লুৎফর রহমান শিশির

একটি প্রত্যাশিত আদালত-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো

লুৎফর রহমান শিশির:

রাষ্ট্রে আদালত তথা বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থিত থাকে মূলতঃ নাগরিকদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির স্থান হিসেবে। ন্যায়বিচার প্রদান কোন দয়ার দান নয়, এটা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। জনকল্যাণমূলক, আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষ কোন ব্যক্তি দ্বারা নয়, কেবলমাত্র আইন দ্বারা শাসিত হবে – এটিই হল নীতি। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। একটি আদালতকে বাহ্যত ও কার্যত যেমন হওয়া উচিত তা নিয়েই এই লেখা।

আদালতকে সর্বাগ্রে নিরপেক্ষ বিচার প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। সততা-দৃঢ়তা-নিরপেক্ষতা ও আদালতের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। মামলার কোন পক্ষ ধনী, ক্ষমতাশালী হতে পারে। কিন্তু আদালত সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে কোনমতে প্রভাবিত হবে না এটিই প্রত্যাশিত। আদালতকে জনতুষ্টিমূলক সিদ্ধান্ত নিলে চলে না। একটি ঘটনার আদ্যোপান্ত প্রায়শঃ জনগণের জানা থাকে না। আদালত তার কাছে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি, প্রচলিত আইন এবং বিচারিক মন ও সুবিবেচনার সমন্বয় ঘটিয়ে রায় বা আদেশ প্রদান করবেন। জনতুষ্টির কথা মাথায় রেখে সঠিক বিচার পাওয়া যায় না।

নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করার অন্যতম একটি হাতিয়ার হলো আইনী প্রক্রিয়াগুলো স্বচ্ছতার সাথে যথাযথভাবে পালন করা। প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা ন্যায়বিচারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দ্রুততর সময়ে বিচার প্রদান করাও জরুরী, নয়তো বিচারপ্রার্থী জনতা ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। জনবহুল এই দেশে আমাদের আদালতগুলো মামলার ভারে ভারাক্রান্ত। তবে আইনে থাকা বিধানগুলো সঠিকভাবে মেনে চলা হলে দ্রুত বিচার প্রদান করা অনেকটাই সম্ভব।

একটি কার্যকর বিচার বিভাগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানুষের বিচারপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ-অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে মানুষকে বিচার প্রদান করতে হবে। মানুষ যাতে সহজে বিচারের নাগাল পায়, কোর্টে বা থানায় যাতে তার অভিযোগটা কোন হয়রানী ছাড়াই শোনা হয় তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। একেবারে নালিশ দায়েরের পর্যায় থেকে মামলার রায়ের জাবেদা নকল প্রাপ্তি পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি।

আদালতকে অবশ্যই লিঙ্গ-সংবেদনশীল হতে হয়। তাকে মানবাধিকারের পরিষ্কার ধারণা রাখতে হয়। তাকে শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। মানবাধিকার, নারী অধিকার, শিশু অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিসমূহ সম্পর্কে আদালতের স্পষ্ট ধারণা রাখতে হয়। রাষ্ট্র তার আভ্যন্তরীন আইন প্রণয়ন সংস্থা ও আদালত-ব্যবস্থার মাধ্যমেই ঐসকল আন্তর্জাতিক বিধিবিধানগুলো জাতীয়ভাবে বাস্তবায়ন করে থাকে।

আইন অন্ধ –এমন একটি পুরনো প্রবাদের সাথে আমরা পরিচিত। আইন ও আদালত হয়তো জড় সত্তা, কিন্তু বিচারককে অন্ধ হলে চলে না। তাকে চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। তাকে সমাজকে, সর্বোপরি মানুষকেও বুঝতে হয়।

গণমানুষের আস্থা বিচার বিভাগের ভিত্তি গড়ে তোলে ক্রমাগত। এই আস্থা আপনি-আপনি জন্ম নেয় না। বিচার বিভাগ মানুষের আশা-ভরসা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির শেষ আশ্রয়স্থল। মানুষ মনে করুক, তার কথা শোনার জন্য আদালত আছে।

লেখক: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, চুয়াডাঙ্গা।
rahmanshishir@gmail.com