আদালত অবমাননার নোটিশ
আদালত অবমাননার নোটিশ (প্রতীকী ছবি)

নিয়মিত আদালত চালুর দাবিতে সোচ্চার অনেক আইনজীবী

বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রায় চারমাস ধরে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এবং তিন মাস ধরে দেশের সকল অধস্তন আদালতে নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিচারিক কার্যক্রমের স্থবিরতা কাটাতে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট শুরু হলেও তাতে নিয়মিত কোর্টের মত অংশ নিতে পারছেন না সব আইনজীবীরা। এতে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছেন অধিকাংশ আইনজীবী।

সীমিত পরিধির ভার্চ্যুয়াল কোর্টে নতুন সিআর মামলা ফাইলিং, পলাতক আসামিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জামিন শুনানি, বিচারিক কার্যক্রম ও দেওয়ানি মামলার কাজ পুরোপুরি বন্ধ। তাই বেশিরভাগ আইনজীবীই বলা যায় কর্মহীন।

এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে হলেও নিয়মিত কোর্ট চালুর দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে অনেক আইনজীবীই এখন নিয়মিত আদালত চালুর দাবিতে সোচ্চার। এমনকি এরই মধ্যে তারা প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদনও করেছেন। পাশাপাশি চলছে তাদের মানববন্ধন কর্মসূচি। আগামী ১ জুলাই থেকে নিয়মিত কোর্ট চালু করা না হলে আইনজীবী সমাবেশসহ অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিতে পারেন বলেও জানিয়েছেন আন্দোলনকারী আইনজীবী নেতারা।

এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদনকারী আইনজীবী সাধারণ আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আদালত বন্ধ। আমাদের অবস্থা শোচনীয়। ১ জুলাই থেকে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালতে নিয়মিত কোর্ট চাই। তা না হলে আইনজীবীদের মনে সৃষ্টি হওয়া চাপা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।’

আগামী ১ জুলাই থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে হলে কোর্ট চালু করা না হলে আইনজীবী সমাবেশ ও অনশন কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে বলে জানান এই আইনজীবী নেতা। তাদের এ আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সিনিয়র আইনজীবীও একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বলেও জানান তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আইনজীবী নেতা মেহেদী বলেন, ‘বাবার সামনে সন্তানের কান্না, বাসা ভাড়া ও চেম্বার ভাড়া দিতে না পারার বেদনা করোনায় মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।’

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে কোর্ট বন্ধ। সম্প্রতি ভার্চুয়াল কোর্ট নামে এক ধরনের কোর্ট চালু হয়েছে। তবে এই কোর্টে মামলা নিষ্পত্তির হার নিয়মিত কোর্টের এক শতাংশ হবে কিনা সন্দেহ। ভার্চুয়াল কোর্টে সীমিত কিছু আইনজীবী মামলা করার সুযোগ পায়।’

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কোর্ট বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে। অপরাধ কিন্তু থেমে নেই। কেউ যদি আদালতে আত্মসমর্পন করে জামিন নিতে চায় সে সুযোগও নেই। বিচার বিভাগ বন্ধ থাকলে জনগণের হয়রানির সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীদের আয়ও বন্ধ হয়ে যায়। আইনজীবীরা তো আর চাকরিজীবী না যে বসে থাকলে বেতন আসবে। প্রতিদিনের কাজের মাধ্যমেই তাদের আয় রোজগার। আদালত বন্ধ থাকলে তাদের আয় রোজগারও বন্ধ থাকে। দীর্ঘ চার মাস ধরে আদালত বন্ধ। আমাদের আয় রোজগারও বন্ধ। কিন্তু আমাদের বাসা ভাড়া, সংসার খরচ তো থেমে নেই।’

সিনিয়র আইনজীবীদের তেমন কোনো সমস্যা না হলেও জুনিয়র আইনজীবীদের অবস্থা শোচনীয়। অনেক জুনিয়র আইনজীবী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলেও তিনি জানান। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্পসহ কারখানা যদি চলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালত চলতে সমস্যা কোথায়। তাছাড়া কোর্টের মধ্যে বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের দূরত্ব এমনিতেই অনেক বেশি। দেশের তিন অঙ্গের মধ্যে একটি অঙ্গ বন্ধ রেখে এভাবে দেশ চললে মানুষের মধ্যে একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে।’

স্বল্প পরিসরে কোর্ট খোলার দাবি জানিয়ে আরেক আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘করোনার সংক্রমণের শুরুতে আমরা নিজেরাই কিন্তু বলেছি, কোর্ট খোলা না রাখার জন্য। কিন্তু এরপর চার মাস হয়ে গেছে। আমরা জানি না কতদিন এভাবে চলবে। ভার্চ্যুয়াল কোর্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ আইনজীবী হয়তো জড়িত। কিন্তু বাকি ৯০ শতাংশ আইনজীবী কিন্তু এর বাইরে। এভাবে দীর্ঘদিন একজন আইনজীবীর আয়-রোজগার বন্ধ থাকা খুবই কষ্টকর। তাছাড়া আইনজীবীরা তো কোনো ধরনের সরকারি সহযোগিতার আওতায় নেই। এটা যেহেতু অনিশ্চিত পথচলা, তাই আমি মনে করি, এখন স্বল্প পরিসরে হলেও কোর্ট খোলা যায় কি না সেটা চিন্তা করা।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘ভার্চ্যুয়াল আদালতে মামলা করতে হবে এমন পরিস্থিতির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। করোনার প্রার্দুভাবে বিচার বিভাগ একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছিল। এক পর্যায়ে কিন্তু কার্যকর বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করা শুরু করলাম। তিন বিভাগের মধ্যে নির্বাহী এবং আইন বিভাগ পুরোপুরি কাজ করছিল। শুধুমাত্র বিচার বিভাগ বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগের কাজও চলা প্রয়োজন। বিচার বিভাগকে কার্যকর করার জন্য ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালু করা হয়। এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা। এটা কখনই পুরিপূর্ণ ব্যবস্থা নয়।’

তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে আইনজীবীরা তাদের পেশার বাইরে রয়েছে। তাদের জীবিকা কিন্তু হুমকির মধ্যে। এছাড়া ভার্চ্যুয়াল কোর্টে যারা মামলা করছেন তাদের সংখ্যা কিন্তু একেবারেই সামান্য। ভার্চ্যুয়াল কোর্টের মাধ্যমে আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না। এখন এই পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এই মুর্হূতে কোর্ট খোলা সমীচীন বলেও মত দিয়েছেন। অনেক আইনজীবী বন্ধু আবার না খোলার পক্ষেও মত দিয়েছেন।’

আইনজীবী সমিতির সম্পাদক আরো বলেন, ‘আমরা সমিতির পক্ষ থেকে বলেছি, আদালত খোলা বা বন্ধ রাখা সম্পূর্ণই প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের ব্যাপার। কেননা এগুলোর সঙ্গে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে আইনজীবী বিচারকসহ সকলের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’

রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সমিতির দায়িত্বশীল হিসেবে আমি বলব, আইনজীবীরা অনেক কষ্টে আছেন। জীবন জীবিকা নির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। যারা ভার্চ্যুয়াল কোর্টে মামলা পরিচালনা করছেন, তারাও যে শান্তিতে আছেন, তা নয়। কেননা ভার্চ্যুয়াল কোর্টে এক সঙ্গে অনেক মামলা করা যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশের সব আদালত ছুটি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এর আগে ১৩ মার্চ থেকে সুপ্রিম কোর্টের ছুটিও শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে আদালত বন্ধ থাকায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গত ১১ মে থেকে ভার্চুয়াল আদালতে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ভার্চ্যুয়াল আদালতের মাধ্যমেই সীমিত পরিসরে দেশের বিচার কাজ চলছে। সারাবাংলা