বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) বাংলাদেশের সংবিধান দিবসে “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংবিধানের ৫০ বছর: প্রান্তিক জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি” শীর্ষক একটি অনলাইন আলাপচারিতার আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ডিপার্টমেন্ট অব ল এন্ড হিউম্যান রাইটস) এবং UNESCO Madanjeet Singh South Asian Institute of Advanced Legal and Human Rights Studies (UMSAILS) এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আলাপচারিতায় বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সংবিধানিক প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।
আলাপচারিতায় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সভাপতি সি এম শফি সামি সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলেন, পাকিস্তান তাদের সংবিধান প্রণয়ন করতে প্রায় ৯ বছর সময় নেয়, যা পরবর্তীতে বাতিল হয়ে যায়, একইসাথে ভারতও তাদের সংবিধান প্রণয়নে প্রায় ২ বছর সময় নেয়। কিন্তু যুদ্ধ বিদ্ধস্ত অবস্থায়ও বাংলাদেশ মাত্র অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে তাঁর সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছিল, যা কেবলমাত্র বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ সংবিধান প্রণেতাদের বিচক্ষণতার ফল।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি এবং সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের সংবিধানের একটি মূলনীতি হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা; যা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি আপোষহীন অবস্থান রক্ষা করে যাবো। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজের সর্বস্তরে সমতা, বৈষম্যহীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেতনায় সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়। সংবিধানের এই সকল চেতনাকে সমুন্নত করার জন্য সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এডভোকেট সুলতানা কামাল মনে করেন, এদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, কেননা তা ছিলো যতখানি রাজনৈতিক, ঠিক ততোখানি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক; সেই সাথে তা ছিলো নারীমুক্তির এক আন্দোলন, যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নারীরা দৃঢ়তার সাথে স্বপ্রণোদিত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি আরো মনে করেন, সংবিধানের বলবৎ হওয়ার পরেও দেশে বৈষম্যমূলক আইনগুলো বিদ্যমান থাকা সংবিধানের মূল চেতনাকে অর্থহীন করে দেয়ার শামিল।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর – উল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে, সংবিধানের চেতনায় সমাজ বির্নিমাণে নাগরিক সংগঠনগুলোকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনাসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে উল্লেখ করেন।
তাকবির হুদা, সমন্বয়কারী, জাস্টিস ফর অল নাও (জানো) বাংলাদেশ বলেন, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের উচিত বিচার খাতে আরো বিনিয়োগ করা, সেই সাথে বৈষম্য বিলোপ আইন, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা সহ অপরাধের ভুক্তভোগীদের জন্য সরকার কর্তৃক একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করা প্রয়োজন।
মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী, প্রতিষ্ঠাতা, সাপোর্টিং পিপল এন্ড রিবিল্ডিং কমিউনিটিস (স্পার্ক ) এর দৃষ্টিতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি যে কোন ধরণের সহিংসতার ঘটনা তদন্ত ও মনিটরিং/পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব একতরফা শুধু মানবাধিকার কর্মীদের নয়, এ দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক যেন নিরাপদে থাকতে পারে তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এ দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারে; কিন্তু মূল দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
ড. ফস্টিনা পেরেরা, সিনিয়র ফেলো, সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিস এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এর সঞ্চালনায় এ আলাপচারিতায় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এর উপাচার্য (দায়িত্বপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মো: সুলতান মাহমুদ সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী,সাংবাদিকসহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
সর্বোপরি, অনুষ্ঠানে বক্তাগণ সংবিধানের মূল চেতনা উজ্জীবিত করতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেনএবং একইসাথে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন নিপীড়নের ঘটনায়রাষ্ট্র যেন তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেন।
-সংবাদ বিজ্ঞপ্তি