দ্যা ডেভিল’স অ্যাডভোকেট বইয়ের প্রচ্ছদ

বুক রিভিউ:The Devil’s Advocate- আইনজীবীদের পেশাগত উন্নয়নে অনুসরণীয়

রাম চন্দ্র দাশ:

“দ্যা ডেভিল’স অ্যাডভোকেট” বইটির নামকরণের কারণ হিসেবে লেখক প্রথম অধ্যায়েই বলেছেন, “এটি আইনপেশাকে একটি নতুন দিক থেকে দেখার দ্বার খুলে দিবে”! জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারী মামলা পরিচালনায় অত্যন্ত অভিজ্ঞ লন্ডন বারের ব্যারিস্টার ইয়ান মার্লি কিউসি ২১টি অধ্যায় সম্বলিত ২৭১ পৃষ্ঠার এই বইটি লিখেন ইংরেজি ভাষায়। সুইট ওম্যক্সওয়েল, ১০০ এ্যাভিনিউ কর্তৃক বইটির প্রথম প্রকাশ ২০০৫ সালে এবং এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। এটি ইউকে ও কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে একটি সর্বোচ্চ বিক্রিত বই- যা আইনপেশায় “কি করা যাবে, আর কি করা যাবে না” এর একটি নতুন পন্থা আনয়ন করে। বইটি সম্পর্কে বিখ্যাত অধ্যাপক এ আর ফরেস্ট (University of Sheffield, in Science and Justice) এর মন্তব্যটি এ রকম “Quite simple [this] is the book of its kind. Indeed it is the only book of its kind…..Buy this book. Study it. You won’t regret it.”

বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আদালতে (adversarial courtroom) একটি আদর্শ হ্যান্ডবুক ও প্রয়োগধর্মী গাইড হিসেবে দ্রুত পরিচিতি পেতে থাকে। বন্তুত, ৫ বৎসর পর্যন্ত নতুন আইনজীবীদের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। বইটি ফৌজদারী বিচার ব্যাবস্থাকে বিবেচনা করে লেখা হলেও এর অনেক নিয়মই দেওয়ানী আদালতেও প্রয়োগযোগ্য।

প্রথম অধ্যায়ে বইটি সম্পর্কে লেখক বলেন, “আকারে ছোট হওয়ায় এটি সহজে বহনযোগ্য। এটি নতুন আইনজীবীদের জন্য বহুমূখী ধারণায় পরিপূর্ণ। একটি মামলা নিয়ে চিন্তা করার সময় এই বইয়ে বার বার ডুব দিতে ইচ্ছে করবে। এর মাধ্যমে আইনপেশার দক্ষতা তাৎক্ষণিকভাবে অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে- এটা প্রায় নিশ্চিত। এটি কথোপকথনের ভঙ্গিতে লেখা যেখানে আমি অত্যন্ত আনন্দের সাখে সাগ্রহে আপনাদের সাখে কথা বলছি। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ১-২টি ধারণা বিবৃত আছে; কোন কোন পৃষ্ঠা খুবই সংক্ষিপ্ত। বইটি শুধুমাত্র পড়ে না গিয়ে, প্রতিটি পৃষ্ঠা সম্পর্কে গভীর চিন্তার অবকাশ আছে।”

এই পর্যালোচনাতে বইটির বিষয়বন্তুকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করে এর সার-সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে-

  • আইনপেশার বা ওকালতির সাধারণ কিছু ধারণা (যেমন আইনপেশা শেখা, বিচারে সত্যতা, মামলা জেতা),
  • আইনজীবীদের সাধারণ পেশাগত দক্ষতা (আদালতের মনোভাব, প্ররোচনা, বিচারকের প্রতি সম্ভোদন), এবং
  • মামলা পরিচালনা সংক্রান্ত দক্ষতাসমূহ (যেমন- মামলা প্রস্তুতকরণ, প্রারম্ভিক শুনানি, সাক্ষী-প্রশ্নকরণ, সাক্ষ্য গ্রহন- জবানবন্দি, জেরা, চুড়ান্ত শুনানি বা যুক্তিতর্ক)।

আইনপেশা বা ওকালতির সাধারণ কিছু ধারণা
ওকালতি (অ্যাডভোকেসি) শেখা (২য় অধ্যায়): ওকালতি একটি দক্ষতা; এটি প্ররোচিতকরণ (persuasion) বা যুক্তিসহকারে কাউকে বশকরণের দক্ষতা। অন্যান্য দক্ষতার মত এটি একটি স্তর পর্যন্ত শেখা যায়। অর্থাৎ ওকালতির ‘সামর্থ্য’ (competence) অর্জন বা শেখা যায়। আর সামর্থ অর্জন মানে ‘ভুল না করা’। মনে রাখতে হবে, নির্ভুল ওকালতি ছোট অর্জন নয়। অনুশীলন না করে শুধুমাত্র বই পড়লে পরিপূর্ণভাবে ওকালতি শেখা যাবে না। আমরা আসলে ‘ওকালতি করে করে শিখি’। তাই অনুশীলনের বিকল্প নাই। এই অনুশীলনের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষণ থাকা উচিত; আর এই অনুশীলন বর্তমান দক্ষতাকে বৃদ্ধি ও নতুন দক্ষতা সৃষ্টির। কোর্টের পাশাপাশি এই অনুশীলন হতে পারে আয়নার সামনে, হতে পারে বন্ধুদের সামনে এবং আরো হতে পারে মনের গহীনে।

সত্যতা বা truth (৩য় অধ্যায়): সত্যতা বিষয়ে লেখক বলেন, “বিচার ব্যাবস্থায় সত্যতা (truth) একটি জটিল (tricky) বিষয়! সম্ভবত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিচার ব্যবস্থায় যা বাস্তবে ঘটেছে, তা খুঁজে বের করা উচিত কিন্তু তা প্রায়ই ঘটে না। এর পরিবর্তে এটি একটি ভদ্রোচিত প্রতিযোগিতা সৃষ্ট করে। আসলে সত্যতা একটি বড় ধারণা; দার্শনিকরা হাজার হাজার বছর ধরে সততা নিয়ে লিখছেন। অনেকেই বলেন ‘বস্তুগত সত্যতা (objective truth)’ বলতে কিছু নাই; প্রকৃতপক্ষে আছে ‘বিভিন্ন অবস্থানগত-ভাবনা (different perspectives)’।” যদিও বস্তুগত সত্যতা থাকে, দুর্ভাগ্যবশত আদালত সবসময় তা খুঁজে পায় না। বাস্তব সত্য হল এই যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আইনপেশা প্রকৃতপক্ষে সত্য উদঘাটন নয়; এটি একটি সঠিকভবে পরিচালিত এক ধরনের প্রতিযোগিতা, যেখানে কিছু নিয়ম আছে এবং অপরপক্ষের আইনজীবীর থেকে এই নিয়মগুলোর অধিকতর সঠিক ব্যবহার করে মামালা জেতা সম্ভব।

মামলা জেতা (অধ্যায় ৪): আইনজীবী হিসাবে আইন ও নিয়মের মধ্য থেকে মামলা জেতাকে সকলেরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সাক্ষীর নিয়ম ও আইনের বিধানসমূহ জানতে হয়। এক্ষেত্রে লেখক সাধারণ পেশাগত বিধিসমূহের পাশাপাশি তিনটি প্রধান সততার-আলোকবর্তিকাকে (beacons of integrity) গুরুত্ব দিয়েছেন যা প্রত্যেক আইনজীবীর মধ্যে থাকা আবশ্যক-

  • আদালতকে কখনও মিথ্যা তথ্য (mislead) দিতে নাই। একজন আইনজীবীকে অবশ্যই বিচারক ও তার সহকর্মীর কাছে আস্থাভাজন হতে হবে; অন্যথায় তিনি প্ররোচনাধর্মী (persuasive) হতে পারবেন না।
  • সহকর্মীদের সাথে কড়াকড়ি (sharp practice) করতে নাই। প্রতিপক্ষ আইনজীবীর সাথে ‘বিনয় ও স্বচ্ছতা’ বজায় রাখা।
  • সর্বদাই আদালতের মত করে ভাবতে হবে। একজন আইনজীবী তখন আর কোন পক্ষের থাকেন না; আর নিরপেক্ষ থাকার মনোভাব অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আইনজীবীদের সাধারণ পেশাগত কিছু দক্ষতা
আদালতের মনোভাব অনুধাবন করা (অধ্যায় ৫): মনে রাখতে হবে, আদালত একধরণের শক্তি যা কে জিতবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন; আইনজীবী হিসাবে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা কিন্তু আপনার-আমার নয়। কাজেই আইনজীবী হিসেবে আমাদের কাজ হল- কিভাবে আদালতকে চিন্তা করতে হবে তার পথ দেখানো; পথ বলে দেওয়া নয়। এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য হল- ‘পথ বলে দেওয়া মানে- নির্দেশ করা (instruct)’; আর ‘পথ দেখানো মানে সহায়তা করা (assistance)’। তাই আইনজীবী একজন সহায়ক (facilitator)- যে আদালতকে তার মামলার যুক্তির সাথে সহজে একমত করাতে পারেন।

এক্ষেত্রে আইনজীবীদের একটা শব্দ মনে রাখতে হবে, সেটা হল ‘অপ্রতিরোধযোগ্য (irresistible)’। এ ক্ষেত্রে লেখক বলেন, “একজন বড় আইনজীবী তিনি নন- যিনি উচ্চস্বরে যুক্তি উপস্থাপন করেন ও বেশি বুদ্ধিমত্তার সাথে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; বরং তিনিই বড় আইনজীবী- যিনি এমনভাবে বলেন তা সঠিক, সহজবোধ্য এবং সাধারণভাবে সত্য বলে মনে হয়।”এছাড়া আদলতকে কখনোই অস্বস্তিতে ফেলবেন না। বরং কোন বিষয় আগে উত্থাপন করতে পারেন নাই বলে নিজের উপর দোষ দেন; ক্ষমা চেয়ে নিন।

প্ররোচনামূলকতা বা persuasiveness (অধ্যায় ছয়): আইনপেশা হল প্ররোচনার দক্ষতা। প্রশ্ন হল প্ররোচনা কী? কিভাবে এটি পরিমাপ করা যায়? একজন আইনজীবী প্ররোচনাকারী হন ‘আদালত যখন প্রমানের ভার ও মানদন্ডের ভিত্তিতে তার মামলাকে বেশি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন’। অর্থাৎ প্ররোচনার আসল জায়গা হল- প্রমানের ভার ও মানদন্ড (burden and standard of proof)। এই প্ররোচনার কলা-কৌশল ও দক্ষতার উন্নয়নের বিভিন্ন উপায় আছে এবং এগুলো শেখা যায়। নিচে এর কয়েকটি দেওয়া হল-

(১) ব্যক্তিগত উপস্থাপনার প্রধান দিকগুলো হল-

  • পরিচ্ছন্ন পোষাক একজন আইনজীবীকে আনুষ্ঠানিক ও ফ্যান্টাস্টিক দেখাবে; বিজয়ীর মতো দেখাবে;
  • আদলতের সকল কর্মচারী-কর্মকর্তার সাথে ভাল ব্যাবহার;
  • ব্যক্তিত্বপূর্ণ চলাফেরা- নির্ভয়ে জায়গা নিয়ে সোজা হয়ে বসা, সোজা হয়ে দাঁড়ানো, হাতকে নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং পুরো আদালতকক্ষকে মনযোগের সাথে উপভোগ করা;
  • মনের গভীর থেকে কথা বলা এবং ধীরে ধীরে উপস্থাপন করা;

(২) ব্যক্তিত্বের প্রধান দিকগুলো হল-

  • প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্বতা আছে তা অবশ্যই বজায় রাখা (অন্যের মত হওয়ার প্রয়োজন নাই);
  • মনযোগের সাথে অন্যের যুক্তি শোনা;
  • সমব্যাথী আচরণের মাধ্যমে আদালতের পছন্দ হিসাবে গণ্য হওয়া তবে তা কোনভাবেই মক্কেলের স্বার্থকে ত্যাগ করে নয়;
  • বিবেচনাবোধ বা বিচারিকবোধ- যা একজন আইনজীবীর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন;
  • সম্মান বজায় রাখা- এর জন্য দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ (১) বিচারকের প্রতি সম্মান ও (২) সবসময় সকলের প্রতি বিনয়ী হওয়া;
  • সহজভাবে বলা- ভারী-শব্দ, লম্বা ও জটিল এবং শর্তামূলক বাক্য বলার চেয়ে সহজবোধ্যভাবে বলা বেশি প্ররোচনামূলক;
  • সংক্ষিপ্তভাবে বলুন, কিন্তু এমনভাবে বলুন যেন জীবন্ত মনে হয়; প্রয়োজনে প্রাসঙ্গিক গল্প বলুন।

(৩) অপ্রতিরোধযোগ্য (irresistible)- এর প্রধান তিন উপাদান, (১) গ্রহণযোগ্য (reasonable), (১) খুবই বিনয়ের সাথে উপস্থাপন, ও (৩) কমনসেন্সে’র প্রয়োগ। অপ্রতিরোধযোগ্য যুুক্তিতর্ক সাধারণত সহজবোধ্য ও সাধারণ মানের হয়ে থাকে। লর্ড ডেনিং সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে- “তিনি যখন সহজবোধ্যভাবে এবং হৃদ্ধতারসাথে কমন-সেন্স প্রয়োগ করে কিছু উপস্থাপন করতেন তখন মনে হতো তিনি অবশ্যই সঠিক বলেছেন”।

বিচারকের প্রতি সম্বোধন (অধ্যায় আট): বিচারকরা সমাজে এক ধরণের আনুষ্ঠানিক অবস্থান দখল করে আছেন এবং আইনের আওতায় তার অনেক ক্ষমতা । কাজেই বিচারক সম্পর্কে জানা আইনজীবীর দায়িত্বে অংশ। আর যতটুকু জানলেন ততটুকুই আপনার মামলার সুবিধার্থে ব্যাবহার করতে পরবেন এবং বিচারকের প্রত্যাশা অনুযায়ী মামলার প্রস্তুতি থেকে সম্বোধন পর্যন্ত আরো উন্নত করতে পারেন। এক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে-

(১) কাজেই বিচারকের প্রতি আইনজীবীর আচরণ হবে- (কা) সম্মান, (খ) সদাচরণ ও (গ) বিনয়ে পরিপূর্ণ।
(২) আইনজীবীর উপস্থাপন হবে সংক্ষিপ্ত; কোনকিছুই অতিরিক্ত বলার প্রয়োজন নাই।
(৩) একটি বিষয় একবারই বলবেন; তবে খেয়াল রাখতে হবে যে বিষয়টি বিজ্ঞ বিচারক বুঝতে পেরেছেন।
(৪) আইনজীবীদের সূচনা বক্তব্যটি হবে পুরোপুরি অনুশীলকৃত। এটি মামলার প্রায় সকল প্রধান পয়েন্টগুলো যা আপনি বলতে চান তা কভার করবে অর্থাৎ একটি স্পষ্ট সারমর্ম হবে।
(৫) মনে করার কোন কারণ নেই যে বিচারক সব আইনই জানেন; কাজেই তাকে আইনের সংশ্লিষ্ট অংশ মনে করে দিতে হয় এবং এর জন্য ভীত হওয়ার কিছু নাই। আইনের সংশ্লিষ্ট অংশটি ধীরে ধীরে পড়ুন বিচারক যেন আপনার সাথে পড়ে যেতে পারেন।
(৬) বিচারকরা অনেক সময়ই শুনানির একটি কাঠামো (skeleton) বা সারমর্ম পেলে খুশি হন; কাঠামোটি হবে একটি সংক্ষিপ্ত দলিল যাতে আইনের রেফারেন্সসহ যুক্তিতর্কের প্রধানদিকসমূহ থাকবে-
(ক) প্রয়োজনীয় তথ্যাদি,
(খ) প্রাসঙ্গিক আইন, ও
(গ) প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কিভাবে আইন দ্ধারা সমর্থিত।
(৭) পরিশেষে, বিচারককে যখন সম্বোধন করবেন তখন তাঁর দৃষ্টিভংগি দিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। আর এভাবেই আইনজীবীরা বিচারককে সহায়তা (assist) করেন এবং বিচারক আপনার সহায়তাকে মূল্যায়ন করবেন।

৩. মামলা পরিচালনা সংক্রান্ত দক্ষতাসমূহ
মামলা প্রস্তুতকরণ (অধ্যায় সাত): ফৌজদারী মামলার শুরু ও শেষ হয় চার্জ দিয়ে; আর দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে প্লিডিংস (আরজি ও লিখিত জবাব)। কাজেই কিছু করার আগে এগুলো ভালোভাবে পড়তে হবে। সরাসরি এগুলো পড়ে দু’টি জিনিস বের করতে হবে- (১) অবশ্যই কী কী প্রমাণ করতে হবে, এবং (২) কোন কোন মানদন্ডে প্রমাণ করতে হবে। সাধারণত বাদীপক্ষকেই মামলা প্রমাণ করতে হয়। যখন বুঝা যাবে কী প্রমাণ করতে হবে, তখন কিভাবে প্রমাণ করতে হবে তা ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে মামলা প্রমাণ করতে হবে সাক্ষী দিয়ে (আইনজীবী দিয়ে নয়)। আদর্শিকভাবে অবশ্যপালনীয় হল- মামলার সকল তথ্যাদি কমপক্ষে তিন বার পড়তে হবে; কমপক্ষে ৩ বার।

এরপরই লেখক পরামর্শ দিয়েছেন ‘চুড়ান্ত যুক্তিতর্ক’ এর একটি খসড়া তৈরি করতে। চুড়ান্ত যুক্তিতর্কের প্রধান উপাদান হল আইনজীবীর আইনী মন্তব্য ও সাক্ষ্যের বিবরণের মিশ্রণ (mixture of comments and reference to the evidence)। যখন আপনি চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক তৈরি করবেন, তখন আপনি সাক্ষীর মাধ্যমে আপনি কী কী সাক্ষ্য-প্রমাণ বের করতে হবে তাও জানবেন। আর তখন কোন সাক্ষীর কাছ থেকে কী কী তথ্য-প্রমাণ বের করতে হবে তা জেনে যাবেন। আর খসড়া চূড়ান্ত যুক্তিতর্কের জন্য নিচের পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন-
 প্রথমে পয়েন্টগুলো লিখে ফেলুন;
 পয়েন্টগুলোর উপর প্রতিফলন করুন (পুনর্বার ভাবুন);
 আবার লিখুন;
 কিছু অকাজের পয়েন্ট বাদ দিন;
 কিছু যোগ করুন;
 আবার ফ্রেশ করে লিখুন।

মামলার প্রস্তুতি পর্বে লেখক চুড়ান্ত যুক্তিতর্কের খসড়া তৈরির বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, “এটা আসলে একজন আইনজীবী বিচারিক পর্যায়ে (ট্রায়ল স্টেজে) পর্যায়ে কী করবেন তা সংজ্ঞায়িত করে; অতিপ্রয়োজনীয়ভাবে এটা মামলার মানচিত্র।”

প্রারম্ভিক শুনানি- Opening speech (অধ্যায় নয়): এই অধ্যায়টি ফৌজদারী মামলাকে সামনে রেখে সাজানো হয়েছে যা সাধারনত প্রসিকিউসনকে উপস্থাপন করতে হয়। ক্রমনুসারে সাজালে এমন হয়-
(ক) পুরো ঘটনাটি একটি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সারমর্ম আকারে উপস্থাপন;
(খ) এরপর প্রমাণের ভার ও মানদন্ড ব্যাখ্যা করা;
(গ) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ; ও
(ঘ) প্রাসঙ্গিক আইনী ব্যাখ্যা। আইনী ব্যাখ্যাটি দিতে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যাতে সঠিক ও সংক্ষিপ্ত হয়।

প্রারম্ভিক শুনানি ধীরলয়ে যথেষ্ট বিরতি দিয়ে উপস্থাপন করা উচিত, যাতে বিচারকর মামলাটি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট পেতে পারেন। কোনভাবেই তাড়া করার প্রয়োজন নেই, তবে সহজবোধ্য করতে হবে।শুনানি শেষে বিচারক যেন নিচের ৩টি বিষয় নিয়ে ভাবতে পারেন; ফলে তিনি আপনার সম্পর্কে ভাববেন এবং আপনাকে তার গাইড হিসাবে চিহ্নিত করবেন –
(ক) আইনজীবীর একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও চেতনাসম্পন্ন মানুষ;
(খ) বিচারক মামলার বিষয়বস্তু বুঝতে সক্ষম হয়েছেন;
(গ) বিচারক যেন বুঝতে পারেন কী ধরনের সাক্ষীর কাছ থেকে কী কী সাক্ষ্য গ্রহন করা প্রয়োজন হবে।

সাক্ষী (অধ্যায় দশ): আমরা জানি মামলা প্রমাণ করতে হয় এবং এ জন্য সাক্ষীর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ! কাজেই সাক্ষীকে কিভাবে পরিচালনা করতে হবে এ সম্পর্কে লেখক সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন।

আইনজীবীদের অনেক প্রিভিলিজ থাকে, ফলে তারা জনসম্মুখে মানুষকে অনেক ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারেন এমনকি উত্তর দিতে বাধ্য করতে পারেন। কিছু আইনজীবীর এই প্রিভিলিজ এর মাত্রারিক্ত ব্যবহারের ফলে অনেক মানুষের জীবনে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। লেখকের মতে কোনভাবেই এরকম করা উচিত নয়, কারণ সাক্ষীরাও মানুষ; বরং তাদের সাথে তিনি সর্বদাই বিনয়ী হতে পরামর্শ দিয়েছেন।

একজন আইনজীবী যখন সাক্ষীর প্রতি এরূপ রূঢ় আচরণ করেন তখন তাকে রুক্ষ দেখায় ফলে তিনি সম্মান হারান; আইনজীবী যখন প্রতি-উত্তর দেন তখন তাকে মামলাতে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত বলে মনে হয়। কাজেই সাক্ষ্য গ্রহনের সময় আইনজীবীর প্রতি নিচের পরামর্শ দিয়েছেন-
(ক) সাক্ষীকে স্বস্তি দিন এবং তাকে ধীরে ধীরে স্থিত দিন;
(খ) সহজ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করুন এবং নিশ্চিত করুন যে প্রশ্নগুলো সহজ ভষায় করা হচ্ছে;
(গ) একটি মাত্র প্রশ্ন একবারে করুন;
(ঘ) সাক্ষীর দিকে তাকান, চোখের সংযোগ স্থাপন করুন;
(ঙ) মৃদু-হাসি হাসেন
(চ) সক্ষীকে কণ্ঠের স্বর উঁচু করতে বলুন;
(ছ) বিচারকের প্রতি তাকিয়ে কথা বলতে বলুন, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে:
(জ) সাক্ষীকে প্রশ্নোত্তরের একটি পদ্ধতিতে অভ্যস্থ করে ফেলুন এবং তাকে কথোপকথনে উৎসাহিত করুন।
কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, সাক্ষীর সাথে আপনার কথোপকথন বা প্রশ্নোত্তের গতি যেন বিচারকের গতির সাথে মিল থাকে।

প্রশ্ন (অধ্যায় এগার): সাক্ষ্য গ্রহণ করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে সঠিক প্রশ্ন; তাই লেখক বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্নের উপর আলাদা একটি অধ্যায় রেখেছেন। প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নিচের দিকগুলো নজর রাখতে লেখক পরামর্শ দিয়েছেন-
(১) প্রথম শর্ত হল প্রশ্ন হবে সংক্ষিপ্ত এবং একটি প্রশ্নের মাধ্যমে একটি তথ্যের উত্তর খুঁজতে হবে। একাধিক প্রশ্ন একসাথে করলে সাক্ষী দ্বিধান্বিত হয়, তার যেটা মনে হয় সেটার উত্তর দেয়। ফলে সাক্ষ্য নেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
(২) কোন প্রশ্ন করার আগে অবশ্যই এ প্রশ্নের উত্তর জেনে নিন; মনে রাখতে হবে, আইনজীবীর অজানা প্রশ্নের উত্তর মামলার বিপক্ষে যেতে পারে।
(৩) একটি প্রশ্নের উত্তর শেষ করে নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে নতুন প্রশ্ন করুন- যাতে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
অনেক আইনজীবী দুই প্রশ্নের বিরতিকালীন সময়ের শূণ্যস্থান পূরণের জন্য অলসভাবে প্রশ্নের পুনারাবৃত্তি করেন। এতে বিরক্তি তৈরি হয়।

জবানবন্দি (অধ্যায় বার): সাক্ষী শুরু হয় জবানবন্দি দিয়ে। এটাকে অনেকেই সবচেয়ে কঠিন বলে অখ্যায়িত করেন- কারণ ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন (leading question) ছাড়াই আইনজীবীকে অবশ্যই তার মামলার প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য তুলে আনতে হয়। যে প্রশ্নের মধ্যে উত্তর দেওয়া থাকে সেটাই হল ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন। যদিও ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন ও ইঙ্গিতবিহীন (leading and non-leading) প্রশ্নের মধ্যে পার্থক্যকরণ অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।

ইঙ্গিতবিহীন প্রশ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হল এটি সাধারণত কে, কি, কেন, কখন, কোথায়, কিভাবে, ব্যাখ্যা করুন- এগুলোর কোন একটির মাধ্যমে প্রশ্ন করা হয়; আর এগুলোর মাধ্যমে ইঙ্গিতবিহীন প্রশ্ন হলে বলে ‘মুক্ত প্রশ্ন’ (open question) বা ‘সরাসরি প্রশ্ন’ (direct question)। কিন্তু আরেক ধরনের ইঙ্গিতবিহীন প্রশ্ন আছে তাকে বদ্ধ-প্রশ্ন (close question) বলা যায়- যার মাধ্যমে সাক্ষীর পছন্দকে সীমিত করা হয়। এধরনের প্রশ্ন আবার ২ ধরনের; যথা-
(ক) শব্দের পছন্দ অর্থাৎ ২ বা ততোধিক শব্দের পছন্দ দেওয়া থাকে প্রশ্নে (লোকটি লম্বা, খাট না মাঝারি? উত্তর হবে যেকোন একটি) এবং
(খ) হ্যাঁ বা না এর পছন্দ (লোকটি কি লম্বা? উত্তর হবে হ্যাঁ বা না)।

লেখক কোন বিষয়ে প্রশ্নমালা করতে প্রথমে মুক্ত প্রশ্ন দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে বদ্ধ-প্রশ্ন করতে পরামর্শ দিয়েছেন এবং বদ্ধ-প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সাক্ষীকে প্রকৃত পছন্দ দিতে পরামর্শ দিয়েছেন।

সাক্ষীকে প্রথমে সহজ প্রশ্ন করে স্বাভাবিক হতে দিতে হবে, তারপর ক্রমান্বয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জবানবন্দি শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল আপনার উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার হতে হবে- যে উদ্দেশ্য মামলা পেয়েই স্থির করেছিলেন এবং এর ভিত্তিতে আপনি খসড়া চুড়ান্ত যুক্তিতর্ক তৈরি করেছিলেন। সর্বশেষ মনে রাখতে হবে জবানবন্দি কিন্তু সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ নয়, এটি হলচুড়ান্ত যুক্তিতর্কে যা প্রয়োজন তার ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদ এবং যতটা সংক্ষিপ্ত করা যায় তাই করতে হবে।

জেরা (অধ্যায় তের): আইনের শিক্ষার্থীরা অনেকেই কলেজ- বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সাক্ষীর জেরা করার স্বপ্ন দেখেন, কারণ এটি রোমঞ্চকর। জেরায় সাক্ষী আপনার সাথে একমত হবেন না, আপনার প্রশ্ন বুঝবেন না, অনেক সময় সঠিক উত্তর দিবেন না, অস্পষ্ট উত্তরদিবেন; সে আপনার প্রশ্নকে অজুহাত বানিয়ে আপনার দুর্বল জায়গাকে পুনর্বার বলতে বলবে এবং আপনার মামলাকে দুর্বল করে দিতে চেষ্টা করবে।

প্রতিটি প্রশ্নই একেকটি বিপদকে আমন্ত্রন জানাতে পারে! কাজেই প্রথম চিন্তাই হবে- ‘জেরা না করা’!নিজেকে প্রশ্ন করেন, আসলেই এটি প্রয়োজন কি না? সর্বদাই আপনার চিন্তার ভিত্তি হবে এটি এড়ানো যায় কিনা? শেষ পর্যন্ত যদি জেরা করতেই হয় তবে আছে ১০টি নিয়ম; দশটি! প্রথম ৫-বছর এই ১০টি নিয়ম না ভাঙতে লেখক পরামর্শ দিয়েছেন। কাজেই অবধারিতভাবেই এই ১০টি নিয়ম শিখতে হবে; ঘুমের মধ্যেও এটা নিয়ে ভাবতে হবে।
নিয়ম ১ : কমান্ডোর মত চিন্তা করতে হবে। ভিতরে ঢুকবেন, যা প্রয়োজন বের করে নিবেন এবং বেরিয়ে যাবেন!
নিয়ম ২ : আপনার পূর্বে তৈরিকৃত যুক্তিতর্কের প্রয়োজনীয় উপদান পেয়ে গেলে থেমে যান; থেমে যান!
নিয়ম ৩ : কখনোই এমন প্রশ্ন করবেন না যে প্রশ্নে উত্তর আপনি জানে না। করলে এটি বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নিয়ম ৪ : সর্বদাই ইঙ্গিতপূর্ণ (leading) প্রশ্ন করেন; যাতে সাক্ষী আপনার নিয়ন্ত্রনে থাকে।
নিয়ম ৫ : কখনোই সাক্ষীকে ’ব্যাখ্যা করতে’ বলবেন না; ’কেন’ জিজ্ঞেস করবেন না।
নিয়ম ৬ : কোন (আইনী) মন্তব্য (comment) করবেন না; এটি সংরক্ষিত রাখুন বিচারকের জন্য।
নিয়ম ৭ : কখনোই সাক্ষীর সাহায্য প্রার্থনা করবেন না।
নিয়ম ৮ : একটি প্রশ্নে একটি বিষয়েই জিজ্ঞেস করুন।
নিয়ম ৯ : আপনি আপনার মামলার বিষয়ে এমন কিছু প্রশ্ন/সাজেশন করবেন- যা সাক্ষী আপনার সাথে সাধারণত একমত হবেন না (সাজেশন)।
নিয়ম ১০ : উভয়-সংকটধর্মী প্রশ্ন করুন; সাক্ষী যাই উত্তর দেন যেন তার বিপক্ষে যায় (সাক্ষীর উত্তরের অসামঞ্জস্য বের করে)।

তবে যে ধরণের প্রশ্নই করুন না কেন, সাক্ষীর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধ বজায় রাখতে লেখক পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আপনি পেশাদার, আপনি এক্সপার্ট!

চুড়ান্ত যুক্তিতর্ক বা শুনানি- closing speech (ষোড়ষ অধ্যায়) : অনেকেই বলেন আইনজীবীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র ‘জেরা’; লেখক বলেন, “এটা সত্য নয়, চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আইনজীবীর অস্ত্র, আর্ট এবং প্ররোচনার মূহূর্ত”। একটি ভাল যুক্তিতর্ক একটি খারাপ জেরার দুর্বলতাকে কাটিয়ে তুলতে পারে। চূড়ান্ত যুক্তিতর্কের পুরোটাই হল আইনজীবীর প্ররোচনা। একটি প্ররোচনামূলক চুড়ান্ত যুক্তিতর্ক (persuasive closing speech) তৈরি ও উপস্থাপন করতে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে-
(১) যথেষ্ট সময় নিয়ে এটি লিখে ফেলতে হবে। প্রথমেই একটি বিস্তারিত নোট তৈরি করতে হবে; প্রতিটি বাক্য যা আপনি বলতে চান তা অবশ্যই লিখে ফেলতে হবে।
(২) চুড়ান্ত যুক্তিতর্কের মূল বিষয়টাই হল- আপনি বিচারককে বলবেন আপনি কেন মামলায় জিতবেন। আপনি যখন লিখা শুরু করবেন তখন আপনার মাথার মধ্যে যে বিষয়টি প্রাধান্য পাবে সেটি হল- “আমরা জিতব কারণ——”। এরকম অনেকগুলো কারণ———-। এটি সাক্ষ্যের উপর ধারাবাহিক আইনগত মন্তব্য। কাজেই আপনাকে প্রয়োজনীয় কথাগুলো অবশ্যই বলতে হবে।
(৩) আপনার চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক ৩টি সবচেয়ে ভাল পয়েন্ট দিয়ে শুরু করুন। এর একটি সারাংশ বলুন; তার পর বিস্তারিত বলুন এবং পরিশেষে আবার পয়েন্টগুলো বলুন। ফলে বিচারক আপনার পয়েন্ট মনে রাখবেন- এটা আশা করা যায়।
(৪) আপনি প্রতিটি যুক্তির পিছনে ৩টি কারণ বলুন। যেমন- এই সাক্ষীর সাক্ষ্য অবিশ্বাসযোগ্য, অস্পষ্ট ও অতিকথন। এখানে সংখ্যা ৩ একটি মজার সংখ্যা। আপনি যখন ৩টি কারণ বলবেন, এটি ওজন বহন করে, আলোড়ন তৈরি করবে। যেন পুরো আদালত কক্ষে ঢেউ বয়ে যায় এবং আপনাকে মনে হবে অপ্রতিরোধ্য (irresistible)।
(৫) কথা বলার সময় বিনয়ী ভঙ্গিতে আপনার কণ্ঠের উঠানামা করাবেন কারণ এটি শুনতে ভাল লাগে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট শব্দে গুরুত্বারোপ করেন। শান্তভাবে প্রয়োজনীয় বাক্যটিতে বিনয়ী ভঙ্গিতে কন্ঠ উঁচিয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
(৬) বিনয়ীভাবে হাত ও বাহু নাড়িয়ে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষন করা- বক্তব্য প্রাণবন্ত করার অন্যতম টুলস। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে এটি যেন উদ্দেশ্যর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
(৭) চূড়ান্ত শুনানীটি অবশ্যই অনুশীন করুন; গুরুত্বসহকারে অনুশীলন করুন। আয়নার সাহায্য নিতে পারেন। আপনার উপন্থাপনের উন্নতি পর্যবেক্ষণের জন্য ভিডিও করে রাখতে পারেন।
(৮) আপনার কথাগুলো আপনিই মনযোগ দিয়ে শুনুন এবং ধারাবাহিকতা ও গতি বজায় থাকছে কি না খেয়াল রাখুন। এটি যেন সংশ্লিষ্টদের মনে বিশেষ করে বিচারকের মন ছুঁয়ে যায়।
(৯) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম- আপনার মতামতকে এমনভাবে প্রকাশ করুন তা যেন বিচারকেরই মতামত। এজন্য বিচারকের প্রতি সম্বোধনে নিচের বাক্যাংশগুলো ব্যাবহার করার জন্য লেখক পরামর্শ দিয়েছেন-
“ (ক) আপনি অনুভব করে থাকবেন যে, বিপক্ষ সাক্ষী সত্য বলছেন না—-
(খ) আপনাকে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছি———-
(গ) এই বিষয়টি আপনার সিদ্ধান্তের জন্য উপন্থাপন করলাম—-
(ঘ) বিষয়টিআপনার মূল্যায়নের দাবী রাখে———”
অপরদিকে, “আমি বিশ্বাস করি—, আমার মতে—-, আপনার বিশ্বাস করা উচিত—— এভাবে মতামত দেওয়া কখনোই উচিত নয়।
(১০) সবশেষে, প্রতিটি বিষয় যত্ন ও শোভন আকারে উপস্থাপন করুন। মনে রাখতে হবে যে, একটি কার্যকরী চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করাতে আপনি কি বললেন তারচেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আপনি কিভাবে বললেন।

উপসংহার টানতে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, নতুন আইনজীবীদের জন্য “The Devil’s Advocate” একটি দুর্দান্ত গাইড বা অনুসরণিকা। আদালতে অনুশীলনের প্রায় সব বিষয়ের উপর বেশ সহজবোধ্যভাবে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও মামলা ড্রাফট বা মুসিবিধা করার ব্যাপারে তেমন কোন বক্তব্য নাই- যা হয়তো এতো স্বল্প পরিসরে সম্ভবও নয়। তবে আইনপেশা যে একটি উঁচুমানের দক্ষতামূলক ও প্ররোচনামূলক পেশা এবং কিভাবে এই দক্ষতা ও প্ররোচনা নির্ভুল করতে পারি- এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে যে সাবলীল বর্ণনা আমরা পাই তাতে উচ্ছ্বাসিত হওয়ার মত; আমি সত্যই এই বই পড়ে উচ্ছ্বাসিত হয়েছি! সংক্ষিপ্ত হলেও কিছু প্রয়োজনীয় উদাহরণ এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা পড়েই আদালতে প্রয়োগ করা সম্ভব। বিশ অধ্যায়ে লেখক আইনপেশার দক্ষতা উন্নয়নের অনুশীলনের জন্য ৬-স্তর বিশিষ্ট ট্যাকনিক আলোচনা করেছেন- যা স্টাডি গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে চর্চা করা সম্ভব; এবং তিনি এই অধ্যায়ের শেষে বলেছেন, “একজন তরুণ আইনজীবীর হরানোর কিছু নেই, বরং বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীদের সকল ভাল ধারণাগুলো শিখে নেওয়ার অবারিতসুযোগ থাকে।” অন্যদিকে লেখক শেষ অধ্যায়ে (একুশ) একজন সার্বিকভাবে ভাল আইনজীবীর বৈশিষ্ট্যের যে ছবি এঁকেছেন তা হল- “ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চলাফেরা, চোখের সংযোগ, কমনসেন্স, অপরপক্ষের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক, ভাল প্রশ্ন করার সামর্থ, একটি উঁচুমানের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক (যা ট্রায়েল শুরু হওয়ার আগেই খসড়া তৈরি করতে হয়) এবং সবসময়ই বিচারকের মতো করে ভাবতে পারা। এসব বৈশিষ্ট্য একজন আইনজীবীকে গুণে-মানে-দক্ষতায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে পারে।” বিগত ২ বছরে কয়েকবার পড়ে এই প্রতিফলন বা পর্যালোচনা লেখার প্রয়াস- যা বইটির বিষয়বন্তু আয়ত্বকরণে আমাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। এই পর্যালোচনা পাঠ করে আপনাদের অনেকেরই ভাল লাগবে; পুরো বইটি পড়তে আপনারা উৎসাহিত হবেন এবং আপনাদের পেশাগত উন্নয়নে কাজে লাগবে এই প্রত্যাশা করছি। বইটি পড়ে পড়ে আদালত পর্যবেক্ষণ করলে এবং প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে আমাদের আরধ্য উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।

লেখক : অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট।