মনিরা নাজমী জাহান

মার্কিন-তালেবান শান্তি চুক্তি: কার শান্তির সম্ভাবনা কতটুকু?

 মনিরা নাজমী জাহান:

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির মধ্যে অন্যতম আলচিত ও গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হল“মার্কিন-তালেবান শান্তি চুক্তি” । এরই মধ্যে এই চুক্তিকে  ঘিরে বিশ্লেষকদের    মধ্যে শুরু হয়েছে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ।  তবে সব বিশ্লেষণকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি মূল প্রাধান্য পাচ্ছে তা হল এই চুক্তি আদতে আফগানিস্থান নামক রাস্ত্রে কতটুকু শান্তি আনতে সক্ষম? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের  এই ধরনের চিন্তা একেবারে যে অমূলক নয় সেটি আফগান-মার্কিন সম্পর্কের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।

১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল সহ দেশের অন্যান্য অংশের  নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। সেই সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদরা বিদ্রোহ করে বসে।তৎকালীন  সময়ে ওসামা বিন লাদেনের মত কিছু আরব নাগরিক সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে জিহাদের নামে  আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।ওই সময়ে আমেরিকার প্রতক্ষ্য মদদে ক্রমেই আফগান মুজাহিদরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতির অন্যতম কারণ ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভীতি।এই সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতেই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে আমেরিকা  তৈরি করে তালেবান নামক বাহিনীকে ।একপর্যায়ে সর্বাধুনিক স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র, যেটি কাঁধে নিয়ে উৎক্ষেপণ করে বিমান ধ্বংস করা যায়, সেটিও সরবরাহ করে এই আমেরিকা।সেই সময় তালেবানরা আমেরিকার প্রতক্ষ্য সহায়তায় আফগানিস্থানে  সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতে সক্ষম হয়। কিন্তু কালের  বিবর্তনে সেই আমেরিকার মদদে গড়া বাহিনী আমেরিকার রিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতারিত করতে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় যে তালেবানি শক্তির উত্থান ঘটেছিল,  সেই তালেবানি শক্তিই আমেরিকার জন্য বড় যন্ত্রণার  কারণ হয়ে দাড়ায় । ফলশ্রুতিতে আমেরিকা তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আফগান যুদ্ধ ই ছিল দ্বিতীয় দীর্ঘতম যুদ্ধ। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে টুইনটাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর ওই বছরই আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে অভিযান চালায়।

প্রায় দীর্ঘ দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে আমেরিকাকেও দিতে হয়েছে চড়া মুল্য। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাবমতে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে অন্তত এক লাখ মার্কিন সেনা ছিল, যাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। পরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযানে নিজেদের সেনা পাঠানোর বদলে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলে ব্যয় বেশ কমে আসে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে তাদের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব থেকে জানা যায়, এ বছর ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাবমতে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন প্রশাসনের সামরিক ব্যয় হয়েছে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও ৪৪ বিলিয়ন ডলার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় করেছে।সব মিলিয়ে ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করলেও সেখানকার ব্যয় ধরা হয়নি এই হিসাবে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধ প্রকল্পের ব্যয় বা “কস্ট অব ওয়্যার” প্রজেক্ট নামে এক গবেষণায় দাবি করা হয়, আফগান যুদ্ধে ব্যয়ের যে সরকারি হিসাব দেখানো হয়েছে তা প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের জন্য মার্কিন কংগ্রেস এক ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন করেছিল।

ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে যাওয়া ক্রমেই যেন আমেরিকার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। ভিয়েতনামে প্রায় ১০ বছরের যুদ্ধে  প্রায় ৫৩ হাজার সৈন্য নিহত হওয়ার পর জনগণের প্রবল চাপে মার্কিন প্রশাসন লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়।অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘদিন থেকেই পলায়নের পথ খুঁজছিল আফগানিস্তান থেকে।সব মিলিয়ে আমেরিকা কিছুটা কোণঠাসা হয়েছে পড়েছিল

যদিও ভৌগলিক ভাবে আফগানিস্তান একটি রুক্ষ অনুর্বর মরুসদৃশ পাহাড়-পর্বতসংকুল দুর্গম দেশ হলেও নিঃসন্দেহে দেশটি তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খণিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। খণিজ সম্পদে সমৃদ্ধশালী হবার কারণেই বিভিন্ন সময়ে বিদেশিদে বেণিয়াদের কুদৃষ্টি পড়েছে আফগানিস্তানের ওপর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী এবং নিকট অতীতে সোভিয়েত দখলদারেরা কখনোই সেখানে আধিপত্য তো দূরে থাক, ন্যূনতম সুবিধাও আদায় করতে পারেনি। সেখানে শক্তিশালী মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতা ও নাস্তানাবুদে অবাক হওয়ার মত কোন ঘটনা নয়। সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন কলাকৌশল ও পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হল “এট্রিশন'”, যার প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে ক্রমাগত প্রতিপক্ষকে আক্রমন করা, হতে পারে সেই আক্রমণটি ছোট পরিসরে তবুও আক্রমণটি চালিয়ে যাওয়া । এই ক্রমাগত আক্রমনের ফলে প্রতিপক্ষের আর্থিক অবস্থা চাপের মুখে পরে এবং সৈনিকদের ও মনোবল ভেঙ্গে যায় ।এই কৌশল অবলম্বনের কারনে সামরিক ও অর্থনৈতিক, উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী  তালেবানদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। এখানে উল্লেখ্য যে ২০১৯ সালের ৯ই  ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট কর্তৃক প্রকাশিত এক মার্কিন গোপন নথিতে দেখা যায় যে , মার্কিন উচ্চ পদস্থ করমকর্তারা স্বীকার করেন আফগানিস্থান যুদ্ধে তাদের কৌশল গত ভুল ছিল এবং আফগানিস্থানকে একটি আধুনিক রাস্ত্রে রুপান্তর করতে গিয়ে তাদের বহু অর্থের অপচয় ঘটেছে ।

এই ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায়  ২০১৮ সাল থেকে তালেবানদের সঙ্গে কাতারের দোহায় অনেকবার আলোচনা হয়। সব শেষে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন এক সমঝোতায় পৌঁছায়। এই চুক্তির ভিত্তিতে আগামী ১৪ মাস আফগানিস্তানে তালেবানরা চুক্তির শর্ত মেনে চলবে। যদি ওই সময়ের মধ্যে তালেবানরা চুক্তি মেনে চলে, তাহলে আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত চুক্তি করবে এবং তাদের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।

তবে মার্কিন-তালেবান চুক্তি হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে, মার্কিন-তালেবানদের এই চুক্তি কি সফল হবে? কারণ  সূক্ষ্ম ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আফগানিস্থানে তালেবান ছাড়াও আরও অনেক জঙ্গি বাহিনী সক্রিয় ভাবে জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সমস্ত জঙ্গি বাহিনী কতটুকু সফল হতে দেবে এই চুক্তি সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৯০ দশকে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বেশ আশা ব্যঞ্জক এক শান্তি আলোচনা শুরু করেছিল কিন্তু তৎকালীন হামাস জঙ্গি এবং ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের বোমাবর্ষণ ও অব্যহত জঙ্গি কার্যক্রমে ভেস্তে যায় সেই শান্তি আলোচনা। ঠিক সেই রকম লক্ষন বর্তমান আফগানিস্থানেও বিরাজমান।   চুক্তির পর থেকে আফগানিস্তানে বেশ কয়েকবার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং মার্কিন বিমান হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত ৬ মার্চ বিরোধীদলীয় নেতা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর এক জনসভায় বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনা ঘটে। যায় দ্বায় স্বীকার করেছে আইএস। যেহেতু ইতিমধ্যে আইএস হামলার দায় শিকার করে নিয়েছে তাই হতে পারে আসন্নও ভবিষ্যতে আফগানিস্থানকে তাদের একটি শক্ত ঘাটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে।

এহেন পরিস্থিতিতে মার্কিন-তালেবান চুক্তি ভবিষ্যৎ ফল নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

মার্কিন-তালেবান   চুক্তির সবচেয়ে বড় ঝুঁকির জায়গায়  রয়েছ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল বর্তমান আফগান সরকার। এই চুক্তিতে অনেক কিছুই  স্পষ্ট করে বলা নেই। পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের শাসনপদ্ধতি কেমন হবে, বিশেষ করে চুক্তি অনুসারে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করা হলে, তখন কাবুলের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার পরিধি কেমন হবে সেই বিষয়ে স্পষ্টভাবে চুক্তিতে কিছু বলা নেই। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির এক উক্তির মাধ্যমেই বোঝা যায়,  বর্তমান সরকার এই চুক্তি নিয়ে কতখানি হতাশ। চুক্তির শর্তে রয়েছে, ৫০০০ তালেবান জঙ্গি, যারা আফগান সরকারের হাতে বন্দী, তাদের মুক্তি দিতে হবে। আশরাফ ঘানি বলেছেন, অপরাধীকে মুক্ত করে দিতে হবে, এমন শর্ত চুক্তিতে থাকা উচিত নয়।

অপরদিকে তালেবানরা গণতন্ত্রের প্রতি সহানুভুতি দেখালেও তাদের লক্ষ্য একেবারেই ভিন্ন।তালেবানদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন করা। তাই বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানদের আদর্শ গত চূড়ান্ত বিরোধ রয়েছে।  নারী নেতৃত্ব ও নারী অধিকার নিয়েও বর্তমান ক্ষমতাসীন দের রয়েছে প্রকট বিরোধ।তাই তালেবানদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত, সেটা নিয়েও রয়েছে সংশয় । কারণ, তালেবানদের পক্ষে তাদের মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। যদি কখনো শান্তির স্বার্থে তারা সরে আসতেও চায়, তাহলে তাদের অভ্যন্তরেই ভয়াবহ সংঘাত সৃষ্টি হবে।

সর্বোপরি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই চুক্তির মূল সংকটের জায়গা তৈরি হবে তালেবান এবং বর্তমান আফগান সরকারের সমঝোতা কে কেন্দ্র করে । কারন সম্পূর্ণ দুই মানসিকতা এবং দুই বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোন ধরনের সম্পর্ক বা সমঝোতা হবে তার রূপ রেখা চুক্তিতে না থাকার ফলে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ সংকট প্রলম্বিত হবে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তি চুক্তিও হয়ে পড়বে মূল্যহীন । আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রে  শান্তির অভিপ্রায়ে দুই গোষ্ঠী কতটা আন্তরিক ভাবে   এই বিপত্তিগুলোর সমাধান করবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

(লেখকঃ শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়)