অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

প্রেম ভালবাসা করে পালিয়ে বিয়ের নিয়মাবলী ও বাস্তবতা

সিরাজ প্রামাণিক:

আইনজীবী হিসেবে অনেকে জানতে চান প্রেম করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বিয়ে করা যায়-কি-না, সেই বিয়ে করার নিয়মাবলী কি, কোর্ট ম্যারেজ কি, কোর্টে গিয়ে বিয়ে করার নিয়ম কি, কাজী অফিসে কখন যেতে হয়, এরকম বিয়ে পরবর্তী আইনী ঝামেলায় প্রতিকার কি, পিতা-মাতা মামলা করলে সেই মামলার ফলাফল কি, এ জাতীয় বিয়েতে কত টাকা খরচ হয়-এসব প্রশ্নের আইনী আলোচনায় আজকের নিবন্ধ।

প্রেম-ভালবাসাতো স্বর্গীয়। অনেক সময় ছেলেমেয়েরা তাদের ভালবাসাকে বাস্তবে রুপ দিতে একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় উভয় পরিবারের পিতা-মাতা আত্মীয় স্বজন। অবশেষে তারা পালিয়ে গিয়ে যে কোন পন্থা অবলম্বন করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে তাদের এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার আইনগত ক্ষমতা আছে।

এখন জেনে নেয়া যাক কোর্ট ম্যারেজ কি? কোর্ট ম্যারেজ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের ঘোষণা দেওয়াকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এ হলফনামাটি ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এটি বিয়ের ঘোষণা মাত্র। যে ধর্মেই হোক না কেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক আইন অনুযায়ী প্রথমে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। তারপর তাঁরা ইচ্ছা করলে এ হলফনামা করে রাখতে পারেন। মুসলিম আইনে বিয়ে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। হিন্দু আইনে বিয়ে নিবন্ধন ঐচ্ছিক করা হয়েছে। ছেলেমেয়ে মুসলমান হলে কাবিননামা সম্পন্ন করে না থাকলে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে দাবি করতে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

পালিয়ে বিয়ে করলে পিতা-মাতার পক্ষ থেকে যে মামলা হতে পারে, সে বিষয়ে জানা যাক। বিয়ের প্রথম শর্ত হচ্ছে ছেলে-মেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স ১৮-এর ১ দিনের কম হলেও বয়স গোপন করে বিয়ে করলে মামলা-মোকদ্দমায় পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বিশেষ করে মেয়ের বয়স ১৮-এর কম হলে মেয়ের অভিভাবক অপহরণের মামলা ঠুকে দিলে ছেলেটির জেল-হাজতে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার মেয়েটি আদালতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২২ ধারায় স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে মর্মে জবানবন্দি দিলেও প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ হেফাজতেও থাকা লাগতে পারে।

কাজেই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করতে হলে আইন-কানুনও মানতে হয়। তবে মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন, তাহলে অপহরণের মামলা করেও কোনো লাভ হয় না। বরং মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে মামলা দায়েরকারীকেই উল্টো সাজা পেতে হয়। মামলা হলে মেয়েটিকে জবানবন্দী দিতে হবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-এর সামনে। এটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারার জবানবন্দি নামে পরিচিত। এটি ম্যাজিস্ট্রেট-এর চেম্বারে হয়, কাজেই মেয়েটির উপর কেউ কোন প্রভাব খাটাতে পারেনা। মেয়েরা সাধারণত বলে থাকে “আমি স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে আমার ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করেছি, আমাকে কেউ অপহরণ করেনি। কাজেই যুবক-যুবতি বা নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসাবে একত্রে বসবাস করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে যে হলফনামা সম্পাদন করে থাকে, সেটাই কোর্ট ম্যারেজ নামে পরিচিত। তবে কোর্টে আপনি যাবেন ঠিকই, শুধুমাত্র কাজীর কাছে করা বিয়ের আইনি নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে। এক্ষেত্রে আগেই আপনাকে কাজীর কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রী কাবিনমুলে বিয়ে করতে হবে তারপর নোটারী পাবলিকের কাছে গিয়ে হলফনামা সম্পাদন করে নেবেন।

মনে রাখবেন, বল প্রয়োগে সম্মতি আদায়ে বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে বলে এ বিষয়ে ২১ ডিএলআর এ ২১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। কাবিননামায় উভয় পক্ষের স্বাক্ষর ছাড়া মুসলিম বিয়ে আইনসম্মত গণ্য করা যায় না বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা ৫০ ডিএলআর ১৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।

এবার বিয়ের খরচাপাতি সম্পর্কে জেনে নিই। বিবাহ রেজিস্ট্র্শন ফি দেনমোহরের ওপর নির্ধারণ হয়ে থাকে। দেনমোহরের প্রতি হাজারে বর্তমানে ১২.৫০ টাকা হারে ফি নিকাহ্ রেজিস্ট্রাররা সরকার নির্ধারিত রশিদ প্রদানের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকেন। পূর্বে দেনমোহর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফি চার হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা ছিল। তবে বর্তমানে তা আর প্রযোজ্য নয়। রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দেয়া হলে নিকাহ্ রেজিস্টার একটি প্রাপ্তি রশিদ দিবেন। রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কাগজ স্বামী ও স্ত্রী দুজনের কাছেই রাখতে হবে। অন্যথায় স্ত্রী সমস্যায় পরলে আদালতের কাছে সাহায্য চাইতে পারবেন না। উল্লেখ্য রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধের দায়িত্ব বরপক্ষের। সরকার সময়ে সময়ে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই ফি পরিবর্তন ও ধার্য্য করে থাকে। তবে রেজিষ্ট্রি কাবিননামা না থাকলেও মুসলিম বিয়ে বৈধ হতে পারে।

বিয়ে তো করবেন! সাক্ষী ছাড়া কি বিয়ে হবে? নাহ সাক্ষী লাগবে অবশ্যই। বিয়ের জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক ২ জন পুরুষ অথবা ১ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সাক্ষী থাকতে হবে। মনে রাখবেন যে কোন রেজিস্ট্রিার্ড কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিষ্ট্রার্ড করা যায়। আর হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্ম মতে বিয়ে করতে পারবেন। এবং নোটারী পাবলিকের কাছে গিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে বিয়ের নিবন্ধন করতে পারবেন।

এবার জেনে নিই হিন্দু বিয়ে সম্পর্কে। হিন্দু বিয়েতে এখন পর্যন্ত বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। হিন্দু বিয়েতেও নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়সী ছেলেমেয়ে হলফনামার মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণা দিয়ে থাকে মাত্র। যা পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়ে থাকে।

লেখক: আইনজীবী,বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com