মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর: আদালতের প্রধান কাজ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং অভিযুক্তকে আইনের বিধান অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিয়ে সুবিচার পাবে এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু হরহামেশাই প্রতিপক্ষকে সামাজিকভাবে হেয় করতে বা হয়রানি করতে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
মিথ্যা মামলা সাধারণত দুইভাবে করা হয়- (ক) এমন মামলা, যার অভিযোগই সত্য নয় বা যা ঘটেছে তা অতিরঞ্জিত করে অভিযোগ করা হয়েছে। আবার এটাও হতে পারে, ঘটনা ঘটেছে কিন্তু আসামিরা ঐ ঘটনার সাথে জড়িত নন। (খ) এমন মামলা, যেখানে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় বাকি আসামিরা থাকেন অজ্ঞাত পরিচয়ে। এদের নাম, ঠিকানা ও বিস্তারিত কোন তথ্যই থাকে না। আবার কোন মামলার সব আসামিই অজ্ঞাত পরিচয়ের হতে পারে।
মিথ্যা মামলা কেন হয়?
দুই ধরণের মামলাই হয়রানিমূলক। সাধারণত প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে বা ব্যক্তিগত শত্রুতা বা আক্রোশ থেকে প্রতিপক্ষকে দমন করতে এ ধরণের মামলা করা হয়। মিথ্যা মামলার মূল কারণ প্রতিপক্ষকে হয়রানি বা ঘায়েল বা কখনো কখনো সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে অর্থ আদায় করা। এক্ষেত্রে শুধু মামলার বাদি নয়, এক শ্রেণির অসাধু পুলিশ এবং আইনজীবীও জড়িত থাকেন।
প্রতিকার কী?
মিথ্যা মামলা হয়ে গেলে তা আদালতের মাধ্যমে লড়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নয়তো বিবাদীর অবর্তমানে বা অনুপস্থিতিতে আদালত বাদীর পক্ষে রায় দিয়ে দিতে পারে। তবে গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ঊচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করা যায়। একই সাথে তদন্ত চলাকালীন সময়ে সঠিক প্রমাণ, দলিল, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি তথ্য দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সহায়তা করতে হবে।
এতে ভোগান্তির শিকার হতে হলেও মিথ্যা মামলা থেকে তাড়াতাড়ি রেহাই পাওয়া যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে পুলিশ গ্রেপ্তার না করে নির্দোষ হিসেবে আদালতের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করলে আদালত অভিযুক্তকে চার্জফ্রেমের (অভিযোগ গঠনের) আগেই ডিসচার্জ (অব্যাহতি) করে দিতে পারে। তবে তা নাহলে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবে মিথ্যা মামলা বাতিলের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করা যায়। সেক্ষেত্রে আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারলে আদালত মামলা স্থগিত বা বাতিল করতে পারেন।
মিথ্যা মামলা করলে শাস্তি
দণ্ডবিধির ২০৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি জালিয়াতি বা হেয়প্রতিপন্ন বা আহত বা বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে অন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতের কোন দাবী করেন যা অভিযোগকারী নিজেই মিথ্যা বলে মনে করেন এবং তা যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে অভিযোগটি মিথ্যা তবে আদালত অভিযোগকারীকে দুই (২) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে অন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা ফৌজদারী মামলা দায়ের করে বা যেখানে আইনগত ও বৈধ কোন কারণ না থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা অভিযোগ উপস্থাপন করে তবে উক্ত মামলাকারী বা বাদী পক্ষকে দুই (২) বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন কিন্তু এমন মিথ্যা ফৌজদারী মামলা যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছর বা উর্ধ্বে কারাদণ্ডে দন্ডিত হতে পারে, সেক্ষত্রে মিথ্যা মামলাকারী বা বাদী পক্ষের সাত (৭) বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যদি নালিশ অথবা পুলিশ বা ম্যাজিষ্ট্রেট কাছে তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে এবং মামলার যেকোন পর্যায়ে ম্যাজিষ্ট্রেট যদি অভিযুক্তকে বা অভিযুক্তদের এক বা একাধিক ব্যক্তিকে খালাস দেন এবং ম্যাজিষ্ট্রেট যদি বুঝতে পারেন যে, অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে পারেন, এই মর্মে যেতিনি কেন ক্ষতিপূরণ দিবেন না। এক্ষেত্রে অভিযোগকারী আদালতে উপস্থিত না থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে আদালতে হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর জন্য সমন জারী করতে পারেন।
উপধারা (২) অনুযায়ী, অভিযোগকারীর কারণ দর্শানোর পরও ম্যাজিষ্ট্রেট যদি মনে করেন আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ১০০০ হাজার টাকা জরিমানা বা তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট হলে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানা করতে পারবেন। জরিমানার অর্থ বিবাদীকেযথাসময়য়ে পরিশোধ করতে হবে অনাদায়ে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০এর১৭অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যকোনব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যেও আইনগত কারণনেই জেনেও এই আইনের যেকোনো ধারায় মিথ্যা অভিযোগ বামামলা দায়ের করেন অথবা করান, তবে অভিযোগকারী অনধিক সাত (৭) বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ এরধারা ৮ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যকোনব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যেও অভিযোগ করার জন্য ন্যায্যবাআইনগত কারণনেই জেনেও এই আইনের যেকোনো ধারায় মিথ্যা অভিযোগ বামামলা দায়ের করেন অথবা করান, তবে অভিযোগকারী অনধিকসাত (৭) বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
এছাড়াও বিভিন্ন স্পেশাল আইনে মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ দায়ের করার জন্য সরাসরি শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে।
মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরী ও সাক্ষ্যের শাস্তি
দণ্ডবিধির একাদশ অধ্যায়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি এবং মিথ্যা সাক্ষ্য ও সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি বিচারিক প্রক্রিয়ার যেকোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা সাক্ষ্য বিকৃত বা উদ্ভাবন করেন তবে উক্ত ব্যক্তির সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন তবে বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা সাক্ষ্য বিকৃত বা উদ্ভাবন করলে তিন (৩) বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধিরি ১৯৪ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা বিকৃত বা উদ্ভাবন করেন যে মামলার শাস্তি মৃত্যুদন্ড তবে উক্ত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন । কিন্তু যদি মিথ্যা সাক্ষ্য দান বা বিকৃত বা উদ্ভাবনের ফলে যদি কোন নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ (১০) বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন
এছাড়াও তথ্য প্রমাণ গোপন করা, অপরাধ সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গোপনে রাখা, সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপন যোগ্য দলিল নষ্ট করা, সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা, মিথ্যা সার্টিফিকেটে সই ও তা সত্য বলে ব্যবহার করা ইত্যাদি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর: আইন বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি