অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকীম

এডমিরালটি কোর্ট বনাম অর্থ ঋণ আদালত: সাংবিধানিক আইনের একটি প্রয়োগ

সাব্বির এ মুকীম: ৮ কোটি ৩৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা অপরিশোধিত ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইন্টিগ্রিটি বিজনেস কোম্পানীর বিরুদ্ধে ফার্ষ্ট সিকিউরিটি ব্যাংক মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের এডমিরালটি বেঞ্চ এ ২০১৫ ইং সনের ৫৫ নং এডমিরালটি মামলা দায়ের করে।

৪ কোটি টাকায় এমভি জাভেদ-৪ এবং ৩ কোটি টাকায় এমভি মারিয়া তাসনিম-১ নামের ২টি জাহাজ কিনতে হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মেল্ক প্যাকেজে বাদী ব্যাংক হতে বিবাদী নালিশী ঋণ গ্রহণ করে। কিছু টাকা পরিশোধের পর সে ঋণ খেলাপ হতে থাকায় সেংশন লেটারের শর্ত মতে হিসেবকৃত মোট প্রাপ্য ৮ কোটি ৩৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা বিবাদী হতে আদায়ে বাদী ব্যাংক আলোচ্য মামলাটি করে।

ব্যাংকের ঋণ আদায়ের জন্য অর্থ ঋণ আদালত আইনের মতো বিশেষ সুনির্দিষ্ট আইন থাকতে সে আইনে মামলা না করে কীভাবে এডমিরালটি কোর্ট এ মামলা হলো?

৬৯ ডি এল আর ২০১৭ হাইকোর্ট ডিভিশন এর ৪০৮ নং পৃষ্ঠা হতে ছাপা বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান প্রদত্ত রায়ে এই প্রশ্নের সমাধান প্রদান করা হয়।

আলোচ্য মামলা দায়েরের পর পরই বিচার শুরু হওয়ার আগেই এখতিয়ারহীনতার যুক্তিতে দেওয়ানী কার্যবিধির ১৪ আদেশ ২ বিধির বিধান মতে উক্ত মামলা রক্ষণীয় নয় মর্মে আপত্তি তুলে বিবাদী পক্ষে দাখিলকৃত দরখাস্তের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালতে আলোচ্য রায় প্রদান করেন।

বাদী ব্যাংক এর আরজীর প্রার্থণা অংশে বিজ্ঞ আদালতে বাদী পক্ষে ৮ কোটি ৩৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার ডিক্রি তৎসহ পরিশোধ পর্যন্ত বার্ষিক ২০% হারে সুদ এর আদেশ ছিলো বাদীপক্ষের মূল প্রার্থনা।

এই প্রার্থনা সুস্পষ্টভাবে অর্থঋণ আদালত আইন কে আকৃষ্ট করে। অর্থঋণ আদালত আইন এর ৫(১) ধারায় বলা আছে:

“অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেনো উপধারা (৫) ও (৬) এর বিধান সাপেক্ষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায় সম্পর্কিত যাবতীয় মামলা ধারা ৪ এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত, ঘোষিত বা গণ্য হওয়া অর্থঋণ আদালতে দায়ের করিতে হইবে এবং উক্ত আদালতেই উহা নিষ্পত্তি হইবে।”

আলোচ্য মামলার বাদী ব্যাংক অর্থঋণ আদালত আইন মতেই একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান; নালিশী মূল বিষয়বস্তুঋণ আদায় সংক্রান্ত এবং এডমিরালটি কোর্ট কখনোই অর্থঋণ আদালত আইন মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত, ঘোষিত বা গন্য হওয়া অর্থঋণ আদালত নয়। অর্থঋণ আদালত আইন মোতাবেক সুতরাং ই এডমিরালটি কোর্ট এ আলোচ্য মামলা রক্ষণীয় নয়।

নালিশী ঋণ এর সেংশন লেটারের ১ নম্বর শর্ত হলো ৩টি কার্গো জাহাজ যৌথ অংশীদারী ভিত্তিতে কিনে গ্রহীতার নিকট বিক্রি বা ভাঁড়ায় খাটানো এবং পর্যায়ক্রমে ব্যাংক বিনিয়োগকৃত অংশ গ্রহীতার নিকট বিক্রয়ের মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তর।

যেহেতু আলোচ্য মামলায় জাহাজ জড়িত, তাই ব্যাংক অর্থঋণ আদালত আইন এ না গিয়ে এডমিরালটি কোর্ট এ প্রতিকার চায়। এডমিরালটি আইনের ৩(২)(ক) এবং ৩(২)(গ) ধারা সমূহের একত্রিত পাঠে বোঝা যায় কোনো জাহাজের মালিকানা, দখল, বন্ধক ইত্যাদি সংক্রান্ত দাবী এডমিরালটি কোর্ট এ বিচার্য।

কিন্তু আলোচ্য বিরোধ কি জাহাজের মালকানা, স্বত্ব বা বন্ধক নিয়ে?

এ প্রশ্ন আসে, কারণ নালিশী ঋণের সেংশন লেটারের শর্ত এবং আলোচ্য মামলায় আরজীতে বাদীর প্রার্থণা কে মিলিয়ে পড়লে অনুভব করা যায় বিরোধটি সুস্পষ্টরূপে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত ঋণ আদায় সংক্রান্ত বিরোধ যা এক্সক্লুসিভলি অর্থঋণ আদালত এর এখতিয়ার এ পড়ে। অর্থঋণ আদালত আইন এর ৫(১) ধারার “অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেনো” শব্দচয়ন সুস্পষ্টভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত ঋণ আদায় সংক্রান্ত বিরোধ এর ক্ষেত্রে এডমিরালটি আদালত কে এখতিয়ার শুণ্য করেছে।

আলোচ্য বিরোধে আসলেই কী এডমিরালটি কোর্ট এর এখতিয়ার নাই?

বিজ্ঞ এডমিরালটি কোর্ট আলোচ্য রায়ে বিরোধীয় বিষয়টি এডমিরালটি কোর্ট এ বিচার্য মর্মে রায় দেন। বিজ্ঞ এডমিরালটি কোর্ট মূলত দুটি যুক্তিতে আলোচ্য বিরোধে এডমিরালটি কোর্ট এর এখতিয়ার খুঁজে পান।

যুক্তি-১: আলোচ্য ঋণ ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক। বিজ্ঞ এডমিরালটি কোর্ট সিদ্বান্ত নেন এই যুক্তিতে যে নালিশী ঋণের টাকা ছিলো মূলত বাদী ব্যাংক এর বিনিয়োগ স্বরুপ। ইসলামি ব্যাংকিং এর জুরিসপ্রুডেন্স নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে বিজ্ঞ এডমিরালটি কোর্ট এই যুক্তি উপস্থাপন করেন।

যুক্তি-২: আদালতের পরবর্তী সিদ্বান্ত হলো এডমিরালটি কোর্ট অর্থঋণ আদালত আইন এর ৫(১) ধারার সীমাবদ্ধতার আওতায় পড়ে না। তাই কেবল আলোচ্য বিরোধ ই নয়- যা ছিলো ইসলামি শরিয়া ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায় সংক্রান্ত- বরং সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংক এর ঋণ আদায় সংক্রান্ত বিরোধও এডমিরালটি কোর্ট বিচার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শর্ত কেবল একটাই- বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে অব্যশই এবং অবশ্যই এডমিরালটি আইনের এখতিয়ারের উপাদানগুলো উপস্থিত থাকতে হবে।

এই রায়ে সবচে গুরুত্ববহ যুক্তি হলো এডমিরালটি কোর্ট এর এখতিয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার। যদিও এডমিরালটি কোর্ট হিসেবে পরিচিত কিন্তু এটি মূলত মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের অন্যতম একটি বেঞ্চ। হাইকোর্ট বিভাগের সকল বেঞ্চের সাধারণ এখতিয়ার মহান সংবিধানের ১০১ অনুচ্ছেদে প্রদান করা হয়েছে। তাই আলোচ্য ধরণের বিরোধে এডমিরালটি কোর্ট এখতিয়ার পেয়েছেন সংবিধান হতে। ১০১ অনুচ্ছেদই এডমিরালটি বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছে। অন্যদিকে অর্থঋণ আদালত আইন এর আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় দেওয়ানী আদালত আইন ১৮৮৭ এর আলোকে। অর্থঋণ আদালত আইন আইনের ৫(১) ধারার সীমাবদ্ধতা ঐ দেওয়ানী আদালত আইন এর আলোকে প্রতিষ্ঠিত সকল আদালতের জন্য প্রযোজ্য। তবে তা সংবিধানের আলোকে প্রতিষ্ঠিত আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিজ্ঞ এডমিরালটি কোর্ট আইসি আইসিআই লি. বনাম এম এফ ভি শিল্প, এ আই আর ২০০২ বোম্বে ৩৭১ নজীরের কথা স্মরণ করেন।

উপসংহারে বিজ্ঞ এডমিরালটি কোর্ট বলেন জাহাজ সংশ্লিষ্ট ঋণ বা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যেই কোনো বিরোধ এডমিরালটি কোর্ট এ বিচার্য। আলোচ্য রায়ে আলোচ্য বিরোধ এডমিরালটি আইনে রক্ষণীয় মর্মে সিদ্বান্ত প্রদান করতঃ বিবাদীর মামলার আরজী খারিজের দরখাস্ত না মঞ্জুর করে মোকাদ্দমা বিচারের জন্য গ্রহণ করেন।

সাব্বির এ মুকীম: আইনজীবী; কুমিল্লা জজ কোর্ট। ই-মেইল: samukim1@gmail.com