আইনজীবীর ভুলের কারণে ৭০ ভাগ মামলায় মামলার পক্ষরা পরাজিত হয় বলে মন্তব্য করেছেন দেশে কর্পোরেট প্র্যাকটিসের অন্যতম সেরা আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব-উল আলম। তিনি বলেন, নবীন আইনজীবীর পক্ষে মামলায় ভুল করা স্বাভাবিক, এ কারণে আগে সিনিয়রের সাথে থেকে মামলা পরিচালনা করা শিখতে হবে।
ডি জুরি একাডেমি আয়োজিত ‘ক্যারিয়ার ইন কর্পোরেট ল’ শীর্ষক এক ক্যারিয়ার আড্ডায় গতকাল শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী এমন মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে আইন শিক্ষার্থী এবং নবীন আইনজীবীরা কর্পোরেট ল প্র্যাকটিসে কিভাবে নিজেকে এস্টাব্লিসড করতে পারেন সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নানান পরামর্শ প্রদান করেন এবং তরুণদের উৎসাহিত করেন।
এদিন ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম জুমের মাধ্যমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি কর্পোরেট ল প্র্যাকটিসে তার সংযুক্ত হওয়া, তরুণ আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবনের শুরু, পাওয়ার প্রোজেক্ট এবং টেলিকম সেক্টরে কাজের অভিজ্ঞতা ও আইনের খসড়া প্রণয়ন, নবীন আইনজীবীদের এই সেক্টরে ভাল করার উপায় এমনকি কিভাবে একজন নবীন আইনজীবী ভাল চেম্বারে জয়েন করতে পারেন, ভাল চেম্বারে জয়েন করতে একজন আইনজীবীর কোন গুলো অর্জন করতে হবে সে বিষয়ে চমৎকার কিছু বাস্তবধর্মী পরামর্শ প্রদান করেন।
ব্যারিস্টার সাদিয়া আফরোজের সঞ্চালনায় উক্ত ক্যারিয়ার আড্ডা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি বলেন, ১৯৯৭ সালের দিকে তিনি দেশে ফিরে ডঃ কামাল হোসেন এন্ড এসোসিয়েটস ল ফার্মে এসোসিয়েট হিসেবে জয়েন করেন। ফার্মটির বিশেষত্ব হচ্ছে সেখানে কমার্শিয়াল, ট্রান্স ন্যাশানাল এবং ক্রসবর্ডার ট্রানজেকশন এর ইন্সট্রাকশনগুলো আসতো। সেই সুবাদে তিনি সবচাইতে জুনিয়র লয়ার হিসেবে কাজ করবার সুযোগ পান। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশে পাওয়ার এবং টেলিকমিউনিকেশন সেক্টর দুটি প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট এর জন্য ওপেন আপ হয়। আইপিপি পলিসি গভর্নমেন্ট ডিক্লেয়ার করে ১৯৯৬ সালে। যেটার মাধ্যমে ইন্ডিপেনডেন্ট প্রাইভেট প্রডিউসাররা পাওয়ার প্রোজেক্ট করতে পারতো। সেই সময়ে এই কনসেপ্টটি একদমই নতুন ছিল বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের কোন কোম্পানির কোয়ালিফিকেশন ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল না হওয়ায় প্রচুর ফরেইন ইনভেস্টরদের কাছ থেকে ইন্সট্রাকশন পেয়েছি।
ব্যারিস্টার তানজিব জানান, ঐ সময়ে একটা পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট কিভাবে করতে হয় কিংবা সরকার যখন একটা পাওয়ার প্রোজেক্টকে বাংলাদেশে ইনভাইট করে তখন কি কি এগ্রিমেন্ট সেখানে থাকে বা সেই এগ্রিমেন্টে কোন ক্লজগুলো থাকে এবং সেই ক্লজগুলোর ইন্টাররিলেশনশিপ কি সেই সম্পর্কে কাজ করতে গিয়ে পাওয়ার সেক্টর নিয়ে পরিচিতি আসে।
পরবর্তীতে পাওয়ার সেক্টরের মত টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরকেও প্রাইভেট সেক্টরে উন্মুক্ত করতে এবং বাংলাদেশ সরকারকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে বিশ্ব ব্যাংক তাদের ফার্মকে এনগেজ করে বলে জানান এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, সরকার গ্রামীণফোন, একটেল ও সেবা এই তিনটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দিলেও এই তিনটি কোম্পানিকে পরবর্তীতে কিভাবে রেগুলেট করবে, টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরটিকে এগিয়ে নিতে যে নতুন আইনের প্রয়োজন আছে সে বিষয়ে সরকার টেকনিক্যাল বিষয়গুলির জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহযোগিতা চাইলেএই বিষয়ে লিগ্যাল এক্সপার্ট হিসেবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক তাদের চেম্বারে আপ্রোচ করে আইনটির ড্রাফট তৈরির জন্য।
ব্যারিস্টার তানজিব আলম জানান, সবচাইতে জুনিয়র এসোসিয়েট হিসেবে ফার্স্ট ড্রাফটের দায়িত্বটি তার উপর এসে বর্তায়। তিনি এটাকে অপরচুনিটি হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি নিজে সাইন্সের ছাত্র না হওয়ায় এবং পূর্বে টেলিকমিনিউকেশন সম্পর্কে ন্যূনতম কোন ধারণা না থাকা সত্ত্বেও তাকে যখন দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তিনি টেলিকমিউনিকেশন নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা শুরু করেন।
তিনি জানান, টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে ইঞ্জিনিয়ারিং পার্ট সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আইন তৈরি করা সম্ভবপর নয় এই বিবেচনায় টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে এই বিষয়ে প্রচুর সময় ব্যয় করি। একইসাথে টেলিকম রিলেটেড আইন নিয়ে রিসার্চ করে ফার্স্ট ড্রাফ্টটি তৈরি করি। পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সেই ড্রাফটটি বাংলাদেশ সরকারের নিকট প্রেজেন্ট করলে বাংলাদেশ সরকার সেই ড্রাফটটি এডপ্ট করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ তৈরি করে।
প্রথম আইনটির ড্রাফট তৈরির অভিজ্ঞতা অর্জনের পরপরই পাওয়ার সেক্টর নিয়ে একটি আইন প্রণয়ন জরুরী হয়ে পড়ায় পরবর্তীতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর খসড়া প্রণয়ণের দায়িত্বটিও পান ব্যারিস্টার আলম।
তিনি জানান, পাওয়ার পারচেজে ট্যারিফ কিভাবে নির্ধারিত হয়, ফুয়েল কঞ্জাম্পশন নিয়ে কোন ধরণের বিধান থাকা উচিত বা ডিসপিউট রেজুলেশন মেকানিজম কিংবা বিলিং সাইকেল, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, ফিনান্সিং কিভাবে করতে হয় অর্থাৎ পাওয়ার প্রোজেক্ট রিলেটেড যত ধরণের এক্টিভিটি আছে প্রতিটি এক্টিভিটির একটা লিগ্যাল আসপেক্ট থাকায় সেগুলো নিয়ে তাকে জানতে হয়েছে।
ব্যারিস্টার তানজিব জানান, পরবর্তীতে যখন পাওয়ার প্রোজেক্ট নিয়ে কোন কন্ট্রাক্ট হয়েছে, পূর্বে এই বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় তাকেই ডাকা হয়েছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ব্যারিস্টার সাদিয়া আফরোজ কর্পোরেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত পড়াশোনার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার তানজিব আলম বলেন, একটি এলএলএম ডিগ্রি প্র্যাকটিসে কোন আলাদা সুবিধা দিবে না। প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে এলএলএম বা পিএইচডির অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্র্যাক্টিকাল ফিল্ডে কাজ করা।
তিনি জানান, প্র্যাক্টিকাল ফিল্ডে একটা মামলা হ্যান্ডেল করলে যে অভিজ্ঞতা হয় সেটা কয়েকটি মাস্টার্স ডিগ্রীর চেয়েও বেশি। তবে কেউ যদি একাডেমিক লাইনে ক্যারিয়ার গড়তে চান বা স্পেসিফিক সেক্টরে চাকরি করতে চান, সেক্ষেত্রে মাস্টার্স জরুরী।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, কোন কোম্পানি যদি কমার্শিয়াল ল এর কোন এক্সপার্ট খোঁজে এবং সেখানে সিভিতে যদি কমার্শিয়াল ল এর উপর কোন এলএলএম থাকে তবে নিসন্দেহে তিনি প্রেফারেন্স পাবেন।
কোন গুণগুলো থাকলে একটি ভাল চেম্বারে জয়েন করা সহজ হবে, এক নবীন আইনজীবীর জন্য এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার তানজিব আলম ডি জুরি একডেমির উক্ত ক্যারিয়ার আড্ডায় অংশ নেয়া আইনের ছাত্র, নবীন আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ভাল চেম্বারে জয়েন করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভাল ড্রাফটিং স্কিল।
ড্রাফটিং স্কিল এর বিষয়ে জর্জওয়াশিংটনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আইন এক ধরণের সাহিত্য, সেইসাথে সাহিত্যও কোন না কোন ভাবে আইন। ভাষাগত দক্ষতা ভাল না হলে, মক্কেল কি বলতে চায় সেটা কখনোই প্লিডিংসে আনা সম্ভব নয়। ভাল চেম্বারগুলো নবীন আইনজীবী কোথায় পড়াশোনা করেছেন তার চাইতে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন ড্রাফটিং এ তিনি কতটুকু ভাল।
এ সময় তিনি ড্রাফটিং এর পাশাপাশি যত্নের সাথে সিভি তৈরির বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি জানান, সিভির প্রত্যেকটি শব্দ, শব্দের ফন্টও এখানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ থেকে আবেদনপ্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
তিনি উদাহরণ টেনে বলে, “আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী। সিভি দেখেই যদি নিয়োগকর্তা আবেদনকারী সম্পর্কে ভাল ধারণা না পান তাহলে পরের ধাপেই তিনি আগাবেন না। অনেকে সিভিতে অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করেন নিজের সম্পর্কে বলতে যেয়ে, তিনি এসব বিষয়ে সতর্ক করেন।
তিনি জানান, চিন্তার স্বচ্ছতা থাকলে লেখার মধ্যেও সিমপ্লিসিটি থাকবে। কোন একজন আবেদনপ্রার্থী যদি নিজের সামাজিক সংগঠনে কাজ করবার অভিজ্ঞতা বলতে যেয়ে অনেকগুলো সংগঠনের কথা সিভিতে উল্লেখ করেন, সেটা অনেক ক্ষেত্রে আবেদনপ্রার্থীর জন্য বুমেরাং হতে পারে। নিয়োগ কর্তৃপক্ষ সেক্ষেত্রে মনে করতে পারেন, আবেদনকারী সামাজিক কাজেই অনেক বেশি ইনভল্ভ ,তিনি পেশায় মন দিতে পারবেন না।আবেদনকারীকে ব্যাল্যান্স করতে হবে।
কর্পোরেট প্র্যাকটিস করতে কোন একটি চেম্বারে জয়েন করা জরুরি নাকি ইন্ডিভিজুয়াল প্র্যাকটিস করা পসিবল এই বিষয়ে ব্যারিস্টার আলম জানান, যারা এলএলবি, এলএলএম বা পিএইচডি করে এসে মনে করেন তিনি সিনিয়র ছাড়া ক্যারিয়ার শুরু করবেন, এটা হবে তাদের জীবনের চরমতম ভুল। প্র্যাক্টিক্যাল পারস্পেক্টিভে আইনপেশা হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা।
তিনি জানান, মামলা কিভাবে করতে হয় এটা না জেনে কোন মামলা করতে গেলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মক্কেল। প্রতিটি মামলার ফ্যাক্ট ভিন্ন হওয়ায় প্রতিটি মামলার প্লেইন্টও ভিন্ন। ফলে শুধু কপি করেই মামলা করা শেখা যায় না।
তিনি বলেন, বাঘের বাচ্চা যেমন জন্ম নিয়ে প্রথম দিনেই হরিণ শিকার করতে পারে না, আগে ছোটখাট জন্তু শিকার করে হাত পাকাতে হয় ঠিক তেমনি মামলার ক্ষেত্রেও প্রথম দিন কোর্টে যেয়েই মামলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আর্ট অফ এডভোকেসি, কিভাবে কোর্টকে এড্রেস করতে হয়, মামলা কিভাবে সাজাতে হয় এগুলো আগে শিখতে হয়।
এ সময় তিনি গবেষণার উদাহরণ টেনে বলেন, ৭০% মামলায় মামলার পক্ষরা হারে আইনজীবীর ভুলের কারণে। নবীন আইনজীবীর পক্ষে মামলায় ভুল করা স্বাভাবিক, এ কারণে আগে সিনিয়রের সাথে থেকে মামলা পরিচালনা করা শিখতে হবে।
তবে তিনি এটাও বলেন, সিনিয়রদের সাথে থেকে প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে ফিস কিছুটা কম পেলেও যখন আপনি কোন মামলা পরিচালনা করে জিতবেন, সেটা আপনার ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে কাজ করবে। চাকরি করে হয়তো আপাত জীবিকা নির্বাহ করা সহজ হয় তবে লং টার্মে প্র্যাকটিসে থাকাটা আইনজীবীর জন্য বেশি লাভজনক।
তিনি কর্পোরেট প্র্যাকটিসে পড়াশোনার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং বা ফারমাসিটিক্যাল সেক্টরে কিংবা পাওয়ার প্রোজেক্ট বা টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে কাজ করতে সেই সেক্টরটি সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে, সে বিষয়গুলো বুঝতে প্রচুর পড়াশোনা করা জরুরী।
ডি জুরি একাডেমির ক্যারিয়ার আড্ডায় ব্যারিস্টার সাদিয়া আফরোজের সাথে ক্লোজ সেশন শেষে প্লাটফর্ম সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সারাদেশ থেকে জুমে সংযুক্ত হয়ে আইনের ছাত্র, নবীন আইনজীবীরা ব্যারিস্টার তানজিব আলমের সাথে সরাসরি কথা বলে কর্পোরেট প্র্যাকটিসে টিকে থেকে ভাল করবার বিভিন্ন পরামর্শ লাভ করেন।
সবশেষে আমন্ত্রিত অতিথি আইনপেশায় সততা বজায় রেখে প্র্যাকটিস করবার পরামর্শ প্রদান করেন নবীন আইনজীবীদের।
উল্লেখ্য, ডি জুরি একাডেমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কেন্দ্রিক একটি অনলাইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে অভিজ্ঞ বিচারক ও স্বনামধন্য আইনজীবীদের মাধ্যমে তরুণ আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার ছিল সরকার নিবন্ধিত আইন বিষয়ক দেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।