‘টাকা হলে সবকিছু সম্ভব’ এ ধারণাকে চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য সকলের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পাশপাশি দুর্নীতিবাজদের বয়কট করার আগের সংস্কৃতিতে ফিরে যেতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আজ বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত দুর্নীতি বিরোধী দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এ আহ্বান জানান। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘আপনার অধিকার, আপনার দায়িত্ব: দুর্নীতিকে না বলুন’। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ সভা আয়োজন করে। দিবসটি সরকারিভাবে পলিত হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা শৈশবে দেখেছি দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হতো। তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনে সঙ্কোচ বোধ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তাদের উৎসাহিত করা হয়। দুর্নীতিবাজদের তোষণ করা হয়। আমাদেরকে পূর্বের কালচারে (সংস্কৃতিতে) ফিরে যেতে হবে।
নবীন প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, পিতা-মাতার কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চান, তাদের বেতন ভাতা কত, মাসিক আয় কত, ব্যয় কত। সংসার কীভাবে চলে, কীভাবে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বয়কট করতে হবে।
তিনি বলেন, আমার সবেচেয়ে কষ্ট হয় যখন দেখি দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে কিছু কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়। দেশের বিদ্বান ব্যক্তিগণ লোভী হলে, ঐশ্বর্যের পিছনে ছুটলে, অসাধু হলে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করা কোনদিন সম্ভব হবে না।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, টাকা হলে সবকিছু সম্ভব এ ধারনাকে চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য আমাদের সকলের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, তদন্ত হচ্ছে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রাণ। তদন্তকারী কর্মকর্তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিরন্তর প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। তদন্তকারী কর্মকর্তার মনে রাখতে হবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে না পড়ে। অন্যদিকে অপরাধী যেই হোক না কেন, তার পদমর্যাদা কোনভাবেই দুর্নীতির দায় থেকে পরিত্রাণের মাপকাঠি হবে না। একজন দুর্নীতিবাজও যেন এ দায় থেকে মুক্তি না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রসিকিউশন টিমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। দুর্নীতি মামলার বিচারকাজে নিয়োজিত বিচারকদের বিচার প্রশাসন ইনিস্টিটিউট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের যৌথ উদ্যোগে গৃহীত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির পূর্ণ বাস্তবায়নে কমিশনকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। কমিশনের হাতকে শক্তিশালী করতে সুশীল সমাজ এগিয়ে আসবে এ আমাদের দৃঢ় প্রত্যাশা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, শিক্ষাঙ্গন তথা মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দুর্নীতির কুফল তথা নেতিবাচক দিকগুলো উপস্থাপন করে বিভিন্ন কর্মশালা সেমিনার সিম্পজিয়াম আয়োজনে কমিশনকে অনুঘটকের ভূমিকা পাওন করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তরিকতাও একান্ত অপরিহার্য। দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের একটি স্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে শিক্ষকদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলেও, দুর্নীতিবাজেরা দেশত্যাগের চেষ্টা করে এবং অনেক সময় সফল হয়। বিষয়টি প্রতিরোধে যথাযথ আইনি কাঠামো না থাকায় কমিশনের পক্ষে তাৎক্ষনিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়না।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, সম্প্রতি আপিল বিভাগ একটি রায়ে দুর্নীতিবাজদের বিদেশ গমন বন্ধে কমিশনকে কিছু দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ওই রায়ের আলোকে কমিশন স্ব উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তিন কার্যদিবস বিদেশ যেতে বাধা প্রদান করতে পারবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আদালতের অনুমতি নিয়ে ওই ব্যক্তির বিদেশ গমনে বাধা প্রদানের সময়সীমা বর্ধিত করতে পারবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যুগান্তকারী এ রায় দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশনের আরও বিস্তৃত করবে। একইসঙ্গে এর অপব্যবহার যেন না হয় সে ব্যাপারে কমিশনকে খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনের গৃহীত কর্মসূচী সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। দুর্নীতির কারণগুলো কমবেশি আমাদের সকলের জানা এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আউট অব গ্রীড (লোভ থেকে)। দুর্নীতির এসব কারণ সমূলে উৎপাটন করতে সমন্বিত কার্যক্রম অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, আসুন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হতাশার অন্ধকার ঠেলে উজ্জ্বল আলোয় স্বদেশকে এগিয়ে নিতে অঙ্গিকার বদ্ধ হই। দুর্নীতিকে না বলার অঙ্গীকার নিয়ে সর্বাত্মক নৈতিক চর্চার সামাজিক আন্দলন গড়ে তুলি। দুর্নীতি দমনে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম ও তারুন্যের অঙ্গীকার। তরুণ ও যুব সমাজকে দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের যুব সমাজ অসততা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলেই কেউ আর অনিয়ম ও দুর্নীতি করার সুযোগ পাবে না।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, সৎ, নির্লোভ, কর্তব্যপরায়ণ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণ এবং প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হবে মর্মে আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি।
এ লক্ষ্যে তিনি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গকে এগিয়ে আসার উদ্বাত আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, সমস্বরে বজ্রকন্ঠে দুর্নীতিকে বলি না, না, না। দুর্নীতিবাজদের প্রতি হৃদয়ের গহীন থেকে ঘৃণা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন প্রধান বিচারপতি।
দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বক্তব্য রাখেন। এ সময় দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান, কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক এবং প্রতিষ্ঠানটির সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।