কেশব রায় চৌধুরী

বেঁচে থাকাই আমাদের বড়ো সার্থকতা!

কেশব রায় চৌধুরী :

অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, তবে আমার দৃষ্টিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হয়ে কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করাটা একটা অভিশাপেরই নামান্তর বটে! এখানে যেমন হিন্দু বা বৌদ্ধরা, তেমনি ইন্ডিয়া, মায়ানমার আর চীনের উইঘুরের মুসলিমরা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রয়েছে। আমার মতে আমরা-তারা সকলে কমবেশি অভিশপ্তই!

কেবলমাত্র সংখ্যায় লঘু হওয়ার কারণে এই সংখ্যালঘুদের শৈশব থেকে পদে-পদে যেরকম দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান নানান ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার ছিটেফোঁটাও উপলব্ধি করার অবকাশ হয়ে ওঠে না অধিকাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের-ই। যার কারণেই এ দেশের সংখ্যালঘুদের উপর চলমান ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলীর মাঝেও কেউ কেউ আমাকে “কেমন আছো বা আছিস” মর্মে কুশলাদি জানতে চেয়ে বরাবরের মতো “ভালো আছি” মর্মে প্রতিউত্তর না পেয়ে সাথে সাথেই জানতে চায় “কেন কি হয়েছে তোমার বা তোর”! হৃদয়ের গহীনের ক্ষতটা আসলে ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বুঝানো যেমন কঠিন, তেমনি তাদের পক্ষে বুঝাটাও কঠিন!

না, আমার বা আমাদের কিচ্ছু হয়নি! যা কিছু ঘটে চলেছে কিংবা যা যা ঘটেছে এ কয়দিনে কিংবা এই ক’দিনের মধ্যে যা যা ঘটতে পারে, তাতে আমাদের কিছুই যায়-আসে না কিংবা নতুন করে আমাদের আর কিছু হওয়ারও নেই! এসব সহা আমাদের শুরু হয়েছে তো সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই! তখন থেকে আমরা সইতে সইতে এখন আমাদের সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয়গুলো একদম ভোতা হয়ে গেছে! মৃন্ময়ী প্রতিমার মতোই আমরা এখন হয়ে আছি পুরোপুরি চলৎশক্তিহীন ও অনুভূতিহীন! বলা চলে, সইতে সইতে আমরা এখন হয়ে গেছি সর্বংসহা! জগতের সকল সংখ্যালঘুদের-ই দিনশেষে এমন সর্বংসহা-ই হতে হয়!

এই যে দেখুন, কুমিল্লার একটা পূজামণ্ডপে কোনো এক কুচক্রী মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটা কৃতকর্মের ফলে যখন সারাদেশে আমাদের মন্দিরে আগুন জ্বলে, তখন কিন্তু আমাদের ধর্মের কোনো অবমাননা হয় না! একই অজুহাতে যখন দলবেঁধে হামলা করে কোনো নিরপরাধ সংখ্যালঘুকে পিটিয়ে কিংবা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়, তখনও আমাদের কোনো অনুভূতিতে সেটা কোনোভাবেই আঘাত করে না! একই কারণে যখন আমাদের ঘরবাড়ি কিংবা দোকানপাট লুট করা হয়, তখনও আমাদের কোনো অনুভূতি থাকতে নেই! এমনকি একই ঘটনাপ্রবাহে যখন আমাদের মা-বোনেরা গণধর্ষণের শিকার হয়, তখনও আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে নেই! আমরা যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু! এই সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অবমাননা বলতে আসলে কিছু নেই কিংবা তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগারও কোনো প্রশ্নই ওঠে না কস্মিনকালেও! এটাই চিরায়ত সর্বকালের, সর্বস্থলের।

একইভাবে গোমাংসজনিত ঘটনায় কিংবা কেবলমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে যখন ইন্ডিয়াতে কোনো মুসলিমকে নির্য়াতনের শিকার হতে হয়, তখন কিম্তু তাদেরও কোনো অনুভূতি দেখানোর অবকাশ থাকে না! মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হওয়া কিংবা পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা-মুসলিমদের বেলায়ও কোনো অনুভূতি থাকতে নেই! সেখানে ঘরবাড়ির সাথে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পুড়লেও তাতে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কোনো সুযোগ-ই নেই! চীনের উইঘুরের মুসলিমরা কিংবা তিব্বতের বৌদ্ধদের বেলায়ও বিষয়টা কিন্তু তাই-ই!

সবই যে একসূত্রে গাঁথা! এমন আমরা সকলেই নিজ নিজ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু! আমাদের অনুভূতিতে কোনোপ্রকারের আঘাত লাগতে পারে না শত ক্ষত কিংবা নিদারুণ ক্ষতিতেও; কিংবা আমাদের স্ব স্ব ধর্মের অবমাননা বলতেও কিছু থাকতে পারে না আমাদের মন্দির কিংবা মসজিদ পুড়লেও! আমরা অভিশপ্ত! এখানে বেঁচে থাকাটাই আমাদের আজ এক বড়ো সার্থকতা!

লেখক: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ।