ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট রুবেল আহমেদ ভূঁইয়াকে গতকাল মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) এজলাসের লকআপে ২ ঘণ্টা আটক রাখার প্রতিবাদে চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সামনে বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবীরা।
আজ বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার সিএমএম আদালতে এই আন্দোলন করছেন বিক্ষুব্ধ আইনজীবীরা। এসময় তারা সিএমএম আদালতের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন এবং আদালত বর্জন করেন।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন আইনজীবীরা। বিষয়টি তদন্ত করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান তারা। যদিও অভিযুক্ত বিচারককে অপসারণ করার দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনরত আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, বিচারক হচ্ছেন বিচারকারী আর আইনজীবী হচ্ছেন বিচারকার্যে সহায়তাকারী। কখনও কখনও আইনজীবী বিচারকের শিক্ষক। আর একজন আইনজীবী যখন বিচারকের সামনে দাঁড়ান তখন কিন্তু পক্ষান্তরে বিচারপ্রার্থীই দাঁড়ান। তাই উভয়পক্ষেরই শিষ্টাচার দরকার।
তিনি বলেন, একজন বিচারকের প্রশাসনিক বিষয়ে সমালোচনা বা প্রতিবাদ করতে বাধা দেখিনা। কারণ বিচারকের জবাবদিহি পক্ষান্তরের বিচারপ্রার্থির নিকটে রয়েছে। বিচারক এবং আইনজীবী উভয়কেই মহান আদালতের প্রতি নমনীয় বিনয় রাখতে হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আরও বলেন, বিচারকের যেমন ব্যস্ততা রয়েছে তেমনি একজন আইনজীবীকে দৈনিক মিনিমাম ৪/৫ জন বিচারপ্রার্থীর মামলা বিভিন্ন কোর্টে লড়তে হয়। তাই একজন বিচারককে আদালতের সময় মানতেই হবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টেরও নির্দেশনা আছে বলে যতটুকু জানি। উচ্চ আদালতে অনেক সময় বিচারকগণ এজলাসে উঠতে দেরী হলে বিচারক শুরুতেই এর কৈফিয়ত দিয়ে নেন। এটাই শিষ্টাচার।
তানজিম আল ইসলাম বলেন, গতকাল একজন আইনজীবী মাননীয় বিচারকের দেরীতে এজলাসে উঠা নিয়ে প্রতিবাদের দরুণ তাকে ২ ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখা চরমভাবে শিষ্টাচারের লংঘন। যদি আইনজীবী কোন শিষ্টাচার লংঘন করেই থাকেন তাহলে তাকে সংশ্লিষ্ট ফোরামে প্রেরণ করতে পারতেন। আর আদালত অবমাননার অভিযোগ আনতে হলেও তাকে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মানতে হবে।
আর এক্ষেত্রে আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনার সুযোগও সীমিত বলে মনে করেন উচ্চ আদালতের এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ওই আইনজীবী বিচারকের প্রশাসনিক বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন। লাহোর হাইকোর্টের একটি রেফারেন্স অনুযায়ী বরং এ ক্ষেত্রে বিচারকের বিরুদ্ধেই আদালত অবমাননার অভিযোগ আনার সুযোগ রয়েছে।
বিচারককে মুখে বেশি কথা বলা মানায় না, তাকে কথা বলতে হয় কলমে। আইনজীবীকেও সঠিকভাবে শিষ্টাচার এবং বিনয় রেখে বিচারপ্রার্থিকে প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। বিচারকার্যে কারোরই কোন ইগোর স্থান নেই বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে জনসচেতনতা উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান লিগ্যাল ভয়েস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার গাজী ফরহাদ রেজা ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, আইনপেশার গুরুদের কাছে শুনেছি, ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে বিধাতার পরেই বিচারকের অবস্থান, এই অবস্থানকে ধরে রাখা প্রতিটি বিচারকের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি।
ব্যারিস্টার ফরহাদ বলেন, আইনজীবীর কোন দোষ হলে সেজন্য সংশ্লিষ্ট বার এ্যাসোসিয়েশন রয়েছে, কিন্তু আদালতের মধ্যে আইনজীবীকে আটক রাখা বেআইনি তো বটেই, এ ঘটনা সকল বিচারকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। কারণ একজন আইনজীবী যেমন সমগ্র আইনজীবী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেন, ঠিক তেমনিভাবে একজন বিচারক সমগ্র বিচার বিভাগকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
যেহেতু বার ও বেঞ্চ একটি পাখির দু’টি ডানা, সেহেতু একটি ডানা কারাগারে থাকলে পাখিটি উড়তে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন উচ্চ আদালতের এই আইনজীবী।
আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুস সালামের ভাষ্যমতে, কোন বিষয়ে আইনের সুস্পষ্ট বিধানের অবর্তমানে সুবিবেচনার সাথে আদালত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান করবেন এটাই আইনের বিধান; কিন্তু কোন কোন বিচারকের আইনের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই মনে করে বিচারিক মনোভাবের পরিচয় না দেয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আইনজীবী সমাজের ভেবে দেখার সময় যদিও আরও আগেই হয়েছিল, তবুও এখন থেকে ভবিষ্যতে অবিচারক সুলভ আচরণ সম্বলিত বিজ্ঞ বিচারকদের কোর্ট বর্জন করে তাদের ঠিকমতো দায়িত্ব পালনে এবং বারের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে বাধ্য করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবী। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারীতা নয় বলেও উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের ওই আইনজীবী।
জানা গেছে, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য রুবেল আহমেদ ভূঁইয়া ২২ ডিসেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূরের আদালতে মামলা করতে যান। এরপর পেশকারকে জিজ্ঞেস করেন কয়টার সময় বিচারক এজলাসে আসবেন।
পেশকার বললেন, ‘সাড়ে ১০টায় বিচারক এজলাসে উঠবেন। কিন্তু ১১টার পরেও বিচারক এজলাসে না আসায় এই আইনজীবী পেশকারকে বলেন সঠিক সময় বলবেন।
এরপর আদালত এজলাসে আসার পর মামলা শুনানির জন্য ডাক দিলে ওই আইনজীবী সামনে যান। তখন বিচারক ভুক্তভোগী আইনজীবীকে বলেন, আপনি কোর্টে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। তখন ওই আইনজীবী বলেন যে তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন নি।
এরপর বিচারক বলেন, আমি আপনার মামলা শুনবো না। তখন পুলিশ ওই আইনজীবীকে ডেকে লকআপে ভেতর দুই ঘণ্টা আটকে রাখে।
এই বিষয়ে গতকাল ২২ ডিসেম্বর এই আইনজীবী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের বরাবরে একটি লিখিত আবেদন করা হয়।