বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক উত্থান পতন হয়েছে। সামরিক শাসন থেকে জরুরি অবস্থা, রাষ্ট্রপতি শাসিত থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা—সবই হয়েছে এই দেশে। তাই সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিবিদদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একটা পরিচিত সংস্কৃতি হয়ে গেছে। সেই সংস্কৃতি থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেউই বাদ পড়েননি। দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হতে হয়েছে সবাইকে।
তবে ব্যতিক্রম ছিল বিচার বিভাগের শীর্ষস্থান প্রধান বিচারপতির পদটি। বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রধান বিচারপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পদত্যাগের এই ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা শুধু এখানেই ব্যতিক্রম নন, দেশের প্রথম কোনো প্রধান বিচারপতি হিসেবে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয় বিচারের কাঠগড়ায়। শেষ পর্যন্ত দণ্ডিতও হতে হয়েছে, যা দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
দুদক কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম রায়ের বিষয়ে বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না। অপরাধী যত শক্তিশালী হোক না কেন, যত বড় পদেই আসীন থাকেন না কেন, আইনের আওতায় তাকে আসতে হবে। যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তবে তাকে সাজাভোগ করতে হবে।
সাবেক প্রধান বিচারপতির সাজা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি পদে থাকাকালে তার যে অবস্থান, সেই অবস্থানে থেকে যে কাজগুলো করেছেন, সেটা প্রসিকিউশন সফলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই তার বিরুদ্ধে সাজা হয়েছে, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
রায় ঘোষণার পর আসামিদের আইনজীবী মো. শাহীনুর ইসলাম অনি বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতির সাজা হওয়াটা যে কোনো বিচারব্যবস্থার জন্য কোনো সুখদায়ক বিষয় না। আমরা যারা এই অঙ্গনে আছি, যারা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত, যখন প্রধান বিচারপতির সাজা হচ্ছে কোনো মামলাতে, তখন আলটিমেটলি নেতিবাচক প্রভাব বলেই মনে করি।
এই মামলার শুরু থেকেই এস কে সিনহা পলাতক থাকায় তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। এখন আইনিভাবে তাকে এই মামলা মোকাবিলা করতে হলে আগে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে বলেও জানান মামলায় আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বের কোথাও প্রধান বিচারপতির আর্থিক কেলেঙ্কারির সাজা হয়েছে কিনা, সেটি জানি না। তবে উন্নত দেশে অনেক সময় দেখেছি— একজন বিচারপতিকে ইমপিচমেন্ট করা হয়েছে। উনি স্কুলজীবনে হাশিশ (এক ধরনের মাদক) খাইতেন। কিন্তু আর্থিক কেলেঙ্কারি বা মানিলন্ডারিংয়ের জন্য দুর্নীতির দায়ে বিশ্বের কোনো দেশে প্রধান বিচারপতির বিচার হয়েছে কিনা বলতে পারব না।
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের দেশে এর আগে হয়নি, এটি আমরা জানি। পাকিস্তান আমলেও এটি হয়েছে কিনা জানা নেই। ভারতবর্ষে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ইলিগেশন আসছে, কিন্তু মানিলন্ডারিং বা দুর্নীতির জন্য উনার বিরুদ্ধে সাজা হয়েছে, এটি আমার জানা নেই।’
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের একুশতম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এস কে সিনহা। দুই বছর নয় মাস ২৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর ছুটিতে বিদেশে থাকা অবস্থায় দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
এস কে সিনহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের কাছে একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর উপস্থাপন করা হয়। পরদিন সিনহার সঙ্গে বৈঠকের পর আপিল বিভাগের সতীর্থ বিচাপতিরা তার সঙ্গে একত্রে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান।
২০১৭ সালের ২ অক্টোবর তিনি এক মাসের ছুটিতে যান। এরপর ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার অনুমতি নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। ছুটি শেষে দেশে ফেরার ঘোষণা দিলেও ১১ নভেম্বর সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতি বরবাবর পদত্যাগপত্র পাঠান।
পদত্যাগের এক বছর আট মাস পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে চার কোটি টাকা স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করার অভিযোগে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। পাঁচ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সেই মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুটি অ্যাকাউন্ট খুলে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
জামানত হিসেবে আসামি রণজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এসকে সিনহার পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।
দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন।
ওই বছরের ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর ‘অস্বাভাবিক দ্রুততার’ সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস কে সিনহার নামে। এরপর ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর।
মামলা তদন্ত করে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট একই আদালত ১১ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। চলতি বছর ২৪ আগস্ট মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। এরপর দুদক ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা করা হলো।