স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে এবং এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। সরকারি অফিসের নথিপত্র, চিঠির ভাষা এখন প্রায় শত ভাগই বাংলা লেখা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে এখনও ইংরেজির প্রাধান্য চলছে, আর সেটি হলো বিচার বিভাগ।
উচ্চ আদালতে এখনও সিংহভাগ রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। তবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে মাসজুড়েই বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চের ২ বিচারপতি। তারা হলেন- বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চলতি মাসের ১৫ কার্য দিবসে এক হাজার ৮১২টি রায় ও আদেশ দিয়েছেন বাংলায়। এর মধ্যে রায় এক হাজার ১৭৫টি এবং আদেশ ৬৩৭টি।
এ দুই বিচারপতি ছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগে আরও ১০ বিচারপতি রয়েছেন, যারা বছরের বিভিন্ন সময় কমবেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন, যা উচ্চ আদালতে মোট বিচারকের ১২ শতাংশ। সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে আপিল বিভাগে সাতজন ও হাইকোর্ট বিভাগে ৯৭ বিচারপতি কর্মরত।
এই ১২ জন হলেন- (জ্যেষ্ঠতা অনুসারে) বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।
এদের মধ্যে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সবচেয়ে বেশি রায় ও আদেশ বাংলায় লিখে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এর পরই আছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। অন্যরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমবেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। যাদের মধ্যে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হত্যা মামলায় মাতৃভাষা বাংলায় ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার রায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গত ৮ জানুয়ারি বিচারপতি শওকত হোসেনের (বর্তমানে অবসর) নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চের দেওয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমিতে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি- আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।’ এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। সংবিধানের এ বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইনও করা হয়। আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ৯ বছর আগে আইন কমিশন থেকেও সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে আজও উচ্চ আদালতে পূর্ণাঙ্গভাবে এই বিধান কার্যকর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাংলায় রায় দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় তাগিদ দিয়েছেন।
গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করা উচিত বাংলায়। ইংরেজিতে লিখলেও সেটা রোমান ইংরেজিতে না লিখে সহজ ইংরেজিতে লেখা যায়। যেন সহজে সবাই বুঝতে পারে। তারপর সেটা বাংলায় অনুবাদ করা যায়। তাহলে সাধারণ মানুষের সুবিধা হবে রায় বুঝতে। উচ্চ আদালতের রায় লেখার ক্ষেত্রেও বাংলার ব্যবহার শুরু হবে আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এতে বিচারপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, ভাষাগত জটিলতা এবং বহির্বিশ্বের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে উচ্চ আদালতে সব মামলার রায় বাংলায় দেওয়া বিচারপতিদের জন্য দুরূহ। তবে বিচারপতিরা চাইলে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রায় ও আদেশ দেওয়ার সময় বাংলাদেশ, মাতৃভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়গুলোতে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের উপযোগী মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেবেন- এমনটাই প্রত্যাশা করেন তারা।
বিশ্বের অনেক দেশেই মাতৃভাষায় রায় দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস অন্যতম। এসব দেশের উচ্চ আদালতে মাতৃভাষায় বিচারকাজ চলে। বিচারপ্রার্থীরা মামলার শুনানি ও রায় সহজেই যাতে বুঝতে পারেন, সে জন্য উচ্চ আদালতে সওয়াল, জবাব, রায় ও আদেশও তাদের মাতৃভাষায় দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ৯০ দশক থেকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন; কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল রিপোর্টস ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্য অনুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন।
তবে তাদের মধ্যে বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ স্থাপনা সংরক্ষণ, স্বাধীনতার ঘোষক, ঢাকার চার নদী রক্ষাসহ প্রায় দেড়শ’ উল্লেখযোগ্য মামলার রায় বাংলায় দেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলায় রায় ও আদেশ লেখা প্রসঙ্গে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি সংবিধানেই বলা আছে। আমরা চেষ্টা করেছি। বর্তমানে যারা আছেন, এখন এ দায়িত্ব তাদের। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের মতে, ‘বাংলার ব্যবহার নিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রে অদ্ভুত উদাসীনতা, অবহেলা ও সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নইলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আদালতের নির্দেশসহ এতসব উদ্যোগ থাকার পরও বাংলার ব্যবহার এভাবে কমে যেত না।’
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘ফটাং ফটাং করে দু-একটা ইংরেজি শব্দ বলতে পারলেই আমরা ভাবি, ছেলে শিক্ষিত হয়ে গেছে। এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। আজকাল বিচারপতি, মন্ত্রী-এমপি বা সাংবিধানিক পদধারীদের পাঠানো বিয়ের কার্ডও দেখি শুধুই ইংরেজিতে হয়। এগুলো দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। প্রশ্ন জাগে- বাংলার প্রতি আমাদের এত হীনমন্যতা কেন?’
বাংলায় রায় ও আদেশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদালতে ব্যবহূত বিভিন্ন দেশের মামলার রায় এবং অন্যান্য রেফারেন্স সবই ইংরেজিতে। আইনজীবীরাও ইংরেজিতে নথি উপস্থাপন করেন। তবে বার (বিচারপতি) ও বেঞ্চ (আইনজীবী) চাইলে বাংলায় রায় দেওয়া সংশ্নিষ্টদের জন্য সহজতর হয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই উদ্যোগ থাকতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কথা বলা আছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইনও হয়েছে। কিন্তু তারপরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি; বরং দেশে ইংরেজি ভার্সন শুরু হয়ে গেছে। এটি যে শুধু আদালতের কার্যক্রমেই তা নয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যেও বাংলার প্রতি অনীহা চলে এসেছে।’
বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদসহ মানবাধিকার ও পরিবেশ-সংক্রান্ত কয়েকটি রিট মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট, যার আবেদনকারী ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বাংলায় রায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিচারপতিরা চাইলেই বাংলায় রায় দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আইনগত কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। উচ্চ আদালতের রায়েও রয়েছে, ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও রায় দেওয়া যাবে। তবে ইংরেজির কিছু বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে জটিলতা রয়েছে, সেগুলো বাংলায় রায় দেওয়া শুরু হলে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। কারণ, তখন প্রতিশব্দ নিয়ে সংশ্নিষ্টরা উদ্যোগী হবেন, যা এখনও শুরুই হয়নি।’
সুপ্রিম কোর্টে গঠন হচ্ছে অনুবাদ সেল
বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে উচ্চ আদালতের দেওয়া ইংরেজি রায় বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উচ্চ আদালতের রায়গুলো বাংলায় অনুবাদের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি উচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ রায় বাংলায় অনুবাদের জন্য একটি সেল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন। শিগগিরই এর কার্যক্রম শুরু হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র স্পেশাল অফিসার (অতিরিক্ত জেলা জজ) মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায়গুলো বাংলায় অনুবাদের জন্য একটি সেল গঠনের প্রস্তাব প্রধান বিচারপতি অনুমোদন করেছেন। এ বিষয়ে পদ সৃজনসহ প্রশাসনিক অন্যান্য কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হবে।’
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাংলায় রায় দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইংরেজি বা বাংলা- কোন ভাষায় বিচারকরা রায় দেবেন, সেটি তাদের নিজস্ব বিষয়। আইনগত কোনো বাধা নেই।’
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি
উচ্চ আদালতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কার্যকরের লক্ষ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, আইনমন্ত্রী এবং উচ্চ আদালতের ১০৪ জন বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমানের পাঠানো ওই চিঠিতে আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সাংবিধানিক ও আইনগত যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, ‘স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও একজন ন্যায়বিচারপ্রার্থী মানুষ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন অসহায়ের মতো। যে ভাষায় বিচারকের সঙ্গে তার আইনজীবীরা কথা বলেন, তিনি তা বুঝতে অক্ষম। যে ভাষায় বিচারক রায় দিচ্ছেন, তিনি তা-ও বুঝতে পারেন না। তার প্রতি ন্যায়বিচার করা হলো কিনা, সেটাও তাকে বুঝতে হচ্ছে তার আইনজীবীর দেহভঙ্গি দেখে বা তার কাছ থেকে শুনে। আপনি কি মনে করেন, এটা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?’ চিঠিতে অবিলম্বে উচ্চ আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কার্যকরে সংশ্নিষ্টদের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। সূত্র- সমকাল