প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বগুড়ার সেই বিচারককে প্রত্যাহার
বিচারক (প্রতীকী ছবি)

সোনালী চিল, কান আর এক নিরীহ বিচারকের গল্প

আদিলুর রহমান:

এক

‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,

চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’।

এই লাইন দুটি বিখ্যাত কবি শামসুর রহমানের অনবদ্য কবিতা ‘পণ্ডশ্রম’ থেকে নেয়া। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-৭ এর এক রায় নিয়ে এই কান-চিল অবস্থা বিরাজ করছে বাংলাদেশে। আর পরবর্তীতে যখন লিখিত রায় সামনে আসলো তখন সবারই বয়ান পাল্টানোর হিড়িক পড়লো।

আদালতের ভিতরে আদালতের কার্যক্রম রেকর্ড করা যায়না বা ছবি তোলা যায়না। কেন যায়না, আমিও জানিনা। হয়তো কোনো আইনে মানা আছে। আদালতে প্রকাশ্যে বিচার হয়। আর প্রকাশ্যে বিচার হলে মিডিয়ার চোখ হয়ে মানুষ তা দেখতে কী সমস্যা আজও অনেকেরই বোধগম্য নয়। বিদেশে আদালতের অনেক কার্যক্রম সরাসরি জনগণকে দেখানো হয়। এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু কিছু কিছু দেশে এসব হয়না। যার কারণে অনেকেরই উপর গুজব, গজব দুইটাই নেমে আসে।

কোনও এক মিডিয়ায় আসলো, ৭২ ঘন্টার পরে ধর্ষণের মামলা নেয়া যাবেনা – বাণীতে রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচারক। ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো বিচারকের মুণ্ডপাত। উপরমহল থেকে নিচু মহল সবখানেই চললো সমালোচনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় – একটি বারের জন্যও কেউ উক্ত সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুললোনা! বলা হচ্ছে ওই লাইনটি আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল। পর্যবেক্ষণ আর নির্দেশ যাই থাকুকনা কেন সবই রায়েরই অংশই বটে। কিন্তু সাংবাদিক সাহেব ফরমাল রায় বের হবার আগেই কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে উক্ত বিচারক হুবুহু ওই কথাটি বলেছেন! ঐ বিচারক কী ঐ সাংবাদিককে রায়টি লেখার আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? আইনে পড়া প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও জানে – ফৌজদারি মামলা দায়েরে কোনো সময়সীমা নাই। তাহলে যিনি জুডিসিয়াল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদের একজন কর্মকর্তা (জেলা জজ), তিনি এই বিধান জানেন না! এটি অবিশ্বাস্য! এই প্রশ্নটি কেউ করলোনা। কেউ একটিবারের জন্য জিজ্ঞেস করলোনা – উনার লিখিত রায়ে কী আছে। সবার জ্ঞাতার্থে বলি – রায় লিখিতই হতে হয়। মৌখিক রায় বলে কোনো রায় নেই। মৌখিক ঘোষণা হতে পারে রায়ের। তারপর সেই রায়ের নকল তুলে সেই রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। রায়ে অসন্তুষ্ট হলে উচ্চাদালতে আপিল হবে। আপিলে সেই রায় টিকবে কি টিকবেনা তা আপিল আদালত ঠিক করবেন। কিন্তু কিছু সাংবাদিক মনে হচ্ছে কোর্ট রুমে বসেই রিপোর্ট লিখে ফেললেন। কোর্ট নিয়ে খবর করা আর ফিকশন লেখা এক নয়। এখানে অনেক সাবধনতার সাথে কাজটি করতে হয়। আমরা অতীতে দেখেছি কোর্টবিট এমন একজন সিনিয়র সাংবাদিক করতেন যিনি এই দেশের লিগ্যাল সিস্টেম সম্পর্কে ভালো জানেন এবং প্রতিটি তথ্য ক্রস-ম্যাচ করার সক্ষমতা রাখেন। বিখ্যাত সাংবাদিক মেহেদী হাসানের এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম –তিনি সেখানে সাংবাদিকের আসলে কাজ কি, তা নিয়ে বলছেন – ‘ক’ বললো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ‘খ’ উল্টা বললো,- না বাইরে বৃষ্টি হচ্ছেনা। সাংবাদিকের কাজ এটি নয় যে ‘ক’ কি বলেছে আর ‘খ’ কি বা বলেছে তা লেখা, সাংবাদিকের কাজ দরজা খুলে বাইরে বের হওয়া এবং দেখা আসলেই বৃষ্টি হচ্ছে কিনা।

বর্তমানে অনলাইন সাংবাদিকতার যুগে একজন নিউজ রেডি করলে সবাইকে তা বিলিয়ে দেন, ভালো কথা, সময় বাঁচে। কিন্তু তথ্য যাচাই করতে কী সমস্যা? কেউ কি একটি বারও প্রশ্ন করেছে যে মূল রায় বের হবার আগে আপনি যেই রায় নিয়ে লিখছেন তা ‘প্রিম্যাচিউর’ হয়ে যাচ্ছে। অথবা বিচারকের কোনো কথা আপনি ‘কনসিভ’ না করতে পারলে আপনার সিনিয়র কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতেন। কেউ বলেনি। কারণ আমরা সবাই টিআরপি আর ক্লিক-বেইট এর যুগে কে কত আগে ভাইরাল হবো তার নেশায় মেতে আছি। আমাদের অবস্থা এমন –

‘কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,

আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে’।

দুই

যেসকল ডাক্তার ধর্ষণের মামলার মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেন সবাই এই বিষয়ে একমত যে – ৭২ ঘন্টা পরে ভিকটিমের মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া খুবই দুরূহ। বিশেষ করে যখন ভিকটিম বিবাহিত, নরমাল ডেলিভারিতে সন্তান জম্ম দিয়েছেন, বা যৌনকার্যে নিয়মিত। এই ক্ষেত্রে শরীরের অন্যান্য জায়গায় আঘতের চিহ্ন থাকলে – পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে ধর্ষণের অনুমান করা সহজ হয় বিচারকের জন্য। রেইনট্রি কাণ্ডে মামলা হয়েছে মাস খানেক পরে! ততদিনে ডাক্তার সাহেবদের জন্য ভিকটিমের শরীরে পরীক্ষা করে বের আনার মত আর কোন আঘাতের চিহ্ন নাই। ফলে ডাক্তার তার সনদে ধর্ষণের বিষয়ে নেতিবাচক মতামত দিয়েছেন। অর্থাৎ ধর্ষণ হয়নি। এতে সুবিধা কে পেল? অবশই আসামী। বিচারক এই দিকটিই আলোচনা করেছেন- তিনি বলছেন, যেহেতু এতো চাঞ্চল্যকর অপরাধ – ৭২ ঘন্টার মধ্যে মামলাটি করতে পারলে এবং টেস্ট করতে পারলে ভিকটিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যেত, এতে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণে রাষ্ট্র সুবিধাজনক স্থানে থাকতেন। প্রকৃত ভিকটিমকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে একজন বিচারকের এই পর্যবেক্ষণ কীভাবে অসাংবিধানিক? মামলা প্রমাণের দায়িত্ব তো বিচারকের নয়। এটি প্রসিকিউশনের। যেই প্রসিকিউশন মামলা প্রমানে ব্যর্থ হলো সেই প্রসিকিউশন নিয়ে সবাই চুপটি মেরে বসে ছিল। প্রসিকিউশন যদি উপযুক্ত সাক্ষী না আনেন, মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা যদি তদন্তে হেরফের করেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের যদি সুরক্ষা না দেয়া হয়, বা সাক্ষীরা যদি বয়ান পাল্টান বা বিক্রি হয়ে যান – তখন বিচারকের আর কি করার থাকে? তিনি কি দেখে রায় দিবেন! বিচারকতো কোনো পক্ষ নন। তিনি কারো ফাঁসি বা কারো খালাস চাইতে পারেন না। তার দাঁড়িপাল্লা সমান থাকে দুই পক্ষের জনই। তার কাছে যেই সমস্ত সাক্ষ্য- প্রমাণ থাকবে বিধি মোতাবেক সেসবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে তিনি রায় দিবেন। এটিই তার কাজ। উক্ত বিচারকের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ যেভাবে বিচারকের তথাকথিত ‘পর্যবেক্ষণ’ নিয়ে সোচ্চার ছিলেন ঠিক একই ভাবে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থ প্রসিকিউশন নিয়ে, সাক্ষী সুরক্ষা বা তদন্তকারী কর্মকর্তার গাফিলতি নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের যে অধিকার তা যদি কারো গাফেলতির কারণে খর্ব হয় তাহলে সেই কাজও অসাংবিধানিক নয় কি? রাষ্ট্রের প্রসিকিউসন পক্ষ যদি বাদীনিকে সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে ব্যর্থ হন তাহলে আঙ্গুল সেদিকেও তোলা উচিত। কারণ ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণের মূল দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রপক্ষের; বিচারকের নয়।

তিন

একটি দেশের গণতন্ত্র কেমন আছে তা মাপার মাপকাঠি হচ্ছে ওই দেশের বিচারবিভাগ কতটা স্বাধীন এবং অবাধভাবে কাজ করতে পারে। বিচারকের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে – আপিল হবে। কিন্তু তা না করে – রাস্তায় নেমে লাথি, জুতা কিল দিয়ে ‘পাজি চিলের’ ভূত ছাড়তে মাঠে নেমে গেলেন প্রতিক্রিয়াশীলরা। এই আন্দোলনকারীদের কজন পরবর্তী আইনি লড়াইয়ে ভিকটিম- বাদীনিকে আইনি সহায়তা দিতে রাজি? ক’জন সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে রাস্তায় নামবেন, ক’জন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদারকি করতে রাজি হবেন – তা সময়েই দেখতে পাবেন। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে এই বাঙ্গালীর বিষ খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। এতেই বরং আসল ক্ষতিটা হয়।

এই মিটিং-ফিটিং করে কান কিন্তু মেলেনি। ঐদিন সাংবাদিকদের দেয়া বয়ান কিন্তু পাল্টে ফেলেছেন বক্তব্য দেয়া আইনজীবী। আরোও মনে রাখতে হবে তিনি ছিলেন বাদী-ভিক্টিমদের আইনজীবী। স্বভাবতই রায়ে তিনি অসন্তুষ্ট, আর তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তাও অনুমেয়। আইনজীবীর কথা ‘চেরী-পিক’ করে বিচারকের নাম চালিয়ে দেয়া হলো। কানটা জায়গামতো আছে কিনা তা দেখার জন্য কেউ এগিয়ে আসলো না। এর মধ্যে বিচারক তার বিচারিক ক্ষমতা হারালেন। সামাজিক ভাবে হেয় হলেন। পেলেন না তার সতীর্থদের পাশে। সুযোগ নেই করার কোনো সংবাদ সম্মেলন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল। বিচারক কী নিজেই পেলেন ন্যায়বিচার? দুই একজন পেশাদার সাংবাদিক – বলতে শুরু করলেন – ‘কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?’ যেই কান নেবার জন্য বিচারক নামক সোনার চিলের জান নেবার জন্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছিলো। তারা তার জান না নিতে পারলেও অপেক্ষাকৃত অবলা, দুর্বল, প্রতিক্রিয়াহীন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক ঘাই মেরে বাহবা নিয়ে মাঠ ছাড়লেন। কিন্তু এ কী! যারা কানের ক্লাইমেক্স শেষ ভেবে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন তাদের ঘুম ভেঙেছে রায় বের হবার পর- ঠিক এভাবে –

‘নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;

কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।

ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম ?

বৃথাই মাথার ঘাম ফেলছি, পন্ড হল শ্রম’।

লেখক: গবেষক; সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।