অ্যাড. এম. মাফতুন আহমেদ:
সব সত্য কথা বলা যায় না। সব কথা লেখা যায় না। তবে নদীর প্রবল স্রোতের সামনে কখনো কখনো দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না বলে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ ইতোমধ্যে যে রায় দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তা দু’মাসের জন্য স্থগিত করে এক আদেশ দেন।
মহামান্য আদালতের চলমান কোন আদেশের বিরুদ্ধে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। উল্লেখ্য এর আগে ২৩ নভেম্বর ঋণ আদায়ে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা বাতিল করতে পারবে না মর্মে আদেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।
আদালত বলেন, ঋণের বিপরীতে ব্যাংক চেক নেয়া বেআইনি। দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি কাজ করছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। রায়ে বলা হয়, ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের নেয়া চেক হচ্ছে জামানত, কিন্তু বিনিময়যোগ্য দলিল নয়। তাই সেই চেক দিয়ে ডিজঅনার মামলা করা যাবে না।
আদালত আরও বলেন, চুক্তির মাধ্যমে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়া হয়। তবে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে চেক অপব্যবহারের মাধ্যমে মামলা করে থাকে। তাদের ব্যবহার দাদন ব্যবসায়ীদের মতো। হাইকোর্টের দেওয়া রায়টি স্থগিত করেছেন বৃহষ্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
মহামান্য হাইকোর্ট যেদিন রায় দিয়েছিলেন সেদিন দেখেছিলাম কৃষকের মুখে একরাশ ঝিলিক। শ্রমিকের মুখে আনন্দের উল্লাস। নাঙ্গা-ভূখা মানুষের মুখে বাধভাঙ্গা আনন্দের উচ্ছাস। লাল-পতাকা বেষ্টিত স্বাধীন বাংলাদেশে একটি হয়রানীকর কালো অধ্যায়ের বুঝি শেষ হলো। ইষ্ট ইন্ডিয়া বনিক কোম্পানীর ন্যায় ব্যাংক,সুদখোর,দাদন ব্যবসায়ী এনজিও’র হাত থেকে এদেশের প্রান্তিক জনপদের মানুষগুলোর আপাতত মুক্তি পেলো। ঘোর অমনিশা কেটে গেল।
বেনিয়ার দল একটি ভূয়া ব্ল্যাংক চেকে কোটি কোটি টাকার অংক বসিয়ে কত নিরন্ন,নিরস্থ মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়েছে; ভিটা ছাড়া করেছে তার কোন অন্ত নেই। অন্ত নেই সুদের টাকার জন্য কত মানুষকে গাছে বেঁধে রেখেছে। গরু ছাগল জোর পূর্বক ধরে নিয়ে বিক্রি করে সুদের টাকা আদায় করেছে। এদের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। মনে হয় অধঃস্তন আদালত তাদের কাছে কিছুটা অসহায়।
দেশ যখন অনাচার-অবিচারের চাদরে ঢেকে যায়। বিচার বিভাগ তখন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। বিশ্ব ইতিহাস তাই বলে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই মূখ্যত ভূমিকা পালন করেছিলেন সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট। মহামান্য আপীল আদালত সেই আদেশটি দু’মাসের জন্য স্থগিত করেছেন।
প্রবন্ধটি লিখতে যেয়ে পেশাগত জীবনের কত কথা মনে পড়ে। কত মানুষের চোখের পানিতে আল্লাহ’র আরশ কেঁপে উঠেছে। ভিজে গিয়েছে গোটা শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ।
এ কী হলো? টাকা ঋন গ্রহণ করলো ১০ হাজার টাকা। রক্তচোষা বনিকের বশংবদরা ব্ল্যাংক চেক নিলো ৩ খানা। সাথে আবার মনের হরসে লিখে নিলো ননজুডিসিয়্যাল ষ্ট্যাম্পে যা খুশি, তাই। অবশেষে সুদ আসলে দিতে হলো ৫ লাখ টাকা। শত শত বিনিময়যোগ্য চেকের মামলায় বাস্তব অভিজ্ঞতায় এসব দেখেছি।
আজ শান্তি ফিরেছে প্রান্তিক জনপদের মানুষের ঘরে ঘরে। একরাশ হাঁসি ফুটেছে। দাদন ব্যবসায়িদের চড়া সুদের হাত থেকে জাতি হয়তবা মুক্তি পাবে। আপিল আদালত সঠিক গাইড লাইন দেবেন; এটা জাতি প্রত্যাশা রাখেন।
এখনও অধিকাংশের ধারণা চেকের মামলা মানেই একতরফা জেল জরিমানা। একটি বিনিময়যোগ্য চেক হলেই যথেষ্ট। এটাই মানুষের বদ্ধমূল ধারণা। রসিক মনে অনেকে বলেন কোর্ট বারান্দা মানে ব্যাংক, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের দায়েরকৃত মামলার ভুক্তভোগীদের আনাগোনা।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবশ্যই কল্যানমুখী জনবান্ধব গাইড লাইন দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করবেন এটাই জন প্রত্যাশা।
লেখক- আইনজীবী, খুলনা।