কাজী শরীফ : মাঝেমাঝেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার কোন কোন আদালত সেসব জেলার আইনজীবী সমিতি কর্তৃক বর্জনের কথা শোনা যায়। সে বর্জনের যৌক্তিকতা আছে কি না আমি সে তর্কে যাব না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কারো সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে আমি রাজি না। অধস্তন আদালত ও উচ্চ আদালতের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় সাবেক আইনজীবী হিসেবে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারই পক্ষপাতী নই আমি। যেহেতু আমি একজন সাবেক আইনজীবী ও বর্তমানে বিচারক সেহেতু বার ও বেঞ্চ উভয় জায়গায় আমার অভিজ্ঞতা থাকায় আমার বিশ্বাস এ বিষয়ে লেখার অধিকার আমার আছে।
এ লেখার শুরুতেই অন্য একটা বিষয়ের উদাহরণ দেয়া সঙ্গত মনে করছি। বাংলাদেশে বছর সাত আটেক আগেও হরতাল নামে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালিত হতো। সময়ের বিবর্তনে হরতাল এখন বিলুপ্তপ্রায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশে আর কখনোই হরতাল আগের চেহারা ফিরে পাবে না। কারণ মানুষ মনে করে হরতাল ডাকা ডাকনেওয়ালাদের অধিকার আর আমার রাস্তায় চলাচল করা আমার অধিকার। সুতরাং সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপনি আমার চলাচলে বাধা দিতে পারেন না। তাই রুটি-রুজির তাগিদে মানুষ এখন অন্যের অধিকারে বাধা না দিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
একইভাবে বাংলাদেশের কোন আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্যরা যদি মনে করেন কোন বিচারকের আদালত বর্জন করবেন তা তিনি করতে পারেন। আইনজীবী আদালতে গেলে তিনি একজন বিচারপ্রার্থীকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। আদালতের আইনী প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষ জানে না বিধায় একজন আইনজীবী অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে বিজ্ঞ বলেও সম্বোধন করা হয়। তবে তিনি যদি সিদ্ধান্ত নেন কোন বিচারপ্রার্থীকে প্রতিনিধিত্ব করবেন না সে অধিকার থেকে তাকে বিরত রাখার কোন অধিকার বাংলাদেশের কারো নেই।
একইভাবে কোন বিচারপ্রার্থী যদি মনে করেন তিনি আইনজীবী নিয়োগ করবেন না কিংবা তার সে সামর্থ্য নেই তাহলে তিনি নিজেও নিজের মামলায় আদালতে বক্তব্য রাখতে পারেন। আমি বর্তমানে চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় কোন আসামীকে যদি পাই যার কোন আইনজীবী নেই তাহলে তাকেই জেরা করতে বলি৷ কেউ কেউ বাদীর জবানবন্দি দেন কিন্তু দলিলাদি প্রদর্শন করতে পারেন না তাদের বলি পরের তারিখে মূল দলিল কিংবা সহিমুহুরী নকল নিয়ে আসতে। নোয়াখালীতে সহকারী জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ও তাই করতাম। নোয়াখালীতে এক বিচারপ্রার্থীকে এভাবে আমার আদালত হতে ডিক্রি পেতেও দেখেছি৷ আমি কথাটা এজন্যই বললাম, একজন বিচারপ্রার্থীর অধিকার হরণের অধিকারও একজন আইনজীবী কিংবা বিচারকের নেই। আবার কোন বিচারপ্রার্থী যদি কোন বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দিগ্ধ হোন সেক্ষেত্রেও তার আদালত পরিবর্তনের আবেদন করার সুযোগ প্রচলিত আইনেই আছে।
একইভাবে কোন আইনজীবী সমিতি কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কোন আইনজীবী যদি কোন বিচারকের এজলাস বর্জন করেন তাহলে তাদের যেমন সে বর্জনে বাধা দেয়া যাবে না তেমনি সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক তার বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে এজলাসে উঠলে আপনিও তাকে বাধা দেয়ার এখতিয়ার রাখেন না। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পেশাগত দায়িত্ব পালনের অধিকার থেকে কাউকে বারিত করা মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। একজন আইনজীবীর অধিকার যেমন তিনি প্রয়োগ করতে পারেন তেমনি একজন বিচারক বা বিচারপ্রার্থীও তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। তাদের সে অধিকারে বাধা দেয়ার আপনি কে? তবে কি বিচারক যদি এজলাসে ওঠেন আর বিচারপ্রার্থী যদি নিজেই তার প্রতিকার আদালতের কাছে চান তাতে আপনার ভূমিকা শূন্য হয়ে যায় বলে আপনি শংকা অনুভব করছেন! যে শংকা বিচারকের নেই, যে শংকা বিচারপ্রার্থীর নেই সে শংকা আপনার কেন?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে যে আচরণ কয়েকজন আইনজীবী করলেন ও ভিডিয়োর বদৌলতে যা আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি তা দেখে আমি যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়েছি, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে ও তাদের আচরণে ভাষা হারিয়েছি।
যে বিজ্ঞ বিচারকের আদালত বর্জন করা হয়েছে তার আদালত বর্জনের যৌক্তিকতা নিয়ে আমি প্রশ্ন উত্থাপন করছি না। তিনি নিজেও সে প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। তিনি শুধু তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। যে নগ্ন হস্তক্ষেপ তার উপর করা হলো ও যে শব্দচয়ন করা হলো তাতে যারা এ কাজ করলেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাই প্রস্ফুটিত হয়েছে।
এবার যে সম্মানিত বিচারকের সাথে এমন আচরণ করা হলো তার সম্বন্ধে দুই কথা বলি। আমি সবসময় বলি, যদি চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন আইনজীবী কিংবা বিচারপ্রার্থীও আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন খোদার কসম আমি চাকুরি ছেড়ে দেব। আমি ছাড়তে হবে না, আমি চুরি করছি জানলে আমার বাপই আমাকে মেরে ফেলবে। ঠিক একইভাবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি ফারুক স্যারের সততা নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন আমি চাকুরি ছেড়ে দেব। মানুষটার সাথে আমি বছর দেড়েক চাকুরি করেছি। আমি জানি মানুষটা কেমন।
তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদ থেকে আজ থেকে সতেরো বছর আগে চাকুরি ছেড়ে এ কম সুবিধার চাকুরিতে ঢুকেছিলেন শুধু মানুষকে ন্যায়বিচার প্রদান করবেন বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে যে ভালো অবস্থায় থাকতেন এখন তার চেয়ে অবশ্যই কম ভালো আছেন। তিনি বিদেশেই একাধিক মাস্টার্স করেছেন। চাইলেই বাংলাদেশের স্বনামধন্য কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে ঢের বেশি উপার্জন করতে পারতেন। মানুষটা তার কিছুই না করে শুধু ন্যায়বিচার করতে চেয়েছিলেন, আপনারা যারা তাকে এ নগ্ন প্রতিদান দিলেন কাল কেয়ামতের মাঠে তাদের বিচার অবশ্যই শ্রেষ্ঠ বিচারক করবেন। তার আগে আপনাদের দুনিয়ায় বিচার হোক। এর বেশি প্রত্যাশা নেই।
তবে মনে রাখবেন তার দায়িত্ব পালনের অধিকার শুধুই তার। আপনার আদালত বর্জনের অধিকারও শুধুই আপনার। স্যার আপনাদের ডেকে আনেননি। আপনারাও স্যারের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। আমরা বিনয়ী বলে দুর্বল ভাবলে ভুল করবেন!
লেখক : মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম।