অ্যাডভোকেট রীনা পারভীন মিমি
অ্যাডভোকেট রীনা পারভীন মিমি

ডেভেলপারকে জমি দেওয়ার আগে ভূমি মালিকের যে বিষয়গুলো জানা জরুরি

রীনা পারভীন মিমি: অনেকেরই শহরে জমি আছে কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় তাতে স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। কারো আবার সামর্থ্য থাকলেও ব্যস্ততা, অনভিজ্ঞতা, অনাহূত ঝামেলা, শারীরিক অক্ষমতা কিংবা বিদেশে অবস্থানের কারণে স্বউদ্যোগে বাড়ি নির্মাণ করতে পারছেন না।  আর এ সমস্যা সমাধানে ডেভেলপারদের সহায়তা খোঁজ করেন। কারণ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার একদিকে যেমন প্রকল্পের অর্থায়নে সহায়তা করেন অন্যদিকে ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, তথ্য এবং দক্ষতাও রাখেন। রিয়েল এস্টেট খাত দেশে আবাসিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করছে, এ কথা অনস্বীকার্য। তবে কতিপয় ডেভলপার কোম্পানি সময়মত ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণে ভুক্তভোগীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এছাড়াও ডেভলপার কোম্পানির নানামুখী প্রতারণার শিকার জমির মালিক ও ফ্ল্যাট ক্রেতাকে বর্ণনাতীত দুর্গতি পোহাতে হয়েছে। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে নিজেরা বাড়ি করতে না পারায় আবাসন কোম্পানিকে জমি দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে গিয়ে পড়ছেন মহা দুশ্চিন্তায়। অনেক জমির মালিক ডেভেলপারকে জমি দিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে থাকতে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। ফলে বাড়ির স্বপ্ন অনেকের জীবনে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। চুক্তির পর আবাসন কোম্পানি দীর্ঘদিন জমি আটকে রাখায় জমির মালিকেরা দুঃসহ ভোগান্তিতে পড়েছেন।  কতিপয় ডেভেলপার কোম্পানি আবার সন্ত্রাসী, পুলিশ আর দালালদের পেছনে অর্থ ব্যয় করে জমির মালিককে বিপাকে ফেলার অভিযোগও উঠে আসে খবরের কাগজে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে একজন ভূমি মালিককে কিছু বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। কারণ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই ডেভেলপার কোম্পানির কাছে জমি হস্তান্তরের আগে জমির মালিককে নিম্নোক্ত বিষয়ে অবগত থাকা জরুরি।

ডেভেলপার কোম্পানি সম্পর্কে জানা

ডেভেলপারের হাতে জমি তুলে দেওয়ার আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে ডেভেলপার কোম্পানিটি নিবন্ধিত কিনা। কারণ ২০১০ সনের রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনের ৫(১) ধারার বিধান অনুযায়ী, কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ব্যবসা করতে চাইলে প্রত্যেক রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট হতে নিবন্ধন গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে নিবন্ধন ছাড়া ডেভেলপার কোম্পানি ব্যবসা করতে পারবে না, এমনকি এই নিবন্ধন পাঁচ বছর পর পর নবায়নযোগ্য। ডেভেলপার কোম্পানিটি রিহ্যাবের সদস্য কিনা তা সম্পর্কে অবগত হতে হবে। আর রিহ্যাবের সদস্য হয়ে থাকলে প্রতিষ্ঠানটি নতুন না পুরোনো, তাদের আগের কোনো কাজের অভিজ্ঞতা আছে কিনা, অতীতে ওই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা কেউ প্রতারিত হয়েছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রশ্ন হতে পারে এসব তথ্য জানবেন কীভাবে? উত্তর হচ্ছে, রিহ্যাব থেকে এসব তথ্য জেনে নেওয়া যায়। ডেভেলপারদের থেকে একজন ভালো রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল তাদের ট্র্যাক রেকর্ড। আগে থেকেই যাচাই বাছাই করে নেওয়া উচিৎ সঠিক সময়ের মধ্যে তারা আপনার প্রকল্প শেষ করে দিতে পারবে কিনা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: রিহ্যাব সম্পর্কে বোধকরি সকলেই জানেন, তবু যারা রিহ্যাব সম্পর্কে অবগত নন। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সংক্ষেপে রিহ্যাব। বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের একমাত্র বাণিজ্যিক সংস্থা। আবাসন খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে, ১৯৯১ সালের ১২ ডিসেম্বর সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ভূমি মালিক ও ডেভেলপারের মধ্যে চুক্তি

জমির মালিক হিসেবে অবশ্যই আপনার উচিত হবে যে চুক্তি ডেভেলপারের সাথে করতে যাচ্ছেন তা ভালোভাবে দেখে নেওয়া। কারণ চুক্তিপত্রে এমন শর্তাবলি লেখা থাকে, যেগুলো সঠিকভাবে দেখে না নিলে পরবর্তীতে নানা ধরণের ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি আইনি সহায়তা গ্রহণের সুযোগও নষ্ট করে হতে পারে। সেজন্য চুক্তিপত্রের প্রতিটি শর্ত ভালো করে দেখে নেওয়া উচিৎ। রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ধারা ১০(১) অনুযায়ী, ভূমির মালিক রিয়েল এস্টেট উন্নয়নের লক্ষ্যে ডেভেলপারের সহিত লিখিত দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি (Joint Venture Agreement) সম্পাদন করবেন। চুক্তিতে কে কত অংশ পাবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে অর্থাৎ রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন বাবদ ডেভেলপারের পাওয়া অংশ ও জমির মালিকের অংশের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। চুক্তিপত্রের উল্লেখ্যযগ্য বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে- ফ্ল্যাটের আয়তন, কমনস্পেস, প্রতি স্কয়ার ফিটের মূল্য, ফ্ল্যাটের দাম পরিশোধ পদ্ধতি, পজেশন বা দখলের সময়সীমা ইত্যাদি। এছাড়াও চুক্তিপত্রে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময়সীমা নির্দিষ্ট থাকে, যথা—কোন বছরের কোন মাসের কোন তারিখের ভেতর ফ্ল্যাটটি হস্তান্তর করা হবে। সেই সাথে চুক্তিপত্রে অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাটটি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি পুরোপুরিভাবে হস্তান্তর না করতে পারেন, তাহলে ক্রেতাকে তিনি কী ক্ষতিপূরণ দেবেন।

আমমোক্তারনামা দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর

রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ধারা  ১০ (২) উপ-ধারা (১) অনুযায়ী চুক্তিতে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন বাবদ ডেভেলপারের প্রাপ্ত অংশের পরিমাণ উল্লেখপূর্বক প্রাপ্ত অংশ ডেভেলপারের মনোনীত ক্রেতা বরাবর দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে ডেভেলপার বরাবর আমমোক্তারনামা দলিল সম্পাদনের শর্ত উল্লেখসহ ভূমি উন্নয়ন বা নির্মাণ কাজ শুরু ও শেষ করার সময় উল্লেখ থাকবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে জমির মালিককে তার জমি অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা (Irrevocable power of attorney) -এর মাধ্যমে সম্পত্তি দিয়ে দিতে হবে। এজন্য আমমোক্তারনামা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা একবার সম্পাদিত হওয়ার পর রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তা আর সহজে জমির মালিক প্রত্যাহার করতে পারে না। ২০১২ সালের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী জমির মালিক এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তবে চুক্তি উপেক্ষা করে অন্যায়ভাবে স্পষ্টত জমির মালিকের অধিকার হরণ করা হলে মহামান্য হাইকোর্টে রিট করে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

ডেভেলপার কর্তৃক রিয়েল এস্টেট হস্তান্তরে ব্যর্থতায় আইনি প্রতিকার

রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ধারা ১৫(১) অনুযায়ী, চুক্তিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডেভেলপার রিয়েল এস্টেট হস্তান্তরে ব্যর্থ হলে রিয়েল এস্টেট এর মূল্য বাবদ পরিশোধিত সমুদয় অর্থ চুক্তিতে নির্ধারিত পরিমাণ ক্ষতিপূরণসহ ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে প্রাপকের হিসাবে প্রদেয় (account payee) চেকের মাধ্যমে ফেরত প্রদান করবে। তবে শর্ত থাকে যে, ক্রেতা ও ডেভেলপারের যৌথ সম্মতিতে রিয়েল এস্টেট হস্তান্তরের সময়সীমা সম্পূরক চুক্তির মাধ্যমে বর্ধিত করা হলে উপ-ধারা (২) এর বিধান অনুযায়ী ক্রেতাকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। একই আইনের ১৫ (২) অনুযায়ী, উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বা হার পক্ষগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে উল্লেখ না থাকলে পরিশোধিত সমুদয় অর্থের উপর ১৫% হারে ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হবে এবং ডেভেলপার অনধিক ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) কিস্তিতে ক্ষতিপূরণের অর্থসহ সমুদয় অর্থ পরিশোধ করবে। আইনের ১৫ (৩) ধারায় বলা আছে, উপ-ধারা (১) ও (২) এ বর্ণিত ক্ষতিপূরণের সময় গণনার ক্ষেত্রে সমুদয় অর্থ পরিশোধের তারিখ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ সময় গণনা করতে হবে।

ডেভেলপার কতৃর্ক প্রতারণামূলক অপরাধের দন্ড

যদি কোন ডেভেলপার কোন ভূমির মালিকের সাথে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে বা ক্রেতা বরাবর রিয়েল এস্টেটের বরাদ্দপত্র সম্পাদন করে তদনুযায়ী কোন কার্যক্রম গ্রহণ না করে বা আংশিক কার্যক্রম গ্রহণ করে বিনা কারণে অবশিষ্ট কাজ অসম্পাদিত অবস্থায় ফেলে রাখে এবং তজ্জন্য ভূমির মালিককে বা, ক্ষেত্রমত, ক্রেতাকে কোনরূপ আর্থিক সুবিধা প্রদান না করে তাহলে এটি প্রতারণামূলক অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য ডেভেলপার অনূর্ধ্ব ২ (দুই) বৎসর কারাদন্ড অথবা অনূর্ধ্ব ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

বিরোধ নিষ্পত্তি

ডেভেলপারের যেকোন প্রতারণামূলক কাজের জন্য সরাসরি থানায় বা আদালতে মামলা করা যায় না। সম্পাদিত চুক্তিতে যেকোন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সালিশের বিধান আছে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইনেও সালিশের বাধ্যতামূলক বিধান আছে। এমনকি রিয়েল এস্টেট আইনেও বাধ্যতামূলক সালিশের বিধান আছে। সুতরাং চুক্তির যেকোন সম্যসা সমাধানের জন্য সালিশের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা ২৭, ২৮, ২৯ এবং ৩০ এ বর্ণিত অপরাধ বা তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির কোন বিধান লঙ্ঘন হলে তবে তাকে প্রথমে নিজেরদের মধ্যে সমঝোতা বা আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে  নিষ্পত্তির চেষ্টা করতে হবে। যদি তাতেও কোন সমাধান না আসে অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে সমাধান না হয় বিষয়টি নিয়ে সালিশ আইন, ২০০১ মোতাবেক সালিশি ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। তখন সালিশি ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে। ইংরেজিতে একে বলা হয় Arbitration Tribunal. কিন্তু এই পদ্ধতিতে প্রতিকার পাওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, এমনকি অনেক ব্যয়বহুল তাই জমি হস্তান্তরের আগে সচেতন থাকতে হবে। আইনানুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষ যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনে ব্যর্থ হয় তাহলে যেকোনো পক্ষ বিবদমান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত আদালতে মামলা করতে পারবে।

পরিশেষে বলতে চাই, অনেক জমির মালিকই এসব আইন বা আইনি প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। অন্যদিকে আইনের জটিল প্রক্রিয়ায় প্রতিকার পাওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করা অনেক ব্যয়বহুল। তাই জমির মালিকদের জমি ডেভেলপারের কাছে হস্তান্তরের আগে উপরোক্ত বিষয়গুলো জানা থাকা জরুরি। একবার যদি ডেভেলপার কোম্পানির জালে আটকে যান তবে সেখান থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন। তাই জমি ডেভেলপারকে দেবার আগে জমি জমা বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। জমির মালিকেদের উচিৎ এই ধরণের সমস্যা নিয়ে এগিয়ে আসা নয়তো দিনে দিনে ডেভেলপার কোম্পানির অপরাধের প্রবণতা বাড়তে থাকবে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও  যুগ্ম সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।

Email: rinaparvinmimi18@gmail.com