বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী

এতদিন কি ঘুমিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি

যথাসময়ে না এসে দীর্ঘ চার বছর পর রাষ্ট্রপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করায় তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এসময় রাষ্ট্রপক্ষ এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন কি-না, এমন প্রশ্ন তুলেন প্রধান বিচারপতি।

চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনে সেলিম খানকে অনুমতি দিয়ে রায়ে ঘোষণা করে হাইকোর্ট। চার বছর আগে দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে চলতি বছর লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

হাইকোর্টের ওই রায় বাতিল চেয়ে করা আপিলের শুনানি রোববার (২৯ মে) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগে অনুষ্ঠিত হয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান। সেলিম খানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি।

শুনানির এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, রায় ঘোষণা হয়েছে ২০১৮ সালে। আর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন এক হাজার ৪৪০ দিন পর। এতদিন কি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন?

এ পর্যায়ে বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ কখন ঘুমায় আর কখন জেগে থাকে বোঝা মুশকিল।

তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই ঘুমিয়ে থাকারও একটা তদন্ত হওয়া দরকার।

শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির বেঞ্চ বিলম্ব মার্জনার আবেদন মঞ্জুর করে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন।

রায়ের পর যা বললেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের ফলে জনস্বার্থের নামে ব্যক্তিস্বার্থে সেলিম খানের বালু উত্তোলনের কাজ বন্ধই থাকবে। তিনি বলেন, নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে হলে আইনানুযায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেটাকে বালু মহাল ঘোষণা করতে হবে। বালু মহাল ঘোষণার পর সেখান থেকে কে বালু উত্তোলন করবেন তা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। কিন্তু এই ধরনের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই হাইকোর্টে রিট করে বালু উত্তোলনের সুযোগ পান চেয়ারম্যান সেলিম খান।

হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল চেয়ে আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়। সেই আবেদনের উপর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দিয়েছেন বলেও জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি।

সেলিম খানের রিট ও হাইকোর্টের রায়

চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। চাঁদপুর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজায় জনস্বার্থে নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। নৌপথ সচল করার কথা বলে তিনি এ রিট করেন। ২০১৫ সালে ওই রিটের উপর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে আদালত ৩০ দিনের মধ্যে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে প্রতিবেদন দিতে বিবাদীদের নির্দেশ দেয়।

ওই জরিপ প্রতিবেদন পেয়ে ২০১৮ সালে দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট বলে, এতে প্রতীয়মান হয় যে ওই মৌজাগুলোয় পর্যাপ্ত বালু বা মাটি রয়েছে এবং তা তুলতে কোনো বাধা নেই। এছাড়া আপত্তি জানিয়ে বিবাদীদের (ভূমি সচিব, নৌপরিবহন সচিব, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ও হাইড্রোগ্রাফিক বিভাগের পরিচালক) পক্ষ থেকে কোনো জবাবও (হলফনামা) দায়ের করা হয়নি, যাতে বিষয়টি (বালু থাকা) বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

এপ্রেক্ষিতে রায়ে ‘প্রকৃত অর্থে সহযোগিতায়’ চাঁদপুরের ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে ৮৬ দশমিক ৩০ কিউবিক মিটার (৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট) বালু উত্তোলনে তাঁকে অনুমতি দিতে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।

গণমাধ্যমে সংবাদ ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল

সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে মেঘনার ডুবোচর থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে সেলিম খানের বালু উত্তোলন নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই রায় বাতিল চেয়ে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

এতে বলা হয়, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ডুবোচরের বালু উত্তোলনের বিষয়ে কোনো ধরনের মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি রিটে উল্লেখিত মৌজাগুলো বিভাগীয় কমিশনার বালুমহাল হিসেবেও ঘোষণা করেননি। তাই হাইকোর্টের রায়ে রিটকারীকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা বাতিলযোগ্য।

শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেয়।