মনজিলা সুলতানা ঝুমা : ডিজিটাল পদ্ধতির অপব্যবহার করে অ্যানড্রয়েড ফোন, টিভি, কম্পাউটার, ল্যাপটপের মাধ্যমে জমজমাট হয়ে উঠেছে জুয়ার আসর। বাস্তবিক অর্থে জুয়া শব্দটি এখন আর আগের মত শুধু টাকার বিনিময়ে তাশ খেলাকে বুঝায় না। তথ্য প্রযুক্তির যুগে বদলেছে জুয়া খেলার ধরণ। জুয়া শব্দটিকে অর্থবহ করে কিছু নতুন শব্দ যেমন – ক্যাসিনো, অনলাইন বাজি, বেটউইনার ইত্যাদি।
বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যায়, ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের কিছু অভিজাত ক্লাব ও ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ক্লাবে হাউজির নামে এবং ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা চলে আসছে। ক্রিকেটসহ বিভিন্ন লীগেও চলেছ জুয়া খেলা,এটাকে নাম দেয়া হয়েছে- অনলাইন জুয়ার আসর। বিভিন্ন অ্যাপ খুলে চালানো হচ্ছে অনলাইন জুয়া। যা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খেলা যায়। দেশে অনলাইনভিত্তিক জুয়া এক রমরমা ব্যবসার নাম। দেশে বর্তমানে অর্থের সম্পৃক্ততায় বিভিন্ন ধরনের যে জুয়া খেলা হয়; তা এক দিকে অনৈতিক ক্ষতি অন্য দিকে দেশের সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী।
জুয়া, বাজি (gambling) কি
জুয়া (gambling) এর বাংলা অর্থ যে খেলায় বাজি রাখা হয়। জুয়া এর কিছু সমার্থক শব্দ চুরি, জুচ্চুরি, জোচ্চুরি, ধোঁকাবাজি; প্রবঞ্চনা; প্রতারণা; শঠতা; ঠকামি ইত্যাদি। জুয়া বা বাজি হচ্ছে এমন একটা খেলা যা লাভ বা লোকশানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে। জুয়া খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ বা বস্তু (যা পুরস্কার হিসেবে ধার্য করা হয়) নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনো একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হার জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায় সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে। এই খেলায় হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়াতে উভয় পক্ষেরই ঝুকি নিতে হয়। জুয়া খেলায় বিজয়ী পক্ষ পুরস্কারের অর্থ কখনো সাথেসাথে পেয়ে থাকে আবার কখনো তা পেতে দেরি হয়।
ক্যাসিনো কি
ক্যাসিনো ইতালীয় ভাষার শব্দ যার মূল ক্যাসা অর্থ ঘর। ক্যাসিনো বলতে ছোট ভিলা, গ্রীষ্মকালীন ঘর কিংবা সামাজিক ক্লাবকে বোঝানো হতো। ১৯ শতকের দিকে ক্যাসিনো বলতে এমনসব ভবনকে বোঝানো হতো যেখানে আনন্দদায়ক কাজকর্ম হতো, যেমন নগরের সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে নাচ, গান, জুয়া ও ক্রীড়ার ব্যবস্থা থাকতো।
ক্যাসিনো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার একটি নির্দিষ্ট স্থান যাকে বাংলায় জুয়ার আড্ডা বা আসর বলা যায়। কিন্তু সেটা হয় সুবিশাল পরিসরে। সাধারণত ক্যাসিনো এমনভাবে বানানো হয় যে এর সাথে কিংবা পাশাপাশি হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, আনন্দভ্রমণ জাহাজ এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ থাকে৷ কিছু কিছু ক্যাসিনোয় সরাসরি বিনোদন প্রদান যেমন স্ট্যান্ড আপ কমেডি, কনসার্ট, খেলাধুলা ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ঢাকার কিছু ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ক্লাব থেকে ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত উপকরণ জব্দ করা হয়। কিছু হোতাকে গ্রেফতারের পর তাদের হেফাজতে বিপুল অর্থ বৈভবের সন্ধান মেলে।
বেটউইনার কি
এটি একটি অনলাইন বেটিং বা জুয়ার একটি সাইট। যেখানে যে কেউ চাইলেই বেট ধরতে পারে। সম্প্রতি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান একটি জুয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। সাকিব আল হাসানের প্রচার করা বেটউইনার পরেই অনেকে এ-সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। সাকিব আল হাসান তার অফিসিয়াল ফেজবুক পেইজে ২ আগস্ট বেটউইনার নিউজের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ার কথা জানিয়ে পোস্ট করেন। তার এমন ঘোষণায় অনেকেই চমকে গেছেন, কারণ তাদের কাছে বেটউইনার শব্দটা এতোদিন ছিল খেলা বিষয়ক বেটিং, বাজি বা জুয়ার সাইট। যে সাইটে অনলাইন ক্যাসিনো খেলার মতো সুযোগ রয়েছে। তবে বেটউইনার নিউজে সরাসরি জুয়ার অপশন নেই। আমাদের দেশে অনেকগুলো বেটিং সাইট/অ্যাপের রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্নস্থানে গড়ে উঠেছে বেটিং সাইটের মতো ‘মোবাইল জুয়া’ চক্র।
বেটউইনার কিভাবে প্রকট আকার ধারণ করছে
ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ যেসকল দেশে জুয়া বৈধ সেসব দেশভিত্তিক বেশ কিছু অনলাইন বেটিং সাইট আছে, যারা ক্রিকেট, ফুটবলসহ অসংখ্য খেলায় বাজি ধরার ব্যবস্থা করে দেয়। সেসব সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। ডলারও জমা দিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় পাসপোর্টের কপি, ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। বাংলাদেশিদের এই দেশে থেকে ওইসব সাইটে অ্যাকাউন্ট খোলা প্রায় অসম্ভব। এজন্য পরিচিত বাংলাদেশি অথচ বিদেশে থাকেন তাদের নামে বাজিকররা অ্যাকাউন্ট খোলেন। আর সেই অ্যাকাউন্ট চালানো হয় বাংলাদেশ থেকে।
বেটিং অ্যাকাউন্টের টাকা লেনদেন হয় বিদেশে থাকা ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা অ্যাকাউন্ট চালনাকারীর সঙ্গে লেনদেন হয় অন্য উপায়ে। হয় তিনি মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠান, অথবা বিদেশে থাকা ব্যক্তির বাংলাদেশি প্রতিনিধি টাকা আদান-প্রদান করেন। যাদের বিদেশে কোনো পরিচিতজন নেই তাদের জন্যও রয়েছে অন্য ব্যবস্থা। মাসিক ভাড়ায়ও পাওয়া যায় বেটিং অ্যাকাউন্ট। বাংলাদেশে এখন ভাড়ায় বেশি চলছে বেটিং অ্যাকাউন্ট। বিশেষ করে আইপিএল, বিপিএলের মতো টি-২০ লীগগুলো শুরু হলেই এই অ্যাকাউন্টগুলোর চাহিদা বাড়ে।
বেটিং সাইটগুলোয় যেকোনো খেলা শুরুর আগে বাজির দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কোন দলের পক্ষে বাজি ধরে জিতলে কত টাকা দেয়া হবে এবং হারলে কত টাকা দিতে হবে সেটা উল্লেখ করা থাকে। শুধু তাই নয়, বাজি ধরার জন্যও রয়েছে পরামর্শ সাইট ও ফেসবুক পেইজ। এসব সাইট বা পেইজে যে কোনো টুর্নামেন্টের শুরুতে ফ্রিতে পরামর্শ দেয়া হয় এবং খেলা সম্পর্কিত নানা তথ্য দেয়া হয়। পরে টাকার বিনিময়ে পরামর্শ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের আইনে কি বলা আছে
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(২)অনুচ্ছেদের বলা আছে ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সংবিধান শর্তহীনভাবে মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করেছে।
সংবিধানে জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে বলা হয়েছে। এ কথা বলা থাকায় এ বিষয়ে যথাযথ ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করে সব ধরনের জুয়া খেলা, এর সাথে সংশ্লিষ্টতা এবং ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর আমদানি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করে এর ব্যত্যয়ে কঠোর সাজার বিধান রেখে আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সংবিধান কার্যকর হওয়ার প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এ বিষয়ে কঠোর সাজার বিধান রেখে এখনো যথাযথ ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করা হয়নি বা প্রণয়নের উদ্যোগও নেয়া হয়নি। দুর্বল আইনের নামমাত্র সাজার ফাঁকফোকর গলিয়ে দেশের সর্বত্র বাধাহীনভাবে জুয়া খেলা চলছে।
দ্য পাবলিক গেম্বলিং অ্যাক্ট বা ‘প্রকাশ্য জুয়া আইন ১৮৬৭‘ এ জুয়া সংক্রান্ত শাস্তি
জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রায় দেড়শত বছর আগে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। যা আমাদের দেশে ‘প্রকাশ্য জুয়া আইন ১৮৬৭‘ নামে পরিচিত। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্য পাবলিক গেম্বলিং অ্যাক্ট প্রণীত হয় তখনকার সমাজব্যবস্থা এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী।
উল্লিখিত আইনটিতে গেম্বলিং বা গেমিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- জুয়া নির্ধারিত দিন নির্ধারিত স্থানে অনুমোদিত ব্যক্তি পরিচালিত ঘোড়দৌড় ছাড়া বাজি বা পণকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই আইনটি মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য হয়। কারণ মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী জুয়া বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়।
অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা দিয়ে বাংলাদেশে জুয়া ব্যাপকতা লাভ করেছে। দেশের জুয়া খেলার ধরন পাল্টাচ্ছে, এবং এই আইনের শাস্তিও পর্যাপ্ত নয়। পুরানো এই আইনে ‘ক্যাসিনো’ বা অনলাইন ভিত্তিক জুয়া, ইত্যাদি কোনো শব্দগুলো নেই। সেহেতু আইনটিকে যুগোপযোগী করতে হবে। জুয়া খেলা বন্ধে বিদ্যমান আইনটি দ্রুত সংশোধন করে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইনের ১ ধারায় সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এই আইন প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ নামে অভিহিত হবে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে। ৩ ধারা মতে শাস্তিঃ তিন মাসের কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন এবং সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়ারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
আইনটির ৪ নম্বর ধারায় এরূপ স্থানে জুয়া খেলারত অবস্থায় অথবা খেলাতে উপস্থিত ব্যক্তিদের দণ্ডের বিষয়ে বলা হয়েছে- এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি অনূর্ধ্ব এক মাসের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অথবা অনূর্ধ্ব ১০০ টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
১৯৭৬ সালের ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ বা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর অধীনে জুয়ার শাস্তি
১৯৭৬ সালের ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশে এ বিষয়ে দুটি ধারা আছে। ৯২ ধারা বলেছে, যারাই জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে কোনো সড়ক বা পাবলিক প্লেসে (জনসমাগম স্থল) মিলিত হবে, তাদের অনধিক ১০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। ৯৩ ধারা বলছে, গণবিনোদনে কেউ কোনো খেলায় যুক্ত হলে তাকে অনধিক ২০০ টাকা জরিমানা করা যাবে।
দ্য পাবলিক গেম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ সমগ্র বাংলাদেশে কার্যকর হলেও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর কার্যকারিতা শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সীমাবদ্ধ। অনুরূপভাবে ঢাকার মতো অপরাপর যেসব শহরকে মেট্রোপলিটন শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; সেসব মেট্রোপলিটন শহরে অনুরূপ আইন কার্যকর করা হলে সেসব শহরের ক্ষেত্রেও দ্য পাবলিক গেম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ কার্যকারিতা প্রয়োগের সুযোগ রহিত হয়ে যায়।
আমাদের মূল দণ্ড আইন দণ্ডবিধি একটি সাধারণ আইন। অপর দিকে দ্য পাবলিক গেম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এবং অপরাপর মেট্রোপলিটন শহর সংশ্লিষ্ট আইন বিশেষ আইন। সচরাচর বিশেষ আইন সাধারণ আইনের ওপর প্রাধান্য পায়। আমাদের দণ্ডবিধি জুয়া খেলা বা জুয়া খেলার সাথে সংশ্লিষ্টতার অপরাধ বিষয়ে নিশ্চুপ।
উপসংহার
সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানেই বলা আছে- সংবিধান ও আইন মেনে চলা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধে রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা থাকায় এ বিষয়ে যথাযথ ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করে সব ধরনের জুয়া খেলা, এর সাথে সংশ্লিষ্টতা এবং ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর আমদানি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করে এর ব্যত্যয়ে কঠোর সাজার বিধান রেখে আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর আবশ্যিক কর্তব্য জুয়া খেলা যেন কোনোভাবে চলতে না পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা।
লেখক : আইনজীবী; জেলা ও দায়রা আদালত ঢাকা এবং খাগড়াছড়ি।