শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: সৃজনশীল মানুষ তার মেধা প্রয়োগ করে যা কিছু সৃষ্টিশীল সৃষ্টিকর্ম করেন তাই মেধাসম্পদ (Intellectual Property)। এক কথায়, মানুষের সৃষ্টিশীল চিন্তার ফসল হলো মেধাসম্পদ যা মানুষের বস্তুগত সম্পদ যেমন- বাড়ি, গাড়ি থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। বর্তমানে মেধাসম্পদ পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। মেধাসম্পদ বা সংক্ষেপে I P হলো সৃজনশীল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টি। এই সৃষ্টি সৃষ্টিশীলদের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মেধাসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। উন্নত দেশে জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ মেধা সম্পদের আর্থিক আয় থেকে আসে। মেধাসম্পদকে মূলত ২টি ভাগে ভাগ করা যায়- ১. শিল্পসম্পদ ও ২. কপিরাইট।
শিল্পসম্পদ হলো ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ক সম্পদ। যেমন পেটেন্ট (পণ্যের উৎপাদক পদ্ধতি কৃতিস্বত্ব), ট্রেডমার্ক (বাণিজ্যিক মার্কা), ডিজাইন, জিআই পণ্য (ভৌগোলিক নির্দেশক) ইত্যাদি। অপরদিকে কপিরাইট বিষয়ক মেধাসম্পদের আওতায় রয়েছে সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সংগীতকর্ম, চলচ্চিত্রকর্ম, ফটোগ্রাফিকর্ম, বেতার টেলিভিশন সম্প্রচারকর্ম, কম্পিউটার সফটওয়্যারকর্ম ইত্যাদি।
বাংলাদেশে শিল্পবিষয়ক মেধাসম্পদ এবং কপিরাইটবিষয়ক মেধাসম্পদের কাজের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ এবং রক্ষার জন্য আলাদা আলাদা আইন এবং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সম্পর্কিত কয়েকটি আইন হলো- পেটেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্ট, ১৯১১; ট্রেডমার্কস আইন, ২০০৯; ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩; কপিরাইট আইন, ২০০০ ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মেধাসম্পদ সুরক্ষা ও স্বীকৃতির উদ্দেশ্যে নিবন্ধের এবং ব্যবস্থাপনার কাজটি করে। পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর হলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর। এ দপ্তর মেধাসম্পদের শিল্পবিষয়ক কর্মের পেটেন্ট, ডিজাইন, ট্রেডমার্কস ও জিআই পণ্য সুরক্ষা ও নিবন্ধনের কাজ করে। এই অধিদপ্তরের মূল কাজ হচ্ছে মেধাসম্পদের শিল্পবিষয়ক কর্মের পেটেন্ট, ডিজাইন, স্বত্ব মঞ্জুর করা, পণ্য ও সেবার ট্রেডমার্ক এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন করা।
অপরদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কপিরাইট অফিস মেধাসম্পদের কপিরাইটবিষয়ক কর্মগুলো সুরক্ষা ও নিবন্ধনের কাজটি করে। এ অফিসের কাজের মধ্যে প্রধান ৪টি কাজ হলো- ১. সৃজনশীল কর্মের কপিরাইটবিষয়ক মেধাসম্পদের রেজিস্ট্রেশন প্রদান। ২. আপিল মামলা নিষ্পত্তিতে কপিরাইট বোর্ডকে সহায়তা প্রদান। ৩. পাইরেসি বন্ধকরণে টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা এবং ৪. World Intellectual Property Organigation-এর ফোকাল পয়েন্টের দায়িত্ব পালন করা। এ দপ্তরের কপিরাইটবিষয়ক কর্মগুলো কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) এবং কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬ দ্বারা পরিচালিত হয়।
কপিরাইট মেধাসম্পদের একটি বিস্তৃত প্রত্যয়। পৃথিবীর নানা দেশে মেধাসম্পদের জন্য আইপি কোর্ট রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোর্ট না থাকলেও প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে কপিরাইটের আওতাভুক্ত কর্মগুলো হলো সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সংগীতকর্ম, অডিও ভিডিও কর্ম, চলচ্চিত্র কর্ম, ফটোগ্রাফিকর্ম, ভাস্কর্যকর্ম, সম্প্রচার কর্ম, কম্পিউটার-প্রোগ্রামকর্ম ইত্যাদি। কপিরাইট কর্মগুলোর সঙ্গে সবসময় একাধিক পক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকে। তাদেরকে রিলেটড কর্মের অংশীজন বলা যেতে পারে। কেননা, এই সৃষ্টিকর্মগুলো অধিকাংশ নান্দনিক ও সাংস্কৃতিকবিষয়ক। এই কর্মগুলোর যৌথ বা একক স্রষ্টা বা রচয়িতার অনুমতি ছাড়া কপি করা বা পুনরুৎপাদন করা, অনুবাদ করা, রূপান্তর করা বা অভিযোজন করা যায় না।
উল্লেখ্য, বৃত্তের মধ্যে ইংরেজি সি (©) অক্ষর এবং তার পাশে স্বত্বাধিকারীর নাম এবং সাল লিখে সাধারণত কপিরাইটের কর্মের স্বত্বের চিহ্ন প্রকাশ করা হয়। কপিরাইট সংক্রান্ত কর্মের ব্যপ্তি ব্যাপক। কপিরাইটের কর্ম ও কপিরাইটগত রিলেটেড কর্মের সঙ্গে একাধিক পক্ষ যুক্ত থাকে। যেমন- সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে লেখক, প্রকাশক কিংবা সংগীতের ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার, গায়ক, বাদ্যযন্ত্রীবাদক ইত্যাদি স্রষ্টা বা অংশীজন যুক্ত থাকেন। কপিরাইটবিষয়ক মেধাসম্পদের এই কর্মগুলোর উপর সৃষ্টিকারীর নৈতিক ও আর্থিক অধিকার রয়েছে। কপিরাইটবিষয়ক মেধাসম্পদের কর্মগুলোর মালিকানা বা আর্থিক অধিকার একটি হস্তান্তরযোগ্য বিষয়। কপিরাইটবিষয়ক কর্মগুলোর কপিরাইট নিবন্ধন করা থাকলে ভবিষ্যতে মামলা-মোকদ্দমা এবং মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ সহজেই এড়ানো ও নিষ্পত্তি করা যায়। ফলে মেধাসম্পদের এই কপিরাইটভুক্ত কর্মগুলোর মূল হুমকি পাইরেসি (Piracy) থেকে নিরাপদ থাকা যায়। সৃজনশীল কর্ম যা কপিরাইটের আওতাভুক্ত এই কর্মগুলোর নির্মাতা/রচয়িতার স্বত্বসমূহ সংরক্ষণ কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমেই সম্ভব। এ জন্য কপিরাইটকর্ম ও কপিরাইটের রিলেটেডকর্ম নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। কোনো কর্মের কপিরাইটের মাধ্যমে মেধাসম্পদের কপিরাইটের আওতাভুক্ত কর্মগুলো মেধাস্বত্ব চুরি, বেহাত হওয়া ও পাইরেসি থেকে রক্ষা করা যায়। মেধাসম্পদের এক বিরাট ক্ষেত্র হলো কপিরাইটবিষয়ক কর্ম। এ কারণে মেধাসম্পদের সবচেয়ে আলোচিত প্রত্যয় হলো কপিরাইট। কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন অধিকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই অধিকার অবৈধভাবে ভোগ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রশ্ন হচ্ছে কপিরাইট ধারণাটির উদ্ভব কিভাবে হলো? এ প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে মেধাকর্ম সম্পদের সুরক্ষা ও আইনগত স্বীকৃতির প্রয়োজনেই কপিরাইট ধারণার উদ্ভব একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কপিরাইট সম্পর্কিত প্রাচীন একটি ধারণা ইতিহাসে পাওয়া যায়। জানা যায়, সেন্ট কলম্বা (আনুমানিক ৫২১-৫৯৭ খ্রি.) আদি খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন আইরিশ মঠের ধর্মযাজক। খ্রিস্টধর্মের বাণী প্রচারের বারোজন শিষ্যের একজন। বিখ্যাত যাজক সেন্ট ফিনিয়নের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। সেন্ট কলম্বা একদিন তাঁর শিক্ষক ফিনিয়নের নিকট থেকে দুষ্প্রাপ্য একটি পাণ্ডুলিপি ধার নেন। কিন্তু এই পাণ্ডুলিপি তিনি গোপনে দিনরাত পরিশ্রম করে একটি কপি করেছিলেন। সেন্ট ফিনিয়ন ঘটনাটি জানতে পারলেন। তিনি কপি করা পাণ্ডুলিপি ফেরত দেওয়ার জন্য শিষ্যকে বললেন। শিষ্য তা ফেরত দিতে অস্বীকার করল। বিষয়টি তখন আইরিশ প্রধান রাজার দরবারে গেল। আইরিশ রাজা এক যুগান্তকারী রায় ও আদেশ প্রদান করেছিলেন। রাজা আদেশে উল্লেখ করেছিলেন- ‘To every cow belongs its calf, to every book its copy’, অর্থাৎ বাছুরের মালিক যেমন গাভী তেমনি অনুলিপির মালিক ও এর রচয়িতা। এ ঘটনাটি ইতিহাসে Battle of the Book নামে পরিচিত এবং কপিরাইট দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণা। এর পূর্বে কপিরাইট সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
সুতরাং সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টকর্মের আইনগত স্বীকৃতি এবং সুরক্ষার নিমিত্তে কপিরাইটের উদ্ভব। কপিরাইট দ্বারা মেধাকর্মের ওপর প্রণেতার আর্থিক ও নৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন প্রণেতার সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন থাকলে ঐ প্রণেতা জীবদ্দশা এবং তাঁর মৃত্যুর পর সেই প্রণেতার বৈধ উত্তরাধিকারগণ দেশভেদে পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছর পর্যন্ত সৃষ্টিকর্মের আর্থিক অধিকার পেয়ে থাকেন। এছাড়া আর্থিক মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও সৃষ্টিকর্মের উপর নৈতিক অধিকার সময়ই থাকে এবং সৃষ্টিকর্মটি কেউ নষ্ট করতে পারে না। সুতরাং কপিরাইটের দুটি দিক একটি অর্থনৈতিক ও নৈতিক। যে ব্যক্তি পরিশ্রম করে সৃষ্টিকর্ম সৃষ্টি করেছেন কপিরাইট সৃষ্টকর্মকে নিরাপত্তা, স্বীকৃতি প্রদান করে।
মোটকথা, সৃষ্টিকর্মের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের বিষয়ে কপিরাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কপিরাইট একটি সার্বজনীন আইন। কপিরাইট একটি হস্তান্তরযোগ্য বিষয় এবং এর রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়। আন্তর্জাতিক আইনেও কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্মের মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ এড়ানোর জন্য কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন করা প্রয়োজন। কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সনদ সৃষ্টিকর্মের মালিকানার প্রামাণিক হিসেবে আদালতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
দেশ ভেদে কপিরাইট আইন সামান্য তারতম্য থাকলেও মূল প্রতিপাদ্য একই। মূলত মেধাস্বত্ব রক্ষার জন্য বিশ্বে কপিরাইট আইন প্রবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন ব্রিটিশ কপিরাইট আইন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। পৃথিবীতে কাগজ ও ছাপাখানা আবিষ্কারের পরপরই এ আইনের উদ্ভব হয়। ইউরোপে প্রথম এ আইন হয়। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ১৭০৯ সালে সর্বপ্রথম কপিরাইট আইন পাশ হয়। এটা প্রথম গল্প-কবিতা গ্রন্থের স্বত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। এরপর ১৭৭৫ সালে ইংল্যান্ডে আরও একটি আইন পাস হয়। এতে নাটক-সংগীত ইত্যাদি কর্মের স্বত্বের ক্ষেত্রে উক্ত আইন প্রযোজ্য ছিল। তারপর আসে ১৮৪২ সালের কপিরাইট আইন। এরপর আসে ১৯১১ সালের কপিরাইট আইন।
উল্লেখ্য, কপিরাইট আন্দোলন বেগবান করেন ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো (১৮০২-১৮৮৫)। তাঁর দীর্ঘ দিনের উদ্যোগ বিকশিত হয়েছিল ১৮৮৬ সালে সুইজারল্যান্ডের বানে কনভেশনে যা কপিরাইট আইনের ক্ষেত্রে মাউলফলক। মূলত এই চুক্তি হয়েছিল কয়েকটি দেশের লেখকদের গ্রন্থ রচনার স্বত্ব বিষয়ক।
পাক ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ডের ১৯১১ সালের কপিরাইট আইনের মতো `The Indian Copyright Act, 1914′ (১৯১৪ সালের ৩নং আইন) জারি করে। এই আইন দিয়ে অনেক বছর উপমহাদেশে কপিরাইট বিষয়ক কাজ সাধন হয়। পাকিস্তান আমলে সরকার ১৯১৪ সালের কপিরাইট আইন রদ করে The copyright Ordinance, 1962 (১৯৬২ সালের ৩৪ নং আইন) জারি করে। এই আইনটি ১৬ অধ্যায়ে বিভক্ত ছিল, এর ধারার সংখ্যা ৮৪।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৬২ সালের কপিরাইট অর্ডিন্যান্সকে গ্রহণ করে। তবে ১৯৬২ সালের কপিরাইট অর্ডিন্যান্সকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালের কপিরাইট অ্যাক্ট (১৯৭৪ সালের ৪৪নং আইন) এবং ১৯৭৮ সালের কপিরাইট অর্ডিন্যান্স (১৯৭৮ সালের ২০নং অর্ডিন্যান্স) দ্বারা কিছু সংশোধন করা হয়।
পাকিস্তান আমলের ১৯৬২ সালের কপিরাইট অর্ডিন্যান্স বাংলাদেশে অনেক বছর ধরে বলবৎ ছিল। সারা বিশ্বে আধুনিক প্রযুক্তি উন্নয়নের সাথে সাথে কপিরাইট আইনেরও যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। এ কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান আমলের কপিরাইট আইনটি যুগোপযোগী করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই অনুবৃত্তিক্রমে আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০০ সালের ২৮নং আইন) প্রণয়ন করে জারি করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০৫ সালের কপিরাইট আইন (২০০৫ সালের ১৪নং আইন) দ্বারা উক্ত আইনের কিছু সংশোধন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বলবৎকৃত কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) এই আইন একটি বড় পরিসরের আইন। বর্তমান এই আইনটি ১৭টি অধ্যায় ও ১০৫টি ধারাসহ বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারার বিধানমতে কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করে জারি করা হয়। একটি আইন জারি হওয়ার পর উক্ত আইন গাইড করার জন্য বিধিমালা খুবই প্রয়োজন। ২০০৬ সালে প্রণীত কপিরাইট বিধিমালা বিধিমালাটি ৩৫টি, ২টি তফসিলসহ বিভিন্ন উপবিধি বিভক্ত। কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) এবং কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে পাঠ করার জন্য কপিরাইট আইনের ১০৪ ধারা বিধানমতে অনূদিত ইংরেজি পাঠ ২০১০ সালে প্রণয়ন করে জারি করা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেধাসম্পদ সুরক্ষার জন্য কপিরাইট আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে কপিরাইট আইনও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপাটি অর্গানাইজেশনের সদস্য (WIPO)। এ সংস্থাটির সাধারণ নিয়মকানুনও বাংলাদেশের কপিরাইট আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এছাড়া ১৮৮৩ সালে অনুষ্ঠিত প্র্যারিস কনভেনশন এবং ১৮৮৬ সালে বার্ন কনভেনশন (Bern Convention) মাধ্যমে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপাটি রাইটকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপ চুক্তিতে (Agreement on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights) এই কনভেনশনকে যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ এই কনভেনশনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ UNESCO পরিচালিত Universal Copyright Convention (UCC) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO)-এর সদস্য হওয়ার কারণে এতদ্সংক্রান্ত কপিরাইটের সকল শর্ত মেনে চলতে বাধ্য। সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ২৭নং অনুচ্ছেদে মানুষের মেধা সম্পদ সুরক্ষার কথা উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ কপিরাইট বিষয়ক এসব চুক্তি মান্য করে চলছে। সুতরাং বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থা-সংগঠন চুক্তিতে কপিরাইট সংক্রান্ত শর্ত পালনে বিধান রাখা হয়েছে, না মানলে কিছু সমস্যা আছে এবং এসব শর্ত তদারককারী সংস্থাও রয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কপিরাইটের এসব শর্ত পালনে আইনে কার্যকর আছে। মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে লালন করার জন্য কপিরাইট আইনের প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে বলবৎ কৃত কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) কার্যকর আছে। এই আইনের বিভিন্ন বিধানের মধ্যে কপিরাইট এবং এ সম্পর্কিত অধিকার, ট্রিপ চুক্তির বিভিন্ন বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাও সংগঠনের শর্তাবলি রয়েছে। বাংলাদেশের ২০০০ সালে প্রণীত কপিরাইট আইন (যা ২০০৫ সালে সংশোধিত হয়েছে) একটি আন্তর্জাতিকমানের আইন। নিম্নে কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত)-এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো আলোচনা করা হলো।
কপিরাইট আইনের প্রথম অধ্যায়ে ৮টি ধারা রয়েছে। এ আইনের ২ ধারায় ৪৮টি বিধির অভিব্যক্তির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই সংজ্ঞাগুলোর অর্থ হলো এ আইনের সাথে প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়িত অভিব্যক্তিগুলোকে গ্রহণ করা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। যেমন-এ আইনের ২ ধারার ১১বিধি অনুযায়ী ‘কর্ম’ অর্থ নিম্নলিখিত যে কোনো কর্ম। যথা- (ক) সাহিত্য, নাট্য, সংগীত বা শিল্পকর্ম; (খ) চলচ্চিত্র; (গ) শব্দ রেকর্ডিং (ঘ) সম্প্রচার; (ঙ) কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
এ আইনের ২ ধারার ২৪ বিধি অনুযায়ী ‘প্রণেতা’ অর্থ নিম্নলিখিত হবে। যথা- (ক) সাহিত্য বা নাট্যকর্মের ক্ষেত্রে, কর্মটির গ্রন্থকার; (খ) সংগীতবিষয়ক কর্মের ক্ষেত্রে, উহার সুরকার বা রচয়িতা, (গ) ফটোগ্রাফ ব্যাতীত অন্য কোনো শিল্পসুলভ কর্মের ক্ষেত্রে, উহার নির্মাতা; (ঘ) ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে, উহার চিত্রগ্রাহক; (ঙ) চলচ্চিত্র অথবা শব্দ রেকর্ডিং-এর ক্ষেত্রে, উহার প্রযোজক; (চ) কম্পিউটার মাধ্যমে সৃষ্ট সাহিত্য, নাট্য বা শিল্প সুলভ কর্মের ক্ষেত্রে, কর্মটির সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।
আলোচ্য আইনের ৩ ধারায় প্রকাশনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কপিরাইটের ক্ষেত্রে প্রকাশনা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। এ ধারায় প্রকাশনা বলতে কর্মের অনুলিপি জনসাধারণের নিকট বিতরণ করাকে বুঝানো হয়েছে।
এ আইনের ৬ ধারায় কতিপয় বিরোধ বিষয়ের ক্ষেত্রে বোর্ডের সিদ্ধাতই চূড়ান্ত বলে নিষ্পত্তি হবে তা বলা হয়েছে। যেমন কোনো কর্মের প্রকাশনা তারিখ সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে বোর্ড কর্তৃক মীমাংসাযোগ্য হবে।
আলোচ্য আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৯ থেকে ১২ ধারায় কপিরাইট অফিস, রেজিস্ট্রার অব কপিরাইট এবং কপিরাইট বোর্ড সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইট অফিস একটি দেওয়ানি আদালতের সমমর্যাদা সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তাই এ প্রতিষ্ঠানকে আধাবিচারিক (Quasi Judicial) প্রতিষ্ঠান বলা হয়।
কপিরাইট রেজিস্ট্রারকে দেওয়ানি ক্ষমতা (যেমন সমন দেওয়া ক্ষমতা) প্রদান করা হয়েছে। তিনি কপিরাইট অফিসের মুখ্য নির্বাহী।
এ আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১১ ধারা এবং কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬-এর অষ্টম অধ্যায়ের ২৯ বিধিতে কপিরাইট সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নিষ্পত্তির জন্য বোর্ড গঠনের কথা বর্ণিত হয়েছে।
আইনের ১২ ধারায় বোর্ডের ক্ষমতা ও কর্মপরিধি উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সমগ্র আইনের অন্যান্য ধারাতে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কপিরাইট রেজিস্ট্রার এ বোর্ডের সাচিবিকি দায়িত্ব পালন করেন। কপিরাইট বোর্ড একটি দেওয়ানি এখতিয়ার সম্পূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড। কপিরাইট সম্পর্কিত যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তিকল্পে যে কোনো ধারার ব্যাখ্যা দেবার ক্ষমতা কপিরাইট বোর্ডের এখতিয়ারভুক্ত। বোর্ড ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এবং দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর বিধানুযায়ী একটি আদালত বলে গণ্য করা হয়।
এ আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ১৩ থেকে ১৬ ধারায় কোন কোন কর্মের ক্ষেত্রে কপিরাইট রয়েছে, কোন কোন কর্মের ক্ষেত্রে কপিরাইট থাকে না ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইটের অধিকার মূলত একটি সংবিধিবদ্ধ অধিকার। ইহা কপিরাইট আইনের মাধ্যমেই সম্ভব। এ আইনের আওতায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কর্মের উভয়ক্ষেত্রেই কপিরাইট অধিকার পাওয়া যায়। এ আইনের বাইরে অন্যকোনো আইন কপিরাইটের অধিকার পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য, কোনো কর্ম ১৯১১ সালের পেটেন্টস অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্ট অনুযায়ী কপিরাইট নিবন্ধন করা হলে তা আবার আলোচ্য কপিরাইট আইনে করা যায় না। অর্থাৎ একই কর্ম কপিরাইট আইন এবং প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক আইনের অধীনে নিবন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে কর্মের ধরণ-ধারণ অনুযায়ী কপিরাইট নিবন্ধন করা প্রয়োজন।
আলোচ্য কপিরাইট আইনের চতুর্থ অধ্যায়ের ১৭ থেকে ২৩ ধারায় কপিরাইটের স্বত্ব ও মালিকদের অধিকার প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আইনের ১৭ ধারায় প্রণেতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রণেতাই হলো কর্মের কপিরাইটের প্রথম অধিকারী। প্রণেতাকে তা আইনের ২(২৪) ধারায় ব্যাখ্যাত হয়েছে। যিনি কর্মের স্রষ্টা বা প্রণেতা তিনিই মালিক বা স্বত্বাধিকারী। প্রণেতা বা স্বত্বাধিকারী সঙ্গে প্রকাশক বা অন্যরূপ ব্যবহারকারী লিখিত দলিলে স্বাক্ষরের বিধান ১৯ ধারাতে রয়েছে।
এ আইনের ১৯ ধারার ১ থেকে ৭ উপধারায় লিখিত দলিল বা চুক্তিপত্র সম্পাদন করার নিয়ম ও শর্তাবলি বর্ণিত হয়েছে। স্বত্ব হস্তান্তর বা নিয়োগের জন্য চুক্তি হওয়া বাধ্যতামূলক। এ আইনে তফসিল বা আইনের মূলে বিধিতে এই চুক্তিপত্রের কোনো নমুনা দেওয়া নেই। সে জন্য চুক্তি সম্পাদনকারীরা নিজ নিজ কাঠামো বা শর্তে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। চুক্তি সম্পাদনা করা না গেলে প্রণেতার স্বার্থ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ আইনের ১৯ ধারার বিধান প্রতিপালন করা গেলে প্রণেতার লাভ হয়। উল্লেখ্য, প্রণেতা নিজেই কর্মটি প্রকাশ করলে চুক্তির প্রয়োজন নেই। তবে কপিরাইট আইনানুযায়ী কোনো প্রকার মৌখিক অনুমতি গ্রহণ যোগ্য নয়।
আইনের ২১ ধারায় কপিরাইট বিষয়ক কর্মের স্বত্ব আইনানুযায়ী উইলমূলে হস্তান্তরের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনানুযায়ী উইলমূলে প্রাপ্ত ব্যক্তি কর্মের কপিরাইট স্বত্বের মালিক হবে।
এ আইনের ২২ ধারায় বিধানানুযায়ী স্বত্বাধিকারী তার কর্মের কপিরাইট অধিকার ত্যাগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রণেতাকে আইনের বিধিমালার নির্ধারিত ফরমে রেজিস্ট্রারের নিকট নোটিশ প্রদান করতে হবে।
আলোচ্য আইনের পঞ্চম অধ্যায়ের ২৪ থেকে ৩২ ধারায় কপিরাইটের মেয়াদ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইট আইনানুযায়ী নানা রকম সৃষ্টিকর্মের নানা রকম মেয়াদ রয়েছে। প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম নাট্যকর্ম, সংগীতকর্ম ও শিল্পকর্মের (ফটোগ্রাফ ব্যতীত) মেয়াদ প্রণেতা বা রচয়িতার জীবনকাল এবং মৃত্যুর পরের বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট মালিকানা থাকে।
কোনো কর্মের একাধিক প্রণেতা থাকলে সর্বশেষ প্রণেতার মৃত্যুর তারিখের পরের বছরের শুরু থেকে এই হিসাব করা হয়। আইনের ধারাটি শুধু প্রণেতার জীবদ্দশায় প্রকাশিত সাহিত্য-নাটক-সংগীত-শিল্পকর্মের (ফটোগ্রাফ ব্যতীত) কপিরাইটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এ আইনের ২৫ ধারায় মরণোত্তর কর্মে কপিরাইটের মেয়াদ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। প্রণেতা বা রচয়িতার জীবিত কালে কোনো কর্ম প্রকাশিত না হলে প্রকাশের পরের বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট বজায় থাকে।
আইনের ২৬ থেকে ২৮ক ধারানুযায়ী চলচ্চিত্র ফিল্ম, শব্দ রেকর্ডিং, ফটোগ্রাফ, কম্পিউটার সৃষ্ট কর্মগুলোর ক্ষেত্রে কপিরাইট মেয়াদ হবেÑ যে তারিখে এই কর্মগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার পরের বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত।
এ আইনের ২৯ ধারায় বেনামী এবং ছদ্মনাম বিশিষ্ট কর্মের কপিরাইটের মেয়াদ বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। বেনামী বা ছদ্মনামে প্রকাশিত সাহিত্য নাটক-সংগীত বা শিল্পকর্মের (ফটোগ্রাফ ব্যতীত) ক্ষেত্রে প্রকাশনার তারিখের পরবর্তী বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকে। তবে উক্ত সময়ের মধ্যে প্রণেতার নাম পরিচয় জানা গেলে তার মৃত্যুর তারিখের পরবর্তী বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট বিদ্যমান থাকে।
একাধিক নাম পরিচয় ছদ্মনামধারী প্রণেতার মধ্যে সর্বশেষ নাম পরিচয় ছদ্মনামধারী প্রণেতার মৃত্যুর তারিখের পরবর্তী বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট হিসাব করা হয়।
এ আইনের ৩০ থেকে ৩২ ধারায় পর্যন্ত সরকারি কর্মে কপিরাইট মেয়াদ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মের কপিরাইট মেয়াদ, আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মের কপিরাইট মেয়াদের বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। যে সমস্ত কর্মের কপিরাইটের প্রথম মালিক বা স্বত্বাধিকারী সরকার, সে সমস্ত কর্মের কপিরাইটের মেয়াদ প্রকাশনার বছরের পরবর্তী বছরের শুরু হতে ৬০ বছর পর্যন্ত। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মের কপিরাইট মেয়াদ, আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মের কপিরাইট মেয়াদের ক্ষেত্রে এই একই হিসাব প্রযোজ্য।
আলোচ্য আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৩৩ থেকে ৩৭ ধারায় সম্প্রচার সংস্থা এবং সম্প্রাদনকারীর অধিকার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সম্প্রচার সংস্থার বেলায় কপিরাইটের মেয়াদ ২৫ বছর পর্যন্ত।
আইনের সপ্তম অধ্যায়ের ৩৮ থেকে ৪০ ধারায় মুদ্রণশৈলী সংরক্ষণ এবং সংরক্ষণের অধিকার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। উল্লিখিত ধারায় মুদ্রণশৈলী সংরক্ষণ এবং সংরক্ষণের অধিকারটি কর্ম সম্পর্কিত নয়, বরং তার প্রকাশনার মুদ্রণ ও বিন্যাস সম্পর্কিত। এই অধিকারের কপিরাইট মেয়াদ সংস্করণটি প্রথম প্রকাশের বছরের পরবর্তী বছরের শুরু হতে ২৫ বছর পর্যন্ত থাকে।
এ কথা বার বার উচ্চারিত কপিরাইট সম্বন্ধীয় কর্মে একাধিক পক্ষ যুক্ত থাকে। কপিরাইট বিষয়ক প্রকাশিত কর্ম সংস্করণের নেপথ্যে প্রকাশনার কাজে প্রকাশককে শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। এজন্য প্রকাশকেরও কপিরাইটের অধিকার জন্মে। প্রকাশকের এই অধিকার কর্মটি প্রকাশকের তারিখের পরবর্তী বছরের শুরু হতে ২৫ বছর পর্যন্ত থাকে।
বিদ্যমান কপিরাইট আইনের অষ্টম অধ্যায়ের ৪১ থেকে ৪৭ ধারা এবং কপিরাইট বিধিমালার পঞ্চম অধ্যায়ের বিধিানাবলিতে কপিরাইট সমিতি গঠন ও নিবন্ধন এবং পরিচালনা বিষয়াদি বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইট বিষয়ক কর্ম ও কপিরাইটজাত কর্মের প্রণেতাদের এজন্য এ সমিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সমিতি কপিরাইটবিষয়ক বিভিন্ন কর্মের প্রণেতা এবং রিলেটেড পক্ষদের স্বত্ব, দেখাশোনা করে। বিভিন্ন শ্রেণির কর্মের জন্য এক একটি করে সমিতি গঠন করা যায়। একই শ্রেণির কর্মের একের অধিক সমিতি গঠন করা যায় না।
সমিতি নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফরমে রেজিস্ট্রারের নিকট আবেদন করতে হয়। রেজিস্ট্রার উক্ত দরখাস্ত সরকারের নিকট দাখিল করবেন। প্রণেতা এবং এ আইনের অধীনে অন্যান্য অধিকারের মালিকদের স্বার্থ, জনস্বার্থ ও জনগণের সুবিধা, বিশেষত লাইসেন্স প্রার্থী হতে পারে এমন ব্যক্তি সমষ্টির স্বার্থ ও সুবিধা, দরখাস্তকারীর যোগ্যতা এবং পেশাগত দক্ষত বিবেচনা করে সরকার নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে কোন সমিতিকে কপিরাইট সমিতিরূপে নিবন্ধিত করবে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কলেকটিভ ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশনকে (সিএমও) এ আইনের উক্ত ধারায় কপিরাইট সমিতি বলা হয়েছে।
এ আইনের নবম অধ্যায়ের ৪৮ থেকে ৫৪ ধারায় লাইসেন্স বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী তার কপিরাইটের অধিকার বা স্বার্থ অন্যের বরাবরে স্বাক্ষরিত লিখিত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে প্রদান করতে পারে। এই অধিকার বা স্বার্থ প্রদান করাকে লাইসেন্স বলা হয়। উল্লেখ্য, কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন আর লাইসেন্স দুটি ভিন্ন জিনিস। লাইসেন্স একটি অতি প্রয়োজনীয় দলিল। কোনো ভবিষ্যত কর্মের কপিরাইট সম্পর্কিত লাইসেন্সের ক্ষেত্রে, কর্মটি অস্তিত্বশীল হলে কার্যকর হয়। তবে কর্মটি অস্তিত্বশীল পূর্বেই লাইসেন্সধারী মৃত্যুবরণ করলে, সে ক্ষেত্রে তার বৈধ আইনানুগ প্রতিনিধিরা লাইসেন্সের সুবিধাভোগ করে।
আইনের ৪৯ ধারানুযায়ী স্বত্ব নিয়োগের ধরণ এবং স্বত্ব নিয়োগ সংক্রান্ত বিরোধ প্রয়োগ শর্তাবলি লাইসেন্সেভোগীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।
এ আইনের ৫০ ধারায় জনসাধারণের নিকট বারিতকর্মের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। বারিতকর্ম হলো এমন বাংলাদেশি কর্ম যা এখন বাজারে নেই এবং জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য নয়। এ ধরনের বাংলাদেশি কর্ম প্রকাশের জন্য কপিরাইট বোর্ডের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে নিয়মানুযায়ী অনুমতি বা লাইসেন্স নেওয়া যায়।
আইনের ৫১ ধারায় অপ্রকাশিত বাংলাদেশি কর্মের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। এ ধরনের কর্ম প্রকাশের জন্য নিয়মানুযায়ী কপিরাইট বোর্ডের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমতি বা লাইসেন্স নেওয়া যায়।
আলোচ্য আইনের ৫২ ধারায় যে কোনো ভাষায় সাহিত্য বা নাট্যকর্মের অনুবাদ বা অভিযোজন তৈরি ও প্রকাশের জন্য লাইসেন্স প্রদানের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কেউ মেধা খরচ করে কোনো সাহিত্য বা নাট্যকর্মের অনুবাদ বা অভিযোজন তৈরি এবং অর্থ, শ্রম খরচ করে তা প্রকাশ করলেও প্রণেতা বা রচয়িতার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনা বা লাইসেন্স না থাকায় এ কাজ বৈধ হবে না। এ জন্য কপিরাইট আইনের ৫২ ধারার বিধিানমতে কপিরাইট বোর্ডের অনুমোদনক্রমে কপিরাইট অফিস থেকে অনুবাদ কর্মের লাইসেন্স নিতে হয়। মৌখিক অনুমতিতে কোনো কপিরাইট হয় না।
বিদ্যমান আইনের দশম অধ্যায়ের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিশীলকর্মের নিরাপত্তার জন্য কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন। কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন এ আইনানুযায়ী বাধ্যতামূলক না হলেও আলোচ্য আইনের ৬০ ধারার বিধানানুযায়ী সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সনদ প্রমাণপত্র হিসেবে বিজ্ঞা আদালতে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সনদ প্রাপ্ত প্রণেতাকে যে কোনো আদালত রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সৃষ্টিকর্মের মালিক হিসেবে জানবেন। এ রেজিস্ট্রেশন সনদই প্রাইমা ফেসি (Prima facie) বা ঘটনার সত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। মোট কথা, কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সনদ সৃষ্টিকর্মের আইনগত স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের জন্য কপিরাইট বিধিমালার বিধানুযায়ী প্রয়োজনীয় ফি ও দলিলপত্রসহ নির্ধারিত ফরমে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস-এর নিকট আবেদন করতে হয়। উল্লেখ্য, একই বিষয়ের সৃষ্টিশীলকর্ম এ আইনের বিধানুযায়ী কপিরাইট আইন এবং প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক আইনের অধীনে নিবন্ধন করা যায় না। এক্ষেত্রে কর্মের ধরণ অনুযায়ী নিবন্ধন করতে হয়।
আইনের একাদশ অধ্যায়ের ৬২ থেকে ৭৪ ধারায় কোনো কর্মের নিবন্ধন পাশাপাশি পুস্তক ও সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেসন্স (ডিকলারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রকাশিত প্রতিটি পুস্তকের একটি কপি জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে যথাবিধি পুস্তক জমা দেয়া না হলে তার জন্য এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
আইনের অধ্যায় ১২-এর ৬৮ থেকে ৭০ ধারায় আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন বিষয়ে বিধান বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইট আইন একটি সার্বজনীন আইন। আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের কপিরাইট আইনের সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কপিরাইট বিষয়ক চুক্তি, কনভেনশনে যেসব দেশ স্বাক্ষরকারী সেসব দেশ এ আইনের কপিরাইটের অধিকার পেতে পারে। কপিরাইট আইন একক কোনো দেশের কপিরাইট আইন নয়, কপিরাইট আইন সর্বদা আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনের সঙ্গে সম্পর্ক বিদ্যমান। এক কথায়, কপিরাইট আইনের সীমানা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃত। আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন সকল দেশের জন্য সুফল বয়ে আনে। এ কপিরাইট আইন বিদেশি প্রণেতার সৃষ্টিকর্ম নিজ নিজ দেশের প্রণেতার সৃষ্টিকর্মের মতোই কপিরাইট নিশ্চিত করে।
এ আইনের অধ্যায় ১৩-এর ৭১ থেকে ৭৪ ধারার কপিরাইটের লঙ্ঘন বিষয়ে বিধান বর্ণিত হয়েছে। কপিরাইট লঙ্ঘনের সঙ্গে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সনদ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কেননা, যিনি অভিযোগ করবেন যে তার কপিরাইট লঙ্ঘন হয়েছে তাকে প্রমাণ দিতে হবে যে সৃষ্টিকর্মটির উপর তার কপিরাইট আছে। আইনের ৭১ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে ৮২ ধারায় লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে আইন ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এই ব্যবস্থা তিনটি ধাপে নিষ্পত্তি করা হয়। প্রথম কপিরাইট রেজিস্ট্রার প্রশাসনিক প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তারপর এটার আপিল নিয়ে কপিরাইট বোর্ডে এলে বোর্ডের দ্বারস্থ হওয়া যায়। তৃতীয় ধাপে বিচারিক কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া যায়। এক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালত ও ফৌজদারি আদালত উভয় ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
আইনের ৭২ ধারায় কি কি কাজে কপিরাইট লঙ্ঘন হয় না তা আলোচনা করা হয়েছে। গবেষণাসহ ব্যক্তিগত অধ্যয়ন বা ব্যক্তিগত ব্যবহার, বিচারিক কার্যধারার রিপোর্টের উদ্দেশ্যে সাহিত্য, নাট্য, সংগীত ও শিল্পকলা পুনরুৎপাদন, শিক্ষক বা ছাত্র কর্তৃক শিক্ষাদান প্রক্রিয়া বা পরীক্ষা উত্তরদানের জন্য পুনরুৎপাদন কোনো অপেশাদার ক্লাব বা সমিতি অথবা কোনো ধর্মীয়, দাতব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপকারার্থে উপস্থাপন করা হয় এমন কোনো সাহিত্য, নাট্যকর্ম, সংগীতকর্মের সম্পাদনার পুনরুৎপাদন, জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন ব্যতীত সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে এমন কোনো বিষয় পুনরুৎপাদন, আদালত ও ট্রাইব্যুনাল বা অন্যান্য বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত রায়, আদেশ পুনরুৎপাদন বা প্রকাশ কপিরাইটের লঙ্ঘন নয়। অর্থাৎ এসব কাজে কপিরাইট লঙ্ঘন বা কপিরাইট ভঙ্গ হয় না। এ কাজগুলোকে ফেয়ার ইউজ বলে।
এ আইনের অধ্যায় ১৪-এর ৭৫ ধারা থেকে ৮১ ধারায় মেধাস্বত্বের কপিরাইটবিষয়ক কর্ম লঙ্ঘন করা হলে দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে দেওয়ানি প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
কপিরাইট লঙ্ঘন হলে দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতিপূরণ আদায়, হিসাবের মামলা ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। দেওয়ানি আদালতের এ প্রতিকারের বিধান জেলা জজ আদালতে পাওয়া যায়।
আইনের ৭৮ ধারায় প্রণেতার বিশেষ স্বত্ব বা অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। প্রণেতার সৃষ্টিকর্মের সাথে অক্ষুণœ অবস্থায় সৃষ্টিকর্ম রাখার অধিকার সবসময়ই থাকে। স্বত্বের মেয়াদ শেষ হলেও নৈতিক অধিকার প্রণেতার কখনও শেষ হয় না। তাই কপিরাইট স্বত্ব হস্তান্তর বা বিক্রয় করার পরও প্রণেতার কর্মের কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জনে বাধা দেওয়ার অধিকার প্রণেতা বা তার উত্তরাধিকারীর সবসময় থাকে।
এ আইনের পঞ্চাদশ অধ্যায়ের ৮২ থেকে ৯৩ ধারায় কপিরাইট লঙ্ঘিত হলে ফৌজদারি আদালতের মাধ্যমে ফৌজদারি প্রতিকার অর্থাৎ অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রণেতা বা কপিরাইটের মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রণেতার সৃষ্টিকর্ম চুরি, নকল বা মুদ্রণ, পুনঃমুদ্রণ, অনুবাদ, প্রকাশ ইত্যাদি লঙ্ঘন করলে ফৌজদারি শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি হিসেবে কপিরাইট ভঙ্গকারীর সর্বোচ্চ চার বছর এবং সর্বনিম্ন ছয় মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি সর্বোচ্চ দুই লাখ এবং সর্বনিম্ন পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর ও সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা জরিমানা। ফৌজদারি আদালতের এ বিচার হবে দায়রা জজের আদালতে। এছাড়া মিথ্যা অঙ্গীকার দিয়ে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করলে তাও এ আইনের বিধানুযায়ী ফৌজদারি বিচার হবে।
এ আইনের ৯৩ ধারানুযায়ী লঙ্ঘিত অনুলিপি জব্দ করতে সাবইন্সপেক্টর পদধারী থেকে উচ্চতম পদধারী পুলিশ অফিসারকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। পুলিশ অফিসার এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া সরকার কর্তৃক গঠিত টাক্সফোর্সও এ কাজ করতে পারে।
এ আইনের অধ্যায় ১৬ এর ৯৪ থেকে ৯৭ ধারায় আপিলের বিধান প্রদত্ত রয়েছে। আইনের ৯৫ ধারা অনুযায়ী রেজিস্ট্রারের আদেশের বিরুদ্ধে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ৩ মাসের মধ্যে কপিরাইট বোর্ডের নিকট আপিলের বিধান রয়েছে। বোর্ড আপিল শুনানি গ্রহণ করলে তাতে রেজিস্ট্রার উপস্থিত থাকবেন না। বোর্ড ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ ও দণ্ডবিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী একটি আদালত। এজন্য বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রায় ও আদেশ আদালতের সিদ্ধান্ত, রায় ও আদেশ ন্যায় বিবেচিত।
এ আইনের ৯৬ ধারানুযায়ী সংক্ষুব্ধ পক্ষ রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার বিধান রয়েছে।
আলোচ্য আইনের অধ্যায় ১৭ এর ৯৯ থেকে ১০৫ ধারায় কপিরাইট রেজিস্ট্রার, কপিরাইট বোর্ডসহ বিবিধ বিষয়ে ক্ষমতা, আদেশ ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। আইনের ১০০ ধারায় কপিরাইট বোর্ড বা রেজিস্ট্রার বা হাইকোর্ট অর্থ প্রদানের কোনো আদেশ দেন তবে তা দেওয়ানি আদালতের ডিক্রিরূপে গণ্য ও জারি হয়।
কপিরাইট আইন একটি বহুল পরিচিত আইন। সৃজনশীল মানুষের আইপি প্রটেকশনের জন্য এ আইন প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশে কপিরাইট সম্পর্কিত ধারণা সমৃদ্ধির সূত্রপাত। এরই অনুবৃত্তিক্রমে প্রথমে পাকিস্তান আমলে, তারপর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলে বাংলাদেশ আমলেও কপিরাইট আইন জারি করা হয়। বর্তমানে বিদ্যমান কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত)-এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এ আইনের ১৯ ধারায় লিখিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে অথচ এ আইনের তফসিলে বা এ আইনের বিধিমালায় চুক্তির কোনো নমুনা দেওয়া হয়নি। তাছাড়া কপিরাইট বিধিমালাটি খুব স্বল্প পরিসরে কপিরাইট আইনের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এই বিধিমালাটি বিস্তৃত পরিসরে হওয়া প্রয়োজন। কপিরাইট আইনে সমিতির কথা বলা হয়েছে। এই সমিতি কপিরাইট সংরক্ষণ, র্যায়ালটি ইত্যাদি কাজে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ ধরনের সমিতির দেশে তীব্র অভাব রয়েছে। বিদ্যমান কপিরাইট আইনে ফোকলোর বিষয়ে কোনো বিধান নেই। এ আইনে ফৌজদারি শাস্তির বিধানটি আলাদা একটি ফৌজদারি কপিরাইট আদালতের মাধ্যমে হলে ভালো হতো। কপিরাইট আইন সৃষ্টিশীল মেধাবীদের সহায়ক। কপিরাইট সুরক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীতে বহু জাতি এগিয়ে যাচ্ছে।
সুতরাং এই আইনটি যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। জানা যায়, এ সংক্রান্ত একটি নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একটি যুগোপযোগী কপিরাইট আইন সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হলে সৃষ্টিশীল মানুষ কাজের স্বীকৃতি পাবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ তরান্বিত হবে, এদেশ এগিয়ে যাবে। সর্বোপুরি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা, সাংবিধানিক আইন ও আইনের শাসন এবং মৌলিক মানবাধিকারকে সমুন্নত করতে কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
লেখক: গবেষক