খুরশীদ কামাল তুষার
খুরশীদ কামাল তুষার

মামলার পিঠে মামলা নয়, বিরোধের নিষ্পত্তি হোক বিকল্প উপায়ে

খুরশীদ কামাল তুষার: মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। প্রত্যেক মানুষকে তার পরিবার ও সমাজকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকতে চলার পথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষের তার পরিবার ও সমাজের মানুষের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক ও স্বভাবগত একটা বিষয়। কিন্তু বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌছুলে তার চুড়ান্ত পরিনতির জন্য মানুষ মামলা করে, আদালতের দ্বারস্থ হয়। বিরোধে জড়ানো দুই পক্ষ নিজেদের পক্ষে রায় আনার জন্য কখনো ন্যায় কখনো অন্যায় উপায় অবলম্বন করে, দশ হাজার টাকার সম্পদ রক্ষা করে নিজের কব্জায় নিতে দশ লক্ষ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করে না।

বাংলাদেশে দেওয়ানি মামলাসমূহ কখনো পক্ষগণের জিদের কারণে কখনো অসৎ আইনজীবীর পাল্লায় পড়ে আবার কখনো আদালতের কাজের বিলম্বের কারণে দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। মামলার পর মামলা জমতে থাকে আর মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে মামলাকারী মৃত্যুবরণ করে তার উত্তরাধিকারীরা মামলার পক্ষগণে স্থলাভিষিক্ত হয়।

দেওয়ানি মোকদ্দমার এই দীর্ঘসূত্রিতা নিরসন ও সরাসরি মামলা না করে কম খরচে আদালতের বাইরেই পক্ষগণের মধ্যে সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করতে একটি নন্দিত ও জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে বিরোধে জড়ানো দুই পক্ষ পরস্পরের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসন করাই হলো এডিআর এর উদ্দেশ্য।

সরাসরি মামলা না করে কেন এডিআর করবেন?

আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়টি প্রায় সকলের জানা, গ্রাম বা শহরের অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বা শিক্ষিত সমাজ এই কারণে আদালতপাড়াকে অনেক সময়ই অনেকটা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। অনেকে মামলা করে ঠিকই কিন্তু পারিবারিক বিরোধ বা প্রতিবেশীর সাথে বিরোধের জেরে আদালতে এসে সবার সামনে সব বিষয় নিয়ে নির্ভয়ে খোলাখুলি কথা বলতে চায় না বা অনেক সময় সবার সামনে সবকিছু বলা সম্ভব ও হয় না। এখানেই এডিআর খুবই কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। একেবারে বিনা আনুষ্ঠানিকতায় খুবই স্বাবাবিক আলোচনার ভেতর দিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা পক্ষগণ নিজেরাই তৃতীয় একটি নিরপেক্ষ পক্ষকে নির্বাচন করার সুযোগ পায়, যার কাছে নির্দ্বিধায় সবকিছু খুলে বলতে পারে।

এডিআর এর আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে আলোচনায় পেশ করা তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ, দলিল-দস্তাবেজ ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ঐ আলোচনায় অংশ নেয়া ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ জানেনা এবং পরে তা অন্য কোথাও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করারও সুযোগ নেই। যেটা আদালতে মামলার ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের জন্য একরকম উন্মুক্ত থাকে এবং পরবর্তীতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। লিখিত আইনের বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে দুই পক্ষের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে পক্ষগণ উভয়ই কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়, লাভবান হয়। দুইয়ের অধিক পক্ষ থাকলেও একই বৈঠকে সবার সুবিধামত সমাধান করে দেয়া সম্ভব হয়। গতানুগতিক মামলার চেয়ে অনেক কম সময়ে ও অনেক কম খরচে বিরোধের নিষ্পত্তি করা যায়।

বাংলাদেশি আইনে এডিআর বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান

ঐতিহাসিকভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান অনেক পুরাতন একটি প্রথা। বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে এই ধারা যেমন স্বীকৃত তেমনি লিখিত আইনেও বিকল্প এই ধারাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের আইনও তার ব্যতিক্রম নয় এবং কিছু মামলার ক্ষেত্রে আগে এডিআর করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং এডিআর দ্বারা সমাধানে ব্যর্থ হলে তবেই আদালতে যাওয়ার বিধান রয়েছে।

পারিবারিক বিরোধের মামলা নিরসনে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ১০ ও ১৩ তে বিধান রয়েছে যে আদালত শুরুতেই সাক্ষ্য গ্রহণ না করে পক্ষগণের কথা শুনে আপোষের চেষ্টা করবেন এবং আপোষ করতে না পারলে পরে সাধারণ নিয়মে মামলার কার্যক্রম চলবে আর চূড়ান্ত রায়ের আগে আরেক দফা মীমাংসার চেষ্টা করবেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হলে রায় ও ডিক্রি জারি করবেন।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর কয়েকটি ধারায় আলাদা আলাদা বিষয় যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির বন্টন ইত্যাদির জন্য আদালতে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টার বিধান রয়েছে।

তেমনিভাবে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪; ভ্যাট আইন, ১৯৯১; কাস্টমস আইন, ১৯৬৯; শ্রম আইন, ২০০৬; অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০১০ সহ অনেক আইনে নির্দিষ্ট ধারায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে গুরুত্বের সাথে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

এছাড়াও পুর্বের সালিশি আইন সংশোধন করে সালিশি আইন, ২০০১ করা হয়েছে, গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ সহ আরও কিছু সুনির্দিষ্ট আইন করা হয়েছে যাতে আদালতে না গিয়েই মানুষ তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে।

সবচেয়ে বড় ও আলোচিত দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৯ এ ২০০৩ সালে নতুন করে ধারা ৮৯ক যুক্ত করে প্রথমে ঐচ্ছিক এডিআর বিধান, পরবর্তীতে ৮৯খ, ৮৯গ যুক্ত করে এডিআর কে আপীল পর্যায়েও করার বিধান করে সকল মোকদ্দমা সমাধান হোক বা না হোক প্রথমে এডিআর এর মাধ্যমে যাওয়ার বাধ্যকরী নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে দেওয়ানী মামলা সহজে নিষ্পত্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

মন্তব্য

মামলার জট কমানো, বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি দূরীভূত করতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর আইন জগতে আশীর্বাদ স্বরুপ। যদিও এতসব সুযোগের ভীড়ে কিছু প্রতিবন্ধকতাও স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়। সব ধরনের মামলায় এডিআর করার সুযোগ নেই। দুই পক্ষের মধ্যে দুর্বল পক্ষ অনেক সময় কথা গুছিয়ে বলতে না পারায় সঠিকভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা।

আবার এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত জনগণ থেকে গোপন থাকে বলে এর পরবর্তী বাধ্যকরী কোন প্রভাবও নেই। আইনজীবীরা অনেক সময় এডিআর করতে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। তাছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে এডিআর স্বভাবের বাইরে গিয়ে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিষয়ে পরিণত হয় এবং আদালতের বাইরের বিচার বলে এই প্রক্রিয়াকে দ্বিতীয় শ্রেণির বিচারব্যবস্থা বলা হয়।

প্রত্যেক বিষয়ই ভাল মন্দ নিয়েই থাকে, মন্দের কথা চিন্তা করে তার ভালদিক গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া মোটেই কাম্য নয়। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা থেকে রেহাই পেতে এবং সময় বাঁচিয়ে কম খরচে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে তাই এডিআর বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম।

খুরশীদ কামাল তুষার: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।