অ্যাডভোকেট ইকবাল হাসান

ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা বনাম বৈধ প্রত্যাশা

২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত আইনজীবী তালিকাভুক্তির এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং পরবর্তীতে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের আসন্ন ২০২০ সালের এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় শুধুমাত্র লিখিত পরীক্ষায় অংশ গ্রাহনের বৈধ প্রত্যাশার বাস্তবতা এবং ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতায় আইনি বাধা নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট ইকবাল হাসান কিশোর।

উপস্থাপিত বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করতে হলে প্রথমে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা কি, কেন সাধারণ আইন প্রণয়নে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা একটি বাধা এবং বৈধ প্রত্যাশা কি, কখন বৈধ প্রত্যাশা থেকে প্রতিকার পাওয়া যায় এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা দরকার।

ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা (Retrospective Effect)
সাধারণ দৃষ্টিতে আইনের ভূতাপেক্ষা কার্যকারিতা হল আইনের শাসনের পরিপন্হি একটি বিষয়। অতীতের কোন অন্যায্যতাকে পরবর্তীতে ন্যায্যতা দেয়াকে আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা বলে।

সাধারণ ভাবে সকল ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা দেয়া হলে আইনের শাসন লঙ্ঘিত হয়। আইনের শাসনের প্রধান একটি নীতি হল সবাই আইনের চোখে সমান বলে বিবেচিত হবে, কেউ আইনের উর্ধ্বে না। আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতায় সবাই সমান বলে বিবেচিত হয় না। এর ফলে একপক্ষ এমন কিছু সুবিধা ভোগ করে অথবা ক্ষতির শিকার হয়, যা তখনকার সময়ে বিদ্যমান আইনের বিধানে ছিলনা। তাই আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতাকে অন্যায্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

যে কারণে আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যায় না
আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিলে সবাই আইনের চোখে সমান বলে বিবেচিত হয় না অনেক অনেকক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা থাকে। আইনের ভূতাপেক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি আইন পরিবর্তন করে বা সৃষ্টি করে পূর্বের ঘটনার জন্য সাজা দিতে পারে যা পূর্বে অপরাধ বলে বিবেচিত ছিল না। তাই সাধারণ ভাবে আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া হয় না।

সবাই আইনের চোখে সমান- আইনের শাসনের এই নীতিটি আমাদের সংবিধানে ৩য় ভাগের অনুচ্ছেদ ২৭ এ রাষ্ট্রের নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ বলেছে বিদ্যমান কোন আইন ৩য় ভাগের কোন বিধানের পরিপন্হি হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে। অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে সংবিধানের ৩য় ভাগের কোন বিধানের পরিপন্হি আইন থাকলেও সংবিধান প্রণয়নের পর ৩য় ভাগের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কোন বিধান হলে তা বাতিল হবে।

ব্যাতিক্রম
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন বাস্তবাতায় বিভিন্ন আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা বা Retrospective Effect দিয়েছে। এই ধরনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা যুক্ত আইনগুলো আইনের ল্যাটিন পরিভাষায় Ex Post Facto Law নামে পরিচিত। আমেরিকার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১ এর ধারা ৯ এবং ধারা ১০ মতে এ ধরনের retroactive আইন একেবারেই নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে যুক্তরাজ্যের West Ministerial Government পদ্ধতিতে আবার Doctrine of Supremacy of Parliament মতবাদের আলোকে সংসদ চাইলে এই ধরনের Retroactive আইন বা Ex Post Facto Law, যেখানে retrospective effect বা ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা থাকে এমন আইন Technically পাস করতে পারে।

বৈধ প্রত্যাশা (Legitimate Expectation)
বৈধ প্রত্যাশা বা Legitimate Expectation মতবাদটি হল প্রশাসনিক আইন বা Administrative law এর একটি নীতি, যা বিচারিক পর্যালোচনা বা Judicial Review এর একটি হেতু বা ground হিসাবে ব্যবহার হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল কমন ল’ পদ্ধতিতে (Common Law System) বৈধ প্রত্যাশা নীতিটির প্রচলন আছে।

যখন কোন কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতি বা Representation করে পরে rescind বা বাতিল করে বা সরে আসবে তখন ভুক্তভোগী ন্যায় বিচারের নীতি বা Principle of Natural Justice এবং Fairness বা ন্যায্যতার হেতুর আলোকে ঐ কর্তৃপক্ষকে উক্ত কার্য করা থেকে বিরত রাখতে উচ্চ আদালতে জুডিসিয়াল রিভিউর মাধ্যমে নির্দেশনা চাইবে।

বৈধ প্রত্যাশার উপাদান
একটি বৈধ প্রত্যাশা বা legitimate expectation হতে হলে চারটি উপাদান থাকতে হবে।

১। কর্তৃপক্ষ একটি সুস্পষ্ট বিবৃতি প্রদান করবে
২। এবং কর্তৃপক্ষের আচরণ দ্বারা অবশ্যই একটি প্রত্যাশা তৈরি হবে
৩। বিবৃতিটি অবশ্যই কর্তৃপক্ষের যথাযথ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি থেকে আসবে
৪। এবং বিবৃতিটি অবশ্যই ভুক্তভোগীদের উপর প্রয়োগযোগ্য।

বৈধ প্রত্যাশা ভঙ্গে বিচারিক বিবেচনা
বৈধ প্রত্যাশা বা Legitimate Expectation ভঙ্গ হলে Judicial Review এর মাধ্যমে প্রতিকার পেতে হলে প্রধানত তিনটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে যে,

১। একটি বৈধ প্রত্যাশা উদ্ভূত হয়েছে কিনা
২। কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রত্যাশা ব্যাহত হলে বেআইনি হবে কিনা
৩। ভুক্তভোগী প্রত্যাশা ভঙ্গের কারনে প্রতিকার পাওয়ার হকদার কিনা

যদিও এখানে মূখ্য বিবেচনা হল বৈধ প্রত্যাশটি আইন সঙ্গত ছিল কি না।

বৈধ প্রত্যাশা ভঙ্গে প্রতিকার
এটি স্বীকৃত যে, কোন পাবলিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ন্যায় বিচারের নীতি (Principle of natural justice) ভঙ্গ হলে বা ভঙ্গ করছে যার ফলে কেউ ভুক্তভোগী হলে সংবিধানের ১০২(২) উপ অনুচ্ছেদের আলোকে হাইকোর্ট ডিভিশনে রিটের মাধ্যমে ঐ ভুক্তভোগী তার প্রতিকার চাইতে পারে যদি তার অন্য কোথাও সমকক্ষ প্রতিকার চাইবার ফোরাম না থাকে। বৈধ প্রত্যাশা নীতি যেহেতু ন্যায় বিচার নীতির একটি হেতু বা ground। তাই বৈধ প্রত্যাশা ভঙ্গ হলে ন্যায় বিচার নীতির আলোকে ভুক্তভোগীর অন্যকোন প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ না থাকলে সংবিধানের ১০২(২) অনুচ্ছেদ অনুসরে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদনের মাধ্যমে ভুক্তভোগী যথাযথ করণীয় প্রতিকার চাইতে পারেন। তবে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীকে রিট করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকটি বিষয়টি পুনঃবিবেচনার জন্য ডিমান্ড অব জাস্টিস নোটিশ দিতে হয়।

বৈধ প্রত্যাশা নীতির সীমাবদ্ধতা
তবে Legitimate expectation বা বৈধ প্রত্যাশার সীমাবদ্ধতা হল যখন representation বা বিবৃতিটি ultra vires বা এখতিয়ার বহির্ভূত বা ক্ষমতা বহির্ভূত হয় তখন legitimate expectation এ প্রতিকার পাওয়া জটিল হয়।

সমসাময়িক বাস্তবতা
২০১৭ সালের আইনজীবী এনরোলমেন্ট এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং পরবর্তিতে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণদের জন্য ২০২০ সালের এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় এমসিকিউ দিতে হবে না এবং তারা শুধুমাত্র লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন মর্মে ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি নোটিশ জারি করে বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ।

যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নোটিশে উল্লেখিত বিবৃতিটি প্রদানের মাধ্যমে ২০১৭ এর এনরোলমেন্ট এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং পরে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থিদের মাঝে একটি বৈধ প্রত্যাশা বা Legitimate Expectation এর সৃষ্টি হয় যে, তারা আসন্ন অর্থাৎ ২০২০ সালের এনরোলমেন্ট পরীক্ষার শুধুমাত্র লিখিত পরীক্ষায় সরাসরি অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবেন।

অপরদিকে গতকাল (২৭ জুলাই) বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ আরেকটি নোটিশে জানানো হয় যে, আসন্ন এনরোলমেন্ট লিখিত পরীক্ষা চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। নোটিশে আরো জানানো হয় যে, ২০১৮ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর পূর্বে যারা লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছেন তারা দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবেন না এবং ২০১৮ সালের ১৯ শে ডিসেম্বরের আগে যারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় নাই তাদের দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি সরকারের ভূতাপেক্ষা প্রয়োগের উপর নির্ভর করছে বলে উক্ত নোটিশে জানানো হয়। অর্থাৎ ২০১৭ সালের আইনজীবী তালিকাভুক্তির এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং পরবর্তি লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণরা দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পাবে কিনা, এই নিয়ে একটি সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, এনরোলমেন্ট পরীক্ষা পদ্ধতির তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে, নৈর্ব্যাক্তিক বা MCQ পরীক্ষা, এরপর লিখিত পরীক্ষা এবং সবশেষে Viva বা মৌখিক পরীক্ষা- এই তিনিটি ধাপে একটি এনরোলমেন্ট পরীক্ষা পদ্ধতি শেষ হয়। কিন্তু, ইতোমধ্যে আসন্ন ২০২০ নৈর্ব্যাক্তিক বা MCQ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফলে বিষয়টির সমীকরণ আরো জটিল হয়েছে। কারণ ২০১৭ সালের এনরোলমেন্ট MCQ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং পরে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ন পরীক্ষার্থিরা ২০১৯ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বরের নোটিশের কারনে ২০২০ সালের MCQ পরীক্ষার জন্য Form Fill up করেনি। একদিকে তাদেরকে দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা দিতে হলে আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দরকার, অন্যদিকে সরাসরি এনরোলমেন্ট লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পাবার জন্য এসব পরীক্ষার্থিদের একটি বৈধ প্রত্যাশা রয়েছে।

বিষয়টিতে বার কাউন্সিলের বিধি বিধান, সাংবিধানিক বিধান এবং ন্যায় বিচারের বিভিন্ন ইস্যু জড়িত। আইনে যেরকম বৈধ প্রত্যাশার বিধান, ভূতপেক্ষা প্রয়োগের বিধান আছে তেমনি আইনের অত্যাবশকতার বিধান রয়েছে। মানুষ হিসাবে কেউই আমরা ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। যেকোন ভুল ত্রুটিরই সমাধান আছে। আশা করি, আইনের বিধি, বিধান ও ন্যায়বিচারের নীতির আলোকে যথাযথ কর্তৃপক্ষ হতে যথা শিঘ্রই বিষয়টির একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে।

ইকবাল হাসান কিশোর: আইনজীবী; জজ কোর্ট, ঢাকা।