টাউট

চট্টগ্রাম আদালত অঙ্গনে টাউট দৌরাত্ম

চট্টগ্রামের আদালত অঙ্গনে নিত্যনতুন টাউট ধরা পড়ছে। আইন বিষয়ে কোন ডিগ্রী এবং সনদ না থাকা সত্ত্বেও আইনজীবী পরিচয়ে করে যাচ্ছেন প্রতারণা। কখনও আইনজীবী, কখনও ক্লার্ক, কখনও সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করছে আদালতপাড়ায়।

সম্প্রতি ধরা পড়া এক টাউট পটিয়ার নাসির উদ্দিন খান। এলএলবি পাস না করেও আইনজীবী পরিচয়ে দু-এক বছর নয়, টানা ১৫ বছর আদালতপাড়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আইনি প্রতিকার নিতে আসা মানুষের সঙ্গে উঠবস করেছেন তিনি। যদিও শেষমেশ ধরা পড়েন টাউট উচ্ছেদ কমিটির হাতে। স্বীকার করেন, আইনজীবী না হয়েও অন্যায়ভাবে অসংখ্য মামলায় তদবির করেছেন তিনি। অবশেষে মুচলেকা ও অঙ্গীকারনামা দিয়ে শেষ রক্ষা হয় নাসির উদ্দিন খানের।

একইভাবে অর্ধযুগ ধরে আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণা করেন বাঁশখালীর রাজীব কান্তি সুশীল। নিয়মিত চেম্বার করে মানুষজনকে প্রতারিত করে আসছিলেন তিনি। ধরা পড়ার পর তাকেও টাউট স্বীকারোক্তি দিয়ে মুচলেকা দিতে হয়।

মাত্র ৩০ দিনেই আসামির জামিন করিয়ে দেবেন বলে নগরীর চান্দগাঁও মাহবুর আলমের স্ত্রী রহিমা আক্তারের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন টাউট নুরুল আলম ও রুনা আক্তার। কিন্তু জামিন করাতে না পারায় বিষয়টি গড়ায় আইনজীবী সমিতিতে। তার পরই বেরিয়ে আসে আলম ও রুনার প্রতারণার গল্প। আলমের বিরুদ্ধে মামলা হলেও রহিমাকে অর্থ ফেরত দেওয়ার শর্তে মুচলেকায় ছেড়ে দেয় সমিতি। নগরীর বায়েজিদ এলাকার বাসিন্দা সজীবও আদালতে মামলা পরিচালনা, মামলার কাগজপত্র সরবরাহসহ নানা অপকর্মে জড়িত। সজীব শুধু এবারই নয়, এর আগে ২০১৯ সালেও একবার আটক হয়েছিলেন।

একইভাবে ১৫ বছর ধরে অন্যজনের লিন নম্বর ব্যবহারকারী রতন কুমার দাশ, ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা অস্ত্রধারী শামসুর রহমান, ৫৮টি সিলসহ নিয়ে ঘোরাফেরা করা ফাহাদ খানের মতো আরও অনেক টাউটই রয়েছে চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায়। গত তিন বছরে এ রকম ৫৯ জনকে শনাক্ত ও আটক করে আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটি। তবে এখনও অনেকেই রয়েছে যারা শনাক্ত হননি এবং যারা আইনের ডিগ্রি না থাকলেও আদালতপাড়ায় কখনও আইনজীবী, কখনও ক্লার্ক, কখনও সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করছে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন বলেন, আদালত অঙ্গনে নিত্যনতুন টাউট ধরা হচ্ছে। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে প্রতারণার মামলা দিচ্ছি। অন্যদের মুচলেকা ও অঙ্গীকারনামা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত রাখতে কঠোর অবস্থানে আছি আমরা।

১৫ বছর ধরে প্রতারণা করেছেন রতন

আইনজীবী হিসেবে ১৫ বছর কাজ করেছেন রতন কুমার দাশ। তিনি আইনজীবী হিসেবে ৭১৪ নম্বর লিন নম্বর ব্যবহার করলেও এটি আসলে রতন কান্তি নাথ নামে আরেকজন আইনজীবীর। এ টাউট নিজেকে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সভাপতি হিসেবে, কখনওবা আইনকণ্ঠ নামে একটি পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। দীর্ঘদিন আইনজীবী ভবন এনএক্স ওয়ানের ৭১২ নম্বর চেম্বারে বসতেন, ছিল ভিজিটিং কার্ডও। প্রতারণা ধরা পড়ার পর সমিতি তার বিরুদ্ধে মামলা করে।

আইনজীবীর স্বাক্ষর জালিয়াতি

পুলিশ ইন্সপেক্টরের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর কখনও ব্যারিস্টার, কখনও পুলিশ, কখনওবা আইনজীবী পরিচয়ে আদালতপাড়ায় কোমরে পিস্তল ও হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন সামসুর রহমান। আইনজীবী শেখ মনসুর রহমানের স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগে আদালতে মামলা হয় তার নামে। আদালত শুনানি শেষে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে কোতোয়ালি থানাকে নির্দেশ দিয়ে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশনা দেন।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর টাউট উচ্ছেদ কমিটি তাকে আদালতপাড়া থেকে আটক করে সমিতি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সাদা কাগজে অঙ্গীকারনামা দিয়ে মুক্তি পান তিনি। সমিতির পাঠাগার সম্পাদক আলী আকবর সানজিক বলেন, বহু অভিযোগ রয়েছে শামসুর রহমানের বিরুদ্ধে।

সিল সম্রাট ফাহাদ খান:

পান্না ধর নামে এক ভুক্তভোগী নারীকে সম্প্রতি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার কথা বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি ও জাল সিল মেরে দুই লাখ ৮২ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন ফাহাদ খান। সমিতির সদস্য না হয়েও আদালতে মামলা পরিচালনা করতেন তিনি। তার ভাণ্ডার থেকে সিটি মেয়র, পুলিশ সুপার, মহানগর চতুর্থ দায়রা জজ, ডিসি, সহকারী কমিশনার রেকর্ড রুম, সহকারী কর কমিশনার, সদর সার্কেল ভূমি অফিস, সহকারী পুলিশ সুপার, ওসি তদন্ত চকবাজার থানা, প্রধান রাজস্ব্ব কর্মকর্তা সিটি করপোরেশন, সদর সাব-রেজিস্ট্রার, সাধারণ সম্পাদক ছাত্রদল, সোনালী ব্যাংক কোর্ট হিল শাখাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, নকলখানাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫৮টি জাল সিল উদ্ধার করে সমিতি। এগুলো ব্যবহার করে তিনি সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন।

তিন বছরে আট মামলা, মুচলেকায় মুক্ত ৫১

টাউটরা মামলা করে দেওয়া, আসামি আটক ও মামলার নিষ্পত্তি এবং জামিন করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তিন বছরে আট টাউটের বিরুদ্ধে মামলা করেছে আইনজীবী সমিতি। সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর মামলা হয়েছে আছিয়া বেগমের বিরুদ্ধে। এর আগে টাউট রতন কুমার দাশ, ফাহাদ খান, হাসনা বেগম, জাহাঙ্গীর আলম, শেখ মো. নজরুল, তৌহিদুল আলম ও ফরিদা ইয়াছমীন সুমির বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করে সমিতি।

চলতি বছর মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া ১৫ টাউট হলো- আবুল কাশেম, করিম উল্লাহ তোহা, জাহিদুর রহমান, মোহাম্মদ হারুন, প্রণব ধর, শাহনাজ বেগম, হাসনা বেগম, মরিয়ম সুলতানা, কাঞ্চন চৌধুরী, শর্মিলা ভট্টাচার্য্য, রাজীব সরকার, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, আবদুল মালেক গাজী, জোবায়ের মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব ও মো. ফয়েজ আলী।

এ ছাড়া ২০১৯ সালে ২৩ জন এবং ২০১৮ সালে ১০ জন টাউট আদালতপাড়া থেকে আটক হয়।

সূত্র- সমকাল