বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নয়ন কুমারের বিরুদ্ধে ভাইকে হত্যার ঘটনায় ১২ বছর বয়সী শিশুকে ‘জোর করে’ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে সিআইডির পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়ায় সরকার সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
বগুড়ার জুভেনাইল কোর্টে মামলার বিচার কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা ফৌজদারি রিভিশন আবেদনের শুনানি রোববার (২৮ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বিস্ময় প্রকাশ করেন।
আদালতে এদিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
শুনানিতে যা হলো
আদালত বলেছেন, ১২ বছরের শিশুকে তার আপন ছোটভাইকে হত্যার স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য নির্যাতন করা হয়েছিল। এটা কতটা অমানবিক। কেন এবং কীভাবে তিনি (নয়ন) এটি করেছেন, তা তদন্তের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, উল্টো তাকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা তার (নয়নের) কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি। তবে উত্তরে তিনি বলেছেন- তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়নে অনার্স ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তিনি এটা লিখে তার কাজকে ন্যায্যতা দিতে চেয়েছিলেন, যা ক্ষমার অযোগ্য।
নয়নের আইনজীবী শানজিদা খানম হাইকোর্টকে বলেন, তার (নয়ন) সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কারণ তিনি তখন একজন নতুন কর্মকর্তা এবং একজন তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হিসেবেও নতুন দায়িত্বে ছিলেন।
নয়ন কুমার নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন এবং তিনি ভবিষ্যতে এমন কাজ করবেন না বলেও জানিয়েছেন তার আইনজীবী।
নয়ন বর্তমানে একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পুলিশ ব্যাটালিয়নের অফিসে দায়িত্বে রয়েছেন। তার আগের নির্দেশ অনুসারে বেঞ্চের সামনে হাজির হন।
শুনানিতে পিটিশনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, মেডিকেল রিপোর্টে দেখা গেছে, ১২ বছর বয়সী ওই শিশুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশ হেফাজতে থানায় নির্যাতন করে তার ছোট ভাইকে হত্যার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে। ওই ঘটনায় নয়ন কুমারের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
এর আগে সিআইডির পরিদর্শক নয়ন কুমারকে সব ধরনের তদন্তকাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তার বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণ ও অদক্ষতার প্রাথমিক প্রমাণ মেলায় ওই আদেশ দেওয়া হয়।
ওই সময় শুনানিতে নয়ন কুমার সম্পর্কে হাইকোর্ট বলেন, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এখানে বিষয় না, সে অপরাধ করেছে।
শুনানি শেষ করার পর হাইকোর্ট পিটিশনে আদেশ দেওয়ার জন্য ১৩ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন এবং নয়নকে সেই দিনে উপস্থিত থাকতে বলেছেন।
এর আগের ঘটনা
গত ২৫ অক্টোবর জানানো হয়েছিল, বগুড়ায় ছোটভাইকে হত্যার ঘটনায় ১২ বছর বয়সী শিশু ও আপন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ‘জোর করে’ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার ঘটনায় সারিয়াকান্দি থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক নয়ন কুমারকে (পরিদর্শক সিআইডি, নাটোর) কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বদলি করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে কোনো মামলার তদন্তকাজ (দায়িত্ব) দেওয়া হবে না বলেও জানানো হয়েছে হাইকোর্টকে।
এর আগে তাকে বাংলাদেশ পুলিশের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) এপিবিএন শাখায় বদলি করা হয়েছিল।
এদিকে, সাবেক তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য অ্যাডভোকেট মো. মনিরুজ্জামানকে নতুন করে আইনজীবী নিয়োগ করা হয় ওইদিন। এ অবস্থায় আদালতের কাছে সময় চাওয়ার প্রেক্ষিতে মামলার শুনানির জন্য আগামী ২১ নভেম্বর পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট। তারই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি শুনানি হয়।
এর আগে ‘জোর করে’ স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়ে হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা চান সারিয়াকান্দি থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক নয়ন কুমার। তিনি ওই মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা।
গত ৬ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত দিনে হাইকোর্টে নয়ন কুমার সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে অন্য তদন্ত কর্মকর্তা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
এর আগে গত ২৯ জুন এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে সারিয়াকান্দি থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক নয়ন কুমারকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। অন্য তদন্ত কর্মকর্তাকেও তলব করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় নয়ন কুমার আদালতে হাজির হন। লিখিত ব্যাখ্যায় তিনি নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ার কাটাখালীতে একটি পাটক্ষেতে মো. সোহাগ নামে আট বছরের এক শিশুর মরদেহ পাওয়া যায়।
গত ১১ জুন একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে এ মামলার বিষয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে সোহাগের বড়ভাই ১২ বছরের সৌরভ মিয়ার ওপর নির্যাতন এবং তাদের পরিবারের দুর্ভোগের বর্ণনা তুলে ধরা হয়।
জোর করে ১২ বছর বয়সী শিশুর স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে বগুড়ার আদালতে বিচারাধীন হত্যা মামলার যথার্থতা ও আইনগত বিষয় পর্যালোচনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত ২০ জুন হাইকোর্টে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী।
এরপর ব্যাখ্যা দিতে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুমারকে তলব করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি মামলার কেস ডকেট (সিডি) নিয়ে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মনসুর আলীকেও আদালতে যুক্ত থাকতে বলা হয়।
নির্দেশ অনুযায়ী মনসুর ও নয়ন আদালতে হাজির হন এবং শিশুর কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি নেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন। সেই সঙ্গে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেন নয়ন।
তবে নয়ন কুমারের লিখিত ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি আদালত। এরপর ওই শিশুর মেডিকেল রিপোর্ট তলব করা হয়। সেখানে দেখা যায়, শিশুকে নির্যাতন করা হয়েছে।