নেপালের সংসদে অভিশংসিত হওয়ার প্রস্তাবে আইনপ্রণেতাদের ভোটের পর দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চোলেন্দ্র শমশের রানাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
স্বজনদের রাজনৈতিক পদ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে গত বছর তিনি নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে সরিয়ে দিয়ে পার্লামেন্ট পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে বিচারপতি রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এরপর পার্লামেন্টে অভিশংসন প্রস্তাবে ভোটাভুটির পর গত রোববার (১৩ ফেব্রুয়ারি) তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
২০২০ সাল থেকেই নেপালের রাজনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্তের ঘটনা প্রমাণ করছে, দিন দিন সেই সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এদিকে, নেপালকে ঘিরে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।
প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করার ফলে নেপালের বর্তমান পার্লামেন্টও এখন হুমকির মুখে রয়েছে। জোটের শরিকদের মধ্যে বিরোধের জেরে এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলি এক বছরের মধ্যে দুইবার পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছিলেন।
পরে সুপ্রিম কোর্ট ওই বিরোধে হস্তক্ষেপ করে এবং প্রধান বিচারপতি রানা গত বছর জুলাই মাসে ওলিকে সরিয়ে দিয়ে পার্লামেন্ট পুনর্বহালের নির্দেশ দেন।
তার কয়েক দিনের মধ্যেই নেপালের আইনজীবী সমিতি প্রধান বিচারপতি রানার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তোলে। ওই সমিতিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও আছেন।
নেপালের বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে বলা হয়, রানা কয়েকজন রাজনীতিবিদের কাছ থেকে তার আত্মীয়দের মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ওলিকে সরিয়ে দেওয়া এবং পার্লামেন্ট পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বিভিন্ন মামলার রায়ের বিষয়ে অন্যান্য বিচারপতিদের প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে রানার বিরুদ্ধে। প্রধান বিচারপতি রানা অবশ্য তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত বছর অক্টোবরে রানার আত্মীয় গজেন্দ্র বাহাদুর হামাল নেপালের শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধানের পদে নিয়োগ পান। কিন্তু আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখে মাত্র তিন দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কাঠমাণ্ডুর ওই বিক্ষোভে আইনজীবীরা রানার অভিশংসনের দাবিও করেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা কয়েক সপ্তাহ বেঞ্চ বয়কট করেন। ফলের বেশিরভাগ মামলার বিচার কার্যক্রম থমকে যায়। হয়রানির শিকার হতে হয় বিচারের আশায় থাকা সাধারণ মানুষদের।
সমালোচকরা বলেন, প্রধান বিচারপতি পদে রানার থাকা নিয়ে বিরোধের কারণে দেশটির সাধারণ নাগরিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তারপরও পার্লামেন্টে রোববার প্রধান বিচারপতির পদে রানাকে অভিশংসন করা নিয়ে ভোটাভুটিতে বিস্ময়কর ফল এসেছে। অভিসংশনের পক্ষে পড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট; যেখানে প্রস্তাব পাসের জন্য উপস্থিত আইনপ্রণেতাদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন পড়ে।
রানাকে বরখাস্তের বিষয়ে আইনমন্ত্রী দিলেন্দ্র প্রসাদ বাদু সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে বিচার ব্যবস্থায় যে অচলাবস্থা চলছে তার অবসানে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“ক্ষমতা পৃথকীকরণের অধীনে বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা আমাদের ভূমিকা পালন করেছি।”এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের পক্ষ থেকে রানার সঙ্গে যোগযোগের চেষ্ট করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
রানা বরখাস্ত হওয়ায় তার জায়গা নেবেন সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী সর্বজ্যেষ্ঠ বিচারপতি দীপক কুমার কারকি। আর অভিশংসনের জন্য যে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন সেটার জন্য আবারও পার্লামেন্টে ভোট হবে।
প্রধান বিচারপতির বরখাস্তের ঘটনায় নেপালের সরকার এবং বিরোধীদলের মধ্যে বিরোধ আরো গভীর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নেপালকে ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের যে আর্থিক সহায়তা দিতে চেয়েছিল তা পাওয়া এখন হুমকির মুখে পড়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ওই আর্থিক সহায়তা প্রক্রিয়া আটকে আছে।
অথচ পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশ নেপালের রাস্তাঘাট উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিরবিচ্ছিন্ন করতে দেশজুড়ে বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন প্রকল্পের জন্য ওই সহায়তা খুবই প্রয়োজন।
যদিও নেপালের বিরোধীদল যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং চীন ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে তারা চীনের সহযোগিতা নিতে আগ্রহী। চীনও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে রাজি। যার প্রমাণ, ২০১৯ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নেপাল সফর।
ওই সফরে শি তার উচ্চাভিলষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’র অধিনে নেপালের সড়ক, রেলপথ, আকাশপথ এবং যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন।