মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : দশ হাজার ইয়াবা দিয়ে দুই জনকে আসামি করে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় একটি মাদকের মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু আদালতে মামলাটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। মিথ্যা মামলা দায়ের, ঘটনাস্থল পরিবর্তন, আদালতে মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান সহ সব কিছুতেই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ায় মামলার এজাহার দায়েরকারী, তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও), সাক্ষী সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে তলব করেছেন আদালত।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন গত বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আসামীদ্বয়কে বেকসুর খালাস দিয়ে এ আদেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী দেলোয়ার হোসেন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম-কে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, মিথ্যা মামলায় জড়িত সকলের বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবেনা, ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৯৪ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হবেনা, তৎমর্মে ব্যাখ্যা দিতে আগামী ২৪ অক্টোবর স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হতে বলেছেন বিজ্ঞ বিচারক।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী এবং আসামীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ও অ্যাডভোকেট এসমিকা সুলতানা।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮ টার দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের একটি টিম কক্সবাজার সদর উপজেলার দক্ষিণ কলাতলী শুকনাছড়ি মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে মনসুর কুলিং কর্ণারের সামনে এক অভিযান চালিয়ে ২ ব্যক্তিকে আটক করে। এজাহারের ভাষ্য অনুযায়ী- আটক ২ ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
আটককৃত ২ জন হলেন উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের মনখালী গ্রামের মোঃ ফরিদ ও জাহেদা বেগমের পুত্র আবদুর রহমান (২০) এবং একই ইউনিয়নের বড় ইনানী গ্রামের ছৈয়দ উল্লাহ ও ইসমত আরার পুত্র নুরুল আমিন (২৯)।
এ ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক জীবন বড়ুয়া বাদী হয়ে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) সারণীর ১০ (গ) ও ৪১ ধারায় কক্সবাজার সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার কক্সবাজার সদর থানা মামলা নম্বর : ১২/২০২১ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর : ১২/২০২১ ইংরেজি (কক্সাবাজার সদর) এবং এসটি মামলা নম্বর : ৮৩১/২০২১ ইংরেজি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক এবং মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মোঃ কামরুজ্জামান ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। যার চার্জশীট নম্বর : ১০৯। মামলাটি বিচারের জন্য ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়।
চার্জশীটে মোট ৬ জন সাক্ষী রাখা হয়। তারমধ্যে, ৪ জন সাক্ষী হচ্ছেন- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের স্টাফ এবং অপর ২ জন হচ্ছেন- পাবলিক সাক্ষী।
বিচার ও রায়
চার্জশীটের পাবলিক সাক্ষী মোঃ মনসুর আলম ও নরুল হাকিম সাক্ষ্যদানকালে আদালতে বলেন, তারা শুধু আসামীদের দেখেছেন। তবে তাদের সামনে কোন ঘটনা ঘটেনি। তাই কোথায়, কিভাবে, কখন ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে, সাক্ষীদ্বয় তা জানেন না। এজাহারে উল্লেখিত কক্সবাজার সদর উপজেলার দক্ষিণ কলাতলী শুকনাছড়ি মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে মনসুর কুলিং কর্ণারের সামনে এ ঘটনা ঘটেনি। আসামীদ্বয়কে এজাহারে বর্ণিত ঘটনাস্থল থেকে আটকও করা হয়নি, ভিন্ন জায়গা থেকে আসামীদ্বয়কে আটক করে এ জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে তারা আদালতে সাক্ষ্য দেন।
অন্যদিকে, আসামীদের পক্ষে ৩৪২ ধারায় মানিত সাফাই সাক্ষী সানাউল্লাহ ও নুরুল ইসলাম রানা আদালতে বলেন, উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানীর আব্বাসিয়া হোটেলে আসামীদ্বয় সহ চা পানের সময় তাদের সামনে থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের লোক পরিচয় দিয়ে অহেতুক আসামীদ্বয়কে আটক করে নিয়ে যায়। এজাহারে উল্লেখিত তথাকথিত কক্সবাজার সদর উপজেলার দক্ষিণ কলাতলী শুকনাছড়ি মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে মনসুর কুলিং কর্ণারের সামনে থেকে আসামীদের আদৌ আটক করা হয়নি। আটক করার সময় তাদের কাছ থেকে কোন ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করতেও সাফাই সাক্ষীদ্বয় দেখেননি বলে আদালতে সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর প্রদত্ত রায়ে বলেন, ঘটনাস্থল ভিন্ন হওয়ায়, আসামীদের আটক ও ইয়াবা উদ্ধারসহ পুরো ঘটনাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় আদালতের কাছে মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আসামীদ্বয়কে আদালত বেকসুর খালাস প্রদান করেন। আসামীদ্বয় ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৪ মে পর্যন্ত এ মামলায় জেল খেটেছে।
অপরদিকে, ঘটনাস্থল পরিবর্তন, মিথ্যা মামলা দায়ের, আদালতে মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান সহ সব কিছুতেই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ায় বিচারক মামলার এজাহার দায়েরকারী, তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও), মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারীরা সহ সংশ্লিষ্ট মিথ্যা মামলায় জড়িত সকলের বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৭৬ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৯৪ ধারায় অভিযোগ দায়েরের জন্য চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করা হবে না এবং কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবেনা, তৎমর্মে ব্যাখ্যা দিতে আগামী ২৪ অক্টোবর স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হতে বলেছেন।