অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান

বিচারিক আদালতের ভাষা বিতর্ক

মোহাম্মদ মশিউর রহমান:

বহু বছর আইন-আদালত করার পর হঠাৎ চোখ পড়ল দেওয়ানী কার্যবিধি আইন ১৯০৮ এর ১৩৭ ধারার উপর। একটুভরকেই গেলাম। বিচারিক দেওয়ানী আদালতের ভাষা এখনো ইংরেজি? ১৯০৮ইং সনের ২১ মার্চ পাশকৃত এবং ১৯০৯ইং সনের ১লা জানুয়ারী হতে কার্যকর হওয়া এ আইনটি ইংরেজিতে লিখা এবং এর ১৩৭ ধারার মাধ্যমে দেওয়ানী বিচারিক আদালতের ভাষাকেও ইংরেজি হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রায় ১১০ বছর আগে এ অঞ্চল ইংরেজরা শাসন করত বলে এবং এ আইনটি সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য পাশ করা হয়েছিল বলে এর ভাষা এবং আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে স্বীকৃতি বড় বেশী অস্বাভাবিক নয়। কিন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে এবং ভাষা আন্দোলন করে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে টিকিয়ে রাখার দেশে কেন বিচারিক আদালতের ভাষা এখনো ইংরেজি হতে হবে?

বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক! গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর ৩ অনুচ্ছেদ মতে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ২৩ অনুচ্ছেদ মতে জাতীয় ভাষার পরিপোষন ও উন্নয়নব্যবস্থা গ্রহন এবং ১৫৩ অনুচ্ছেদ মতে বাংলায় সংবিধানের পাঠ থাকা এবং ইংরেজিতে এর অনুদিত পাঠ থাকার কথা। একইসাথে বাংলা ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

পরবর্তীতে ১৯৮৭ইং সনের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের প্রস্তাবনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পুর্নরুপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে এ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ আছে। এর ৩(১) ধারায় বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে মর্মে বলা আছে। এমনকি বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষায় আবেদন-আপীল করলে তা বেআইনী হবে এবং এসকল কার্য অফিসারদের পেশাগত অসদাচরণ হবে এবং তারা চাকুরীবিধির আওতায় শাস্তির সম্মুখীন হবেন বলে বিধান করা হয়েছে।

অধিকন্তু ১৯৭৫ইং সনের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত সরকারী নির্দেশ জারী করেন। এ নির্দেশে অত্যন্ত দুঃখের সাথে স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির সতর্কতাও করা হয়েছে। তৎপর ২০১১ইং সনের ৯ ফেব্রুয়ারী আইন মন্ত্রনালয়ের কাছে দাখিলকৃত আইন কমিশনের পেশকৃত সুপারিশেও বিচারিক আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারে গেজেট প্রকাশের কথা বলা হয় কিন্ত তাতেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।

দেওয়ানী কার্যবিধির ১৩৭ ধারা বিষয়ক মোহাম্মদ হাসমত উল্লা বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য মামলায় বিচারপতি এআরএম আমিরুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি এএম মাহমুদুর রহমান গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৯৯১ইং সনের ২৮ নভেম্বর একটি রায় দিয়েছেন (৪৪ ঢাকা ল’ রিপোর্ট ৩৩২)। ঘটনা ও আইনগত অবস্থা প্রায় এক হওয়ায় এ রায়ের মাধ্যমে আরো মোট ১৮টি মামলা নিস্পত্তি করা হয়েছে।

বর্ণিত মামলাগুলোয় বাদী বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ পাশ হওয়ার পরও ইংরেজিতে আরজি লিখে তা আদালতে দাখিল করায় বিবাদীগণ আরজি খারিজের জন্য আবেদন করেন। বিবাদীগণের যুক্তি, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩ ধারা মোতাবেক বাংলায় আরজি লিখতে হবে এবং সেকারনে ইংরেজিতে লিখা আরজির মামলা চলতে পারেনা। বিচারিক আদালত আরজি খারিজের দরখাস্ত গুলো খারিজ করলে বিবাদীগণ এসকল আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে সিভিল রিভিশন দায়ের করেন।

এ রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ তিনটি পরিভাষার কথা বলেছেন- রাষ্ট্রভাষা, সরকারী ভাষা ও আদালতের ভাষা। এ তিনটি ভাষার মধ্যে আদালতের ভাষা সবচেয়ে সংকীর্ণতম। আদালতের কথায়, রাষ্ট্রভাষা হলো রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম অর্থাৎ নির্বাহী, আইন বিভাগ ও বিচারিক প্রভৃতি বিষয়ে ব্যবহৃত ভাষা। সরকারী কার্যক্রম যে ভাষায় চলবে, তা সরকারী ভাষা আর আদালতের কার্যক্রম যে ভাষায় চলবে, তাই আদালতের ভাষা। যেহেতু আদালতের ভাষাটি সবচেয়ে সংকীর্ণতম তাই তাকে রাষ্ট্রভাষা বুঝাবে না এবং সেকারনে সংবিধানের ভাষা বিষয়ক স্কীম মানার আবশ্যকীয়তা নাই।

আদালতের মতে- বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি সাধারণ আইন এবং সিভিল প্রসিডিউর কোড বা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড বিশেষ আইন। আইনপ্রণেতাগণ বিশেষ আইনের ব্যাপারে সজাগ ছিলেন এবং যেহেতু বাংলা প্রচলন আইনের মাধ্যমে বিশেষ আইনগুলোর বিধানকে বাতিল করা হয়নি তাই বিচারিক আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহারের আবশ্যকীয়তা নাই। একইসাথে পরবর্তী সাধারণ আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা ছাড়া পূর্ববর্তী বিশেষ আইনের বিধানকে অমান্য করার সুযোগ নাই। বাংলাদেশের সংবিধানে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে বাধা না থাকায় এবং বাংলাভাষা প্রচলন আইনে সুস্পষ্টভাবে বারণ না করায় বিচারিক আদালতের ভাষা ইংরেজি হতে বাধা নেই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করেন।

  • তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বিচারিক আদালতে বাংলা প্রচলনের তরিকা কি?

উত্তর হচ্ছে- দেওয়ানী কার্যবিধি আইন ১৯০৮ এর ১৩৭(২) ধারা মোতাবেক সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিচারিক আদালতের ভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করতে পারেন। মোহাম্মদ হাসমত উল্লা বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য মামলায়ও হাইকোর্ট বিভাগ স্পষ্টভাবে বলেছেন, দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১৩৭(২) ধারায় সরকারের ক্ষমতার কথা। এমনকি আইন কমিশনের বিগত ২০১১ইং সনের ৯ ফেব্রুয়ারী তারিখে আইন মন্ত্রনালয়ে পেশকৃত সুপারিশেও একই মত সমর্থন করেন।

  • এক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের কি কোন ভূমিকা আছে?

বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদ মতে সুপ্রীম কোর্ট তার নিজের জন্য ও বিচারিক আদালতের জন্য বিধি প্রণয়ন করতে পারে। দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১২২ ধারা মোতাবেক সুপ্রীম কোর্ট কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিধি প্রণয়ন করতে পারেন। উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে তা কার্যকর হবে।

বিচারপ্রার্থীর বিচার পাওয়ার অধিকার মৌলিক ও সংবিধান সম্মত। বিচারকে ন্যায়বিচারে পরিনত করতে হলে অবশ্যই তা হতে হবে মাতৃভাষায়। বিচারের মানদন্ড বুঝতে এবং ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরী করতে মাতৃভাষাই উত্তম পথ। শতবছর আগের আইনের পরিবর্তন না করা জাতিগত হীনমন্যতা। এ থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসা যায় ততই মঙ্গল।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।