজীবী পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে সুপ্রিমকোর্টে নানা প্রতারণা করে আসছিলেন। আইনজীবী শরীফ উদ্দিন সমিতির ১ নম্বর হলে তার চেয়ারে সম্প্রতি মজিবুর রহমানকে (৫৩) বসে থাকতে দেখেন।
এ সময় মজিবুরকে চেয়ার থেকে উঠতে বলায় সে নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দেয়। পরিচয়পত্র দেখাতে বললে ক্ষিপ্ত হয়ে মজিবুর (প্রতারক) আইনজীবী শরীফকে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মারা শুরু করে।
এ সময় আইনজীবীরা রক্তাক্ত অবস্থায় শরীফকে উদ্ধার এবং প্রতারক মজিবুরকে থানায় সোপর্দ করেন। প্রায়ই সুপ্রিমকোর্ট থেকে এমন ভুয়া আইনজীবী আটক করে পুলিশে সোপর্দ করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রতারক মজিবুরের বাড়ি চান্দিনা উপজেলার নবাবপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আলী আহমেদ।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টে বিচারের জন্য এসে সাধারণ মানুষ এসব ভুয়া আইনজীবীদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। মামলার ফাইল করা, শুনানির জন্য তালিকায় আনা, বেঞ্চে শুনানি করা ও রায় বা আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরা নানা ভোগান্তির শিকার হন।
দালাল ও ভুয়া আইনজীবীর বিরুদ্ধে জামিন জালিয়াতি, জামিনের কথা বলে বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ফিরে আনতে হলে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানা গেছে, শিক্ষানবিস আইনজীবীও নয় এমন ব্যক্তিরাও আইনজীবী সেজে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে আসেন। এমনকি মামলার শুনানির জন্য কোর্টে যান। এসব ব্যক্তিকে টাউট-দালাল অভিহিত করে প্রতিহত করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আইনজীবী সমিতিগুলো।
এ পর্যন্ত আদালত অঙ্গন থেকে চার মাসে ছয়জনকে আটক করে মামলা এবং পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। মুচলেকা নিয়ে ৮-১০ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে এসব টাউট-দালাল উচ্ছেদ আমরা অভিযান শুরু করেছি। প্রতারকদের কারণে এ পেশায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনজীবী সমিতির প্রত্যেক সদস্যকে আইডি কার্ড দেয়া হয়েছে। সিনিয়র, জুনিয়র এমনকি শিক্ষানবিস আইনজীবীদেরও আইডি কার্ড দেয়া হয়েছে।
ক্লার্কদেরও আইডি কার্ড আছে। কিন্তু দালালদের কোনো আইডি কার্ড নেই। অথচ প্রতারকরা নিয়মিত কোর্টে এসে মামলা-মোকদ্দমার তদবির করছে। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আইনজীবীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশের সোপর্দ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জানান, জমি সংক্রান্ত মামলার কথা বলে নুরুল হক নামে এক ব্যক্তি আইনজীবীর সহকারী পরিচয় দিয়ে তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নেয়। কিন্তু পরে আর তার খোঁজ মেলেনি। এছাড়া নুরুল হকের প্রতারণার শিকার হয়েছেন সিলেটের মইনুল, টাঙ্গাইলের কামরুল ইসলামসহ অনেকে।
প্রতারক রেজাউল করিম : গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার দামান কর্মকার বাড়ী গ্রামের রেজাউল করিম (৫০) আইনজীবী পরিচয় দিয়ে বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। ১৮ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যরা তাকে হাতেনাতে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে করিম জানায় সে আইনজীবী নয়। এরপর তাকে শাহবাগ থানায় সোর্পদ করা হয়। তার বাবার নাম সোনা উল্লাহ।
প্রতারক নুরুল হক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার চারগাছ গ্রামের মো. নুরুল হক (৫৪) প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ৮ মে আইনজীবী সমিতির সদস্যরা তাকে হাতেনাতে আটক করে। সে প্রতারণার কথা স্বীকার করায় তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। তার বাবার নাম রজব আলী।
প্রতারক ইমরান : ফেনী সদর উপজেলার দক্ষিণ থানাবাড়ি গ্রামের মো. ইমরান (৫৮) ৯ মে হাতেনাতে ধরা পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদে আইনজীবী নয় বলে সে স্বীকার করে। তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তার বাবার নাম আবদুল গফুর।
প্রতারক শফিকুল বাশার : কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেনদি গ্রামের মো. শফিকুল বাশারকে (৪৬) ৯ মে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যরা হাতেনাতে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে থানায় সোপর্দ করা হয়। তার বাবার নাম আজিজুর রহমান।
প্রতারক তানজিমা তাসকিন : সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ অভিযানে রাজশাহীর বাগমারার তানজিমা তাসকিন ধরা পড়ে। তার বিরুদ্ধে ভুয়া আইনজীবীর মামলা দিয়ে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।
এ বিষয়ে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এক শ্রেণির টাউট নিজেদের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছে। এগুলো চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বার কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ আসলে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ফিরে আনতে হলে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আদালত প্রাঙ্গণে প্রতারকদের জায়গা নেই।