গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে একটি আদালতের ডিস্ট্রিক্ট জজ হিসেবে শপথ নিয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইনজীবী সুরেন্দ্রন কে প্যাটেল। বিচারক হিসেবে সুরেন্দ্রনের শপথ নেওয়ার খবর ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোয় ফলাও করে প্রচার করা হয়।
সুরেন্দ্রন সংবাদ শিরোনাম হন তাঁর জীবনের অনুপ্রেরণাদায়ী গল্পের জন্য। বিবিসি হিন্দির প্রতিবেদক ইমরান কুরেইশি সেই সুরেন্দ্রনের গল্প শুনিয়েছেন, যিনি ভারতে থাকার সময় বেঁচে থাকার তাগিদে হাতে বানানো বিড়ি বিক্রি করে বেড়াতেন।
সুরেন্দ্রন প্যাটেলের বয়স এখন ৫১ বছর। তাঁর জন্ম ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায়। সেখানেই বেড়ে ওঠা। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট বেন্ড কাউন্টির ২৪০তম জুডিশিয়াল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
গত ১ জানুয়ারি তিনি শপথ নেন। এর মাত্র পাঁচ বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। নিজের গল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুরেন্দ্রন প্যাটেল বলেন, ‘এটা মূলত কঠোর পরিশ্রম, ঐকান্তিক চেষ্টা ও অনেক সংগ্রামে ভরা একটা গল্প।’
সুরেন্দ্রন প্যাটেল বলেন, ‘তবে আমার জীবনে অনেক মানুষের সহযোগিতা আছে—যাঁরা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাকে সমর্থন দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। আর এ তালিকায় সবার আগে আসবে আমার মায়ের নাম।’ মায়ের অব্যাহত সহযোগিতাকে আত্মত্যাগের প্রতীক বলে বর্ণনা করেন।
সুরেন্দ্রন প্যাটেলের শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। তাঁর বাবা–মা ছিলেন দিনমজুর। প্রতিদিন যা আয় করতেন, তাই দিয়েই ছয় সন্তানের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতেন। প্যাটেল যখন শিশু, তখনই বিড়ি বানানো শিখে নেন।
প্যাটেল বলেন, ‘যাতে তিন বেলা খেতে পারি, এ জন্যই বিড়ি বানানো শুরু করি। আমাদের পরিবারে তখন দিন আনে দিন খায়। তিন বেলা খাবার খেতে পারতাম না আমরা। তাই আমি আর আমার বড় বোন মধ্যরাতে একসঙ্গে বিড়ি বানাতাম।’
সুরেন্দ্রন তখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারার কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন তাঁর বোন ১৫ মাসের মেয়েকে রেখে মারা যান। বড় বোনের মৃত্যুতে তাঁর পরিবার আরও ভেঙে পড়ে। তখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ নয়, আরও অনেক কিছু মেনে নিতে শুরু করেন সুরেন্দ্রন।
তবে ওই ঘটনার স্মৃতি মনে থাকলেও সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে চাননি সুরেন্দ্রন প্যাটেল। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বিষয়টির সুরাহা হয়েছিল যে, আমার বোন আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছিল, এ ঘটনায় ন্যায়বিচার হয়নি। বোনের মৃত্যু আমাকে এখনো তাড়া করে।’
বোনের মৃত্যুর পরে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন সুরেন্দ্রন। এরপর তিনি আবার স্কুলে ভর্তি হন এবং ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করেন। কলেজে যাওয়ার আগে তিনি যখন দুই বছরের ডিগ্রি–পূর্ববর্তী কোর্স করছিলেন, তখন প্যাটেল প্রায় ক্লাস করতে পারতেন না। কারণ, তাঁকে কাজ করতে যেতে হতো। ক্লাসে উপস্থিতি কম থাকার কারণে যখন তাঁর শিক্ষকেরা সুরেন্দ্রনকে প্রথম বর্ষে চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসতে দেবেন না জানালেন, তখন শিক্ষকদের অনুরোধ করেন তিনি।
সুরেন্দ্রন সে ঘটনার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আমি যে পরিবারের অর্থকষ্টের কারণে কাজ করতে যাই বলে ক্লাসে নিয়মিত যেতে পারি না, সেটা আমি শিক্ষকদের বলতে চাইনি। কারণ, কারও করুণা নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না।’
সুরেন্দ্রনের শিক্ষকেরা তাঁকে আরেকটি সুযোগ দেন। তাঁরা তাঁর বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারেন কাজ করতে না গেলে সুরেন্দ্রনের পরিবারকে অভুক্ত থাকতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই তিনি ক্লাস না করে কাজ করতে যান।
যখন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, তখন তো সবাই অবাক। কারণ, পরীক্ষায় ক্লাসের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছেন সুরেন্দ্রন। এর মধ্যেই সুরেন্দ্রন সিদ্ধান্ত নেন যে পড়াশোনা করলে তিনি আইন বিষয়েই পড়বেন। সুরেন্দ্রন বলেন, ‘আমি জীবনে আইনজীবী ছাড়া কিছু হতে চাইনি। কারণ, আইন বিষয়ে পড়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।’
কিন্তু সুরেন্দ্রনের পরিবারের আর্থিক অনটন লেগেই ছিল। এ কারণে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু চলার পথে তিনি এমন অনেক মানুষের দেখা পেয়েছেন, যাঁরা সুরেন্দ্রনকে তাঁর স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাঁদেরই একজন উত্থাপ। কেরালায় একটি হোটেল ছিল তাঁর। সুরেন্দ্রন বলেন, ‘আমি তাঁকে (উত্থাপ) বলি, যদি তিনি আমাকে একটা কাজ না দেন তাহলে আমার পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। এরপর উত্থাপ আমাকে তাঁর হোটেলে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ দেন।’
উত্থাপের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই সুরেন্দ্রনের। উত্থাপের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে এই সম্পর্ক ছিল বলে জানালেন সুরেন্দ্রন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক হলাম আর এ খবর ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সবার জানাজানি হয়ে গেল, তখনো তাঁর (উত্থাপ) ভাই ম্যানুয়েল আমাকে ফোন করেছিলেন।’
আইন বিষয়ে পড়ার আগে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করেন সুরেন্দ্রন। চার বছর পরে তিনি আইনজীবী পি আপ্পুকুত্তানের সহকারী হিসেবে একটি চাকিরও পান। এরপর তিনি কেরালার কাসারগড় জেলায় আইনজীবীর সহকারীর কাজ শুরু করেন।
আপ্পুকুত্তান বিবিসিকে বলেন, ‘সে ছিল খুব উৎসাহী এবং আমি তাঁকে বিশ্বাস করতাম। সব ধরনের দেওয়ানি মামলার কাজ আমি তাঁকে করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কারণ, আমি জানতাম এসব কাজ করার যোগ্যতা রয়েছে তার।’
স্ত্রী শুভা দিল্লির একটি হাসপাতালে চাকরি পাওয়ার আগপর্যন্ত সুরেন্দ্রন আপ্পুকুত্তানের সহকারী হিসেবে প্রায় এক দশক কাজ করেছেন। দিল্লিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কয়েক মাস কাজ করেন সুরেন্দ্রন। এবার তাঁর স্ত্রী শুভার আবার দিল্লি ছেড়ে যাওয়ার সময় আসে। এবার সুরেন্দ্রনের স্ত্রী শুভার গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
সুরেন্দ্রন বলেন, ‘আমি আমার পেশা ছাড়তে না চাইলেও তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যাই। কারণ, তাঁকে ছাড়া আমি আজ যে অবস্থানে আছি, তা হয়তো হতে পারতাম না।’
সুরেন্দ্রন ও শুভা দম্পতি ২০০৭ সালে টেক্সাসে পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে কিছুদিনের জন্য একটি মুদিদোকানে কাজ করেন সুরেন্দ্রন। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর মনে হয় তিনি তো টেক্সাসে বার এক্সাম (আইনজীবীদের পরীক্ষা) দিতে পারেন। এরপর তিনি আন্তর্জাতিক আইনের ওপর একটি ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা শুরু করেন।
সুরেন্দ্রন যখন ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে বিচারক পদের জন্য লড়বেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তাঁকে বাজে কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি বিচারক পদের জন্য লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন, তখন ভারতীয় উচ্চারণে ইংরেজি বলায় অনেকে তাচ্ছিল্য করেন।
সেসব অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সুরেন্দ্রন বলেন, ‘এসব করলেও আমি তাতে খুব একটা কষ্ট পেতাম না। প্রচারণায় মাঝেমধ্যেই এসব নোংরা ঘটনা ঘটতে পারে। আমি ভাবি, যত দিন এখানে থাকবেন, তত দিন এসব কোনো ব্যাপার নয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয়টা হচ্ছে, কত দিন আপনি কমিউনিটির সেবা করতে পারলেন।’
যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সফল হওয়ার গল্প সম্পর্কে সুরেন্দ্রন বললেন, ‘এটা আমার জন্য একটা বড় পুরস্কার। মাত্র পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছি। এখন ২০২২ সাল। আমি নির্বাচনে (বিচারক হতে হলে নির্বাচনে লড়তে হয়) জিতেছি। আমার মনে হয় না এটা অন্য কোনো দেশে হলে সম্ভব ছিল।’
সূত্র : প্রথম আলো