হাসানুল বান্না : রফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োক্যামেস্ট্রিতে পড়ছে। থাকে শহীদুল্লাহ হলে। বাবা মারা গিয়েছেন বহুদিন হলো। বাড়িতে মা আর ছোটবোন থাকে। টিউশনির টাকায় নিজে ও মা-বোনের খরচ মেটায় সে। হঠাৎ রফিক জানতে পারে, তার দূরসম্পর্কিত চাচাতো ভাইয়েরা তাদের সকল জমি দখল করে নিয়েছে। দেখিয়েছে দেওয়ানী আদালতের একতরফা ডিক্রির এক কপি। রফিকের মাথায় বাজ পড়লো। কি সেই রায় আর কি সেই ডিক্রি! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা রফিক। তার তখন মনে আসছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো লাইন-
“ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারিনে সেই দুই বিঘা জমি।”
রফিক এলাকায় গিয়ে এক উকিলের সাথে দেখা করলো। উকিল বললেন, রায়-আদেশ না পড়ে কিছুই বলা যাবেনা; আগে নকল তুলতে হবে। তারপর বোঝা যাবে কি করতে হবে! ঐ রায়-ডিক্রির গতি-প্রকৃতি ও পরিণতি বুঝতেই রফিকের চলে গেলো কয়েক হাজার টাকা। সেই টাকার পিছনে রয়েছে হাজারো দুঃখগাঁথা। রফিক মনে মনে ভাবে, আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ স্মার্টফোনেই যেমন অনেক কিছু সহজে পেয়ে যাচ্ছে, সেও যদি তার স্মার্টফোনে সার্চ করেই ঐ মামলার রায়ের কপি খুঁজে পেতো, তাহলে কেমন হতো! প্রযুক্তির এই যুগে এতটুকু প্রত্যাশা তো থাকতেই পারে।
সুখবর হলো, এমন প্রত্যাশা পূরণের পথ ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট দেশের অধস্তন আদালতের রায়-আদেশের অনুলিপি অনলাইনে প্রকাশ সংক্রান্ত নির্দেশনা ইতোমধ্যে জারি করেছে। সুপ্রীম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিগত ১৭ নভেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দ তারিখের ‘নির্দেশনা’ আলোকপাত করলে থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির সানুগ্রহ অনুমোদনক্রমে বিচারিক সেবা প্রদানের মাধ্যমসমূহ সহজতর, দ্রুততম ও সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে অবাধ বিচারিক তথ্যপ্রবাহ ও বিচারপ্রাপ্তিতে সহজ অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের অভিপ্রায়ে একটি ওয়েবসাইট প্রস্তুত করা হয়েছে এবং দেশের সকল অধস্তন আদালতের রায় ও আদেশের অনুলিপি কতিপয় নির্দেশনা ও ব্যবহারবিধি অনুসরণ পূর্বক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
উপর্যুক্ত নির্দেশনা’তে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, অনলাইনে আদালতের আদেশ ও রায়ের দৃষ্টিগোচরতা বৃদ্ধি পেলে বিচারকার্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং আদালত কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মানসম্মত ন্যায়বিচার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও টেকসই উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে, বিচারিক সেবা প্রাপ্তিতে ব্যয়বহুলতা ও দুর্ভোগলাঘব করে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের দোরগোড়ায়ও বিচারের বাণী দ্রুত পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।
বর্ণিত ওয়েবসাইটে (http://decision.bdcourts.gov.bd) প্রবেশ করলে দেখা যায়, অধস্তন আদালতের গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারী মামলা, যেমন হত্যা, ধর্ষণ, সাইবার অপরাধসহ জমি-জমা ও পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত নানাবিধ দেওয়ানীমূল ও আপীল মামলার রায়ের অসংখ্য কপি আপলোড করা হচ্ছে, যা যে কেউ অনলাইনে নিজের সুবিধামত তা দেখতে পাচ্ছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি অধস্তন আদালতের এক জনপন্থী ও জনবান্ধব পদক্ষেপ।
আমার যতদূর জানা আছে, দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও রায় অনলাইনে প্রকাশ করার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই। এছাড়া, রাজশাহী’র একটি আদালতের আদেশ ও রায় অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রচার পায়।
এখন, দেশের সকল আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশ-রায় অনলাইনে প্রকাশ করার মত ঘটনা ঘটছে, বিচারাঙ্গনে যা সত্যিই বিরল ও উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত।আদালতে না এসেই চলমান মামলার আদেশ ও নিষ্পত্তিকৃত মামলার রায়ের বিষয়ে আইনজীবী, আইনজীবীর ক্লার্ক ও বিচারপ্রার্থী জনগণ এখন মাত্র দুই এক ক্লিকেই বিস্তারিতভাবে জানতে পারবেন।
মূলতঃ আদালতের রায় ও আদেশ অনলাইনে প্রকাশ করার রেওয়াজ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত। তবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা যেমন সময়োপযোগী, ঠিক তেমনি জনপন্থী ও জনবান্ধব পদক্ষেপের নামান্তর। বলাই বাহুল্য, প্রচলিত আইনব্যবস্থাও পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপট এমন পদক্ষেপকে জোরালোভাবে সমর্থন করে।
ধরুন, আদালতের কোন আদেশ বা রায় কিসের ভিত্তিতে দেয়া হলো, অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কোন আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল বা রিভিশন দায়ের করবেন কিনা, এসব বিষয়ে জানতে হলে নকলের আবেদন করতে হয়। আর এই আবেদন ও নকলপ্রাপ্তি প্রক্রিয়া আইন-আদালত সম্পর্কে ধারণা না থাকা একজন বিচারপ্রার্থীর কাছে যথেষ্ট বিব্রতকর, ব্যয়সাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। ফলে, আদেশ বা রায় অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণ ঘরে বসেই এখন তৎক্ষণাৎ সে সম্পর্কে অবগত হতে পারছেন। বিশেষ করে, অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ হলে সেগুলোর জন্যে তলবানা দাখিল করতে হয়, এখন যেহেতু মোবাইল ফোনেই সেই তলবানা প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, সেহেতু বাড়তি খরচ ও সময়ের অপচয় ব্যতিরেকেই আইনজীবীগণ তলবানা দাখিল করতে পারবেন।
সাধারণত, ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৭ ধারার বিধান অনুসারে ফৌজদারী মামলার রায়ের তিনটি আর দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ২০ ও বিধি ০৪ এর আলোকে দেওয়ানী মোকদ্দমার রায়ের চারটি অংশ থাকে (যেমন, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, বিচার্য বিষয়, সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তের কারণসমূহ)। কিন্তু, লক্ষ্যনীয় যে, গণমাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ায় কেবল আদালতের কোন সিদ্ধান্তের সংক্ষিপ্ত বা মূলঅংশ প্রকাশ পায়, যার ফলে অনেক সময় সিদ্ধান্তের কারণসমূহ সবিস্তারে না জানার কারণে মানুষ ভুল ধারণা পায় বা তাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
সুতরাং, আদালতের রায় অনলাইনে প্রকাশিত হলে আগ্রহী জনগণ এসব সিদ্ধান্তের কারণ বা ভিত্তি সম্পর্কে যেমন সচেতনভাবে অবগত হতে পারবে, তেমন সেসম্পর্কে যৌক্তিক মতামত ও দিতে সক্ষম হবে। এতে করে আদালতের রায় বাস্তবায়নের পথ সহজ হওয়ার পাশাপাশি আদালত অবমাননা হার হ্রাস পাবে এবং আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও, ‘উন্মুক্ত আদালত’ এর মত একটা একটা সাংবিধানিক ও জনকল্যাণকর ধারণা আছে, যার অর্থ হল “কোন আদালত কক্ষ বা বিচারিক কার্যধারা যেখানে জনসাধারণের ব্যক্তিগত বা দূরবর্তী উপস্থিতির মাধ্যমে অবাধে প্রবেশাধিকার থাকবে।”
অবাধে প্রবেশাধিকারের মধ্যে রয়েছে আদালতের কার্যক্রমে উপস্থিত থাকার ক্ষমতা, সেইসাথে আদালতের রেকর্ড এবং প্রতিলিপিতেও প্রবেশের ক্ষমতা। আর আইনানুগভাবেও এই ধারণা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ (৩), দেওয়ানী কার্যবিধির ১৮ আদেশ ও ০৪ বিধি, এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫২ ধারার বিধানদ্বারা সমর্থিত। সেহেতু আদালতের বিস্তারিত রায় ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, এমন বিচারিক চর্চা ‘উন্মুক্ত আদালত’ এর মত ধারণাকেও দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও সম্প্রসারণ করে।
অনুরূপভাবে, আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশ ও রায়ের ডিজিটাল মাধ্যমে দৃষ্টিগোচরতা বৃদ্ধি পেলে বিচারকার্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি আশাবাদী। আমি বিশ্বাস করি, এরকম উদ্যোগ সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা দুটোই বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে, এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
প্রসঙ্গত, সুপ্রীম কোর্ট হলো আমাদের সংবিধানের রক্ষক। মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট। সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা বা বিচার বিভাগ নিয়ে বেশিরভাগ আলোচনাই উচ্চ আদালত কেন্দ্রীক। তবে, একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের আইনানুগ অধিকার রক্ষার কাজটা অধস্তন আদালতে হয়ে থাকে।
এছাড়াও, অধিকাংশক্ষেত্রেই অধস্তন আদালতের অনেকগুলো চৌকাঠ মাড়ানোর পরই উচ্চ আদালতে পৌছাতে হয় দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিচারপ্রার্থীদের কে। কাজেই, অধস্তন আদালতের বিচারিক সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া অধিকতর সহজ হওয়া নিঃসন্দেহে এখন সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে।
অতএব, অনলাইনে আদালতের আদেশ-রায় প্রকাশের চলমান কার্যক্রম দেশের সাধারণ মানুষের সাথে আদালতের এক ব্যতিক্রমী সেতুবন্ধন তৈরি করতে অবদান রাখবে। অধিকন্ত, অনলাইনে প্রকাশিত অধস্তন আদালতের এরূপ কার্যক্রম নবীন বিচারক, গবেষক, ও আইনের শিক্ষার্থীদের জন্যেও কাজে আসবে বলে আইনের ছাত্র হিসেবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মোদ্দাকথা হল, প্রান্তিক পর্যায়ে ও যেন রফিকদের মত মানুষের কাছে বিচারের সুফল খুব দ্রুত পৌছে যায়, এটাই সকলের কাম্য।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।